অনেককেই আফসোস করতে শোনা যায়, মিষ্টি খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি, তাও সুগার কমছে না। কিন্তু অনেক সময় মানুষ খেয়ালই করেন না, তিনি ঠিক কতটা শর্করা খেয়েছেন। এশিয়ার মানুষ মূলত শর্করাভোজী। দৈনন্দিন খাবারের বড় অংশজুড়ে থাকে শর্করা। যেমন ভাত, রুটি, আলু ইত্যাদি। একটা মিল বা খাবারে শর্করা, আমিষ, চর্বি, ভিটামিন খনিজের সঠিক যে অনুপাত থাকা দরকার (শর্করা ৪০-৫০ শতাংশ, আমিষ ৩০-৪০ শতাংশ, চর্বি ২০-৩০ শতাংশ) তা অনেকেই মানে না।
এমনও হয় যে অনেকে শর্করা দিয়েই শর্করা খায়। যেমন আলুসেদ্ধ দিয়ে ভাত বা আলুভাজা দিয়ে রুটি। গুড় দিয়ে পিঠে। আবার কোনও খাবারে চিনির পরিমাণ কতটুকু, তা হিসাব করে খাওয়া হয় না। আরেকটা সমস্যা হলো আমাদের অনুষ্ঠান–উৎসবে যেসব পদ করা হয়, তার প্রায় সবই উচ্চ শর্করাযুক্ত। সব মিলিয়ে আমাদের শর্করা বা চিনি খাওয়া প্রায়ই মাত্রা ছাড়িয়ে যায়।
শর্করা মানেই কি চিনি?
শর্করা আছে দুই ধরনের। সরল শর্করা আর জটিল শর্করা। যে শর্করায় কার্বন অণুর বন্ধনের পরিমাণ যত বেশি, সেই শর্করা তত জটিল। যেমন গোটা শস্য—যব, লাল আটা, ভুট্টা, ঢেঁকিছাঁটা চাল বা লাল চাল। জটিল শর্করা অন্ত্রে শোষিত হয় কম, ফলে এ থেকে আমরা চিনিও পাই কম। কিন্তু সরল শর্করা দ্রুত অন্ত্রে শোষিত হয়, আর রক্তে চিনির মাত্রাকে দ্রুত বাড়িয়ে দেয়। যেমন সাদা চিনি, সাদা চাল, সাদা ময়দার তৈরি খাবার, সাদা পাউরুটি। তাই যেকোনো শর্করা মানেই অনেক চিনি, তা নয়। জটিল শর্করা ভেঙে রক্তে চিনি তৈরি হবে কম, এটি ভালো শর্করা। উল্টো দিকে সরল শর্করার প্রায় পুরোটাই রক্তে চিনি হিসেবে শোষিত হয়, তাই এটি খারাপ।
গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কী
কোন খাবার খেলে রক্তে সুগার কতটা বাড়বে, তার একটা নির্ধারক আছে। একে বলে গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (জিআই)। ৫০ গ্রাম সাদা চিনি যতটা সুগার বাড়ায়, তার সঙ্গে ৫০ গ্রাম ওই খাবারের তুলনা করে এই ইনডেক্স তৈরি হয়। যদি কোনো খাবারের জিআই ৭০–এর বেশি হয়, তবে তার শর্করার মাত্রা অনেক বেশি, মানে এটি একটি হাই জিআই ফুড। ৫০ থেকে ৭০ হলে তার জিআই মাঝারি মাত্রার, আর ৫০–এর নিচে হলে এটি খেলে চিনি ততটা বাড়বে না, কারণ এটি লো জিআই ফুড।
রোজকার ৫টি শর্করা খাবার
এখন জেনে নিই, আমরা প্রতিদিন যেসব খাবার সাধারণত খাই বা ভালোবাসি, সেখানে উচ্চ জিআইযুক্ত খাবার কতগুলো আছে। ভাত: আমরা যে সাদা চালের ভাত খাই, তা একটি উচ্চ জিআইযুক্ত খাবার। যার জিআই ৭০–এর ওপর। ক্ষেত্রবিশেষে, যেমন চিকন ছাঁটা বা পোলাওয়ের চালে ১০০–এর কাছাকাছি। শুধু তাই নয়, ভাতে ক্যালরিও অনেক বেশি। এক কাপ পরিমাণ ভাত (১৫৮ গ্রাম ভাত) থেকে আমরা ২০০–এর ওপর কিলোক্যালরি পেয়ে যাই। আর এক কাপ ভাতে থাকে ৭৫ গ্রাম শর্করা। চালের প্রকারভেদে জিআই এদিক–ওদিক হয়, তবে বাজারের প্রায় সব সাদা চালেরই জিআই এমন বেশি। যদি ব্রাউন রাইস বা ফাইবারযুক্ত লাল চাল খেতে পারেন তবে এর জিআই কমে আসবে ৫০-৫৫–এর কোঠায়।
রুটি: গোটা গম ভেঙে তৈরি করা লালচে আটার জিআই বেশ কম (৩০–এর মতো)। কিন্তু মিলে নানা মাত্রার পরিশোধনের ফলে এর ফাইবার বা আঁশ কমতে থাকে। কোনো কোনো সাদা আটার জিআই তখন গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ভাতের সমান—৭০। আবার লাল আটার গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ৬২। মানে মাঝারি মাত্রার। তাই বলে যত খুশি তত রুটি খাওয়া চলবে না। অনেকেই রেস্তোরাঁয় বা উৎসবে খেতে গিয়ে ভাত না নিয়ে নানরুটি নেন। ভাবেন, এতে কম চিনি আছে। মোটেও তা নয়। নানরুটিতে জিআই অনেক বেশি—৭১-৭২। একই কথা খাটে সাদা ময়দার তৈরি পরোটার ক্ষেত্রেও। আটার রুটির চেয়ে যবের রুটির জিআই কম। সবচেয়ে কম বেসনের তৈরি রুটিতে।
পাউরুটি: সাদা পাউরুটি বা ব্রেডের জিআই প্রায় ১০০–এর কাছাকাছি। এটি খুবই উচ্চ জিআইযুক্ত খাবার। এর শর্করার পরিমাণও অনেক বেশি—প্রতিটি মাঝারি সাইজে আছে প্রায় ৩৭ গ্রাম শর্করা। তার মানে ব্রেডের তৈরি স্যান্ডউইচ, নানা রকম নাশতা ডায়াবেটিস রোগীর জন্য মোটেও ভালো নয়। তবে আপনি যদি হোল গ্রেন বা গোটা শস্যের তৈরি ব্রাউন ব্রেড খেতে পারেন, যা আজকাল বিভিন্ন সুপারশপে পাওয়া যায়, তবে জিআই অনেকটা কমে আসে।
আলু: রান্না করা আলু, বেকড আলু, ম্যাশড পটেটো—যেভাবেই খান না কেন, আলুরও জিআই অনেক। প্রায় ১০০-এর কাছাকাছি। তাই আলুভর্তা, আলুভাজি আর আলু তরকারি বাঙালির যতই প্রিয় হোক না কেন, রক্তে চিনি কমাতে হলে এটা এড়াতে হবে।
নুডলস/পাস্তা: চিনারা যে সেদ্ধ বা স্যুপের মতো নুডলস খায়, তার জিআই ৪০-এর মতো। পাস্তা বা স্পেগেটিরও তা–ই। কিন্তু হোয়াইট পাস্তা, সাদা নুডলস আমরা যে পদ্ধতিতে রান্না করে খাই, তাতে জিআই বেড়ে যায়। নুডলস, পাস্তা, স্পেগেটিও শর্করাজাতীয় খাবার। এগুলো খাওয়ার নিয়ম হলো সঙ্গে সবজি, ডিম, মুরগির মাংস ইত্যাদি মেশাতে হবে। দীর্ঘ সময় রান্না বা ভাজা যাবে না। অল্প সময় সেদ্ধ করে নিয়ে অনুষঙ্গ দিয়ে খাওয়া ভালো।