scorecardresearch
 

Salasar Dham: ড্রাইভার বলল, 'ইয়ে সালাসার ধাম হ্যায়, স্যার', রাজস্থানের মরুভূমি শুরু এখান থেকেই

শতাব্দী এক্সপ্রেসে করে জয়পুর। ভোরবেলায় সকাল ছ’টায় নিউদিল্লি সেশন থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল। সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ জয়পুর স্টেশনে এসে পৌঁছলাম। তারপর জাতীয় সড়ক দিয়ে হু হু করে আমাদের গাড়ি এসে পৌঁছলো সালাসার ধাম।

Advertisement
সালাসার ধাম রাজস্থান সালাসার ধাম রাজস্থান

আমরা এখন জয়পুর থেকে সালাসার ধামে বালাজির মন্দিরের দিকে চলেছি।

সত্যি, জীবন কত বিচিত্র!

রাস্তার পাশেই শর্মাজি-র চায়ের দোকান। বেশ বড়সড় একটা ধাবাই বানিয়ে ফেলেছেন তিনি। সেখানে চা-টা খেলাম।

ভদ্রলোকের নাম পরমানন্দ শর্মা। কথায় কথায় জানলাম, শর্মাজির জন্ম রাজস্থানে হলেও তাঁর বাবা জিন্দল ফ্যাক্টরিতে চাকরি করতেন। সেই সূত্রে তিনি রাজস্থান থেকে চলে গেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের লিলুয়াতে। ’৯০ সালে তিনি আবার রাজস্থানে ফিরে এসেছেন। পরমানন্দের ভাইয়ের নাম রামানন্দ। রাজস্থানে তারা দুই ভাই মিলে চায়ের দোকান খুলেছেন।

পরমানন্দর বাবা ও ঠাকুরদা— সবাই রাজস্থানের। পরমানন্দ শর্মার বাবা— তিনি জিন্দল ফ্যাক্টরির ম্যানেজার হয়ে কলকাতায় চলে যান। তারা লিলুয়ায় থাকতেন। অবশ্য এখনও লিলুয়ায় তাদের বাড়ি আছে। ডানকুনিতে তারা জমি কিনেছিলেন। ছোটভাই পরমানন্দ ওখানকার জমিজমা দেখাশোনা করেন।

রাজস্থানের সালাসার ধাম
রাজস্থানের সালাসার ধাম

রাজস্থানে অনেকটা জমি নিয়ে তারা বেশ বড়সড় একটা চায়ের ধাবা তৈরি করেছেন। সেই ধাবাটাকে বেশ আধুনিক ডিজাইন করেছেন। এই ধাবার কাছাকাছি অনেক স্কুল-কলেজ আছে। সেই কারণে এই ধাবায় প্রচুর ছাত্র-ছাত্রীরাও আসে। দেখছিলাম, দেওয়ালে একটা পুরনো সাইকেল ঝুলিয়ে তাতে ছোট ছোট টুনি লাগিয়ে রেখেছেন। অনেক বাচ্চারা এসে সেখানে সেল্ফি তোলে। তারা চা-কফি খায়। এছাড়াও এখানে নানারকমের বিস্কুট এবং ক্যাডবেরিও রয়েছে। বেশ ভাল একটা অভিজ্ঞতা হল আমাদের।

পরমানন্দ মাটির ভাঁড়ে করে চিনি ছাড়া দুধ চা তৈরি করে দিলেন আমাদের জন্য। সেই মাটির ভাঁড়গুলো আবার ডিজাইন করা। পরমানন্দ একটু দুঃখ করে বলছিলেন, এটা বাংলার মাটি দিয়ে তৈরি নয়, রাজস্থানের রুক্ষ মাটি দিয়ে তৈরি।

পরমানন্দ অত্যন্ত ভদ্র মানুষ। বাংলার প্রতি তাঁর এত দরদ যে এখনও আছে, সেটা বুঝতে পারলাম তার আন্তরিক ব্যবহারে। তিনি ছোটবেলায় লিলুয়ার উমেশচন্দ্র কলেজে পড়াশোনা করেছেন। তার ভাই বি.কম পাশ করেছেন। তার ভাই পড়াশোনা করেছেন ডনবস্কো থেকে। তিনি একটু বেশি লেখাপড়া জানেন।

Advertisement
সালাসার ধাম

পরমানন্দ বলছিলেন, তাদের ভাইয়ে ভাইয়ে একটু মনোমালিন্যও আছে। তার মা এখনও বেঁচে আছেন। মায়ের ৯০ বছর বয়স। মা ওঁর কাছেই থাকেন। কী গর্ব করে তিনি বললেন যে, মা আমার কাছেই থাকেন! তার তিনটে মেয়ে। দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। তাদের কাছাকাছিই বিয়ে হয়েছে। খুব ভাল ঘরে তার মেয়ের বিয়ে হয়েছে। সামনের জানুয়ারি মাসে তার ছোট মেয়ের বিয়ে। তিনি বলছিলেন, তার মেয়েরা প্রত্যেকেই লেখাপড়া শিখেছে। একজন ফিজিওলজি নিয়ে এম.এস.সি করেছে। একজন বি.টেক করেছে।

শর্মাজি-র সঙ্গে আলাপ হয়ে খুব ভাল লাগল।

সেখান থেকে ফিরে আসার সময় শর্মা জী— তিনি কিছুতেই আমার কাছ থেকে তিনি পয়সা নেবেন না। আমরা তাঁর দোকানে চা-বিস্কুট এবং আরও অনেক কিছু খেলাম! কিন্তু তিনি কিছুতেই পয়সা নেবেন না। অনেক পীড়াপীড়ির পর তিনি শুধু চায়ের দামটুকু নিলেন। বললেন, এইটুকু যদি না নিই, তাহলে আমাকে অন্তত মনে রাখবেন। আমার কথা ভুলবেন না।

ভাবছিলাম, এইরকম মানুষও আছে! আমার গাড়ির চালককে বলছিলাম, কী অদ্ভুত ব্যাপার! এরকম তো দেখা যায় না!

ড্রাইভার বলল, ইয়ে সালাসার ধাম হ্যায়, স্যার।

শতাব্দী এক্সপ্রেসে করে জয়পুর। ভোরবেলায় সকাল ছ’টায় নিউ দিল্লি সেশন থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল। সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ জয়পুর স্টেশনে এসে পৌঁছলাম। তারপর জাতীয় সড়ক দিয়ে হু হু করে আমাদের গাড়ি এসে পৌঁছলো সালাসার ধাম।

দিল্লি থেকে সালাসারের দূরত্ব ১৭০ কিমি। এখানে পৌঁছতে প্রায় তিন ঘণ্টা মত সময় লাগে। মাঝখানে আমরা একটু চায়ের জন্য বিরতি নিয়েছিলাম।

এই সেই সালাসার ধাম। সালাসার ধামের কথা আমরা অনেক শুনেছি। সালাসার ধাম রাজস্থানের চুরু জেলার অন্তর্ভূক্ত। এখান থেকেই রাজস্থানের মরুভূমি এলাকা শুরু হচ্ছে। যদিও এখান থেকে জয়সলমীর খুব কাছে নয়। এখান থেকে জয়সলমীরের দূরত্ব প্রায় ১৬০-১৭০ কিলোমিটার। তাহলেও মরুভূমির যে জলবায়ু, আবহাওয়া, মেজাজ, সেটা এই চুরু জেলাতে পাওয়া যায়। বিশেষ করে সালাসার ধামে তো বটেই।

সালাসার ধামের প্রাচীন কাহিনি শুরু আজ থেকে প্রায় ৫০০ বছর আগে। ৫০০ বছর আগে গণ্ডসো নামে একটা গ্রাম ছিল। সেই জনপদের অধীন ছিল আসোদা গ্রাম। এই অঞ্চলে একটা তীব্র জলাভাব তৈরি হয়েছিল। পানীয় জলের তীব্র সংকট। গোটা গ্রামবাসী একফোঁটা জলের জন্য ত্রাহি ত্রাহি করছে। সেইরকম একটা সংকটজনক অধ্যায়ে গ্রামে এক সাধুর আগমন হল।

সালাসার বালাজি মন্দির
সালাসার বালাজি মন্দির

এই ঘটনার কথা শুনে ‘গাইড’ ছবির কথা মনে পড়ে, যেখানে একটি মন্দিরে এক সাধুর আগমন হয়েছে। সেখানে সাধুর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন দেবানন্দ। সেখানেও ছিল জলাভাব। বৃষ্টি হচ্ছিল না। গ্রামবাসীদের তীব্র বিশ্বাসে দেবানন্দ সাধুর মত জীবনযাত্রায় যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। এক ভারতীয় জনপদের গ্রামীণ যে মানসিকতার, তার এক অদ্ভুত পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল সেই ছবিতে। ভুলে গেলে চলবে না, গাইড ছবির যে গল্প, সেটি একটা বিশ্ব-বিখ্যাত গল্প। সেটা আর কে নারায়ণনের ছবি গাইড।

যাই হোক, আমরা ফিরে আসি সালাসারের গল্পে। সালাসারে তখন গ্রামবাসীদের খুব দুঃখ! গ্রামবাসীরা ভাবছে, কী করা যায়! তখন গ্রামের সবাই মিলে সেই সাধুর কাছে গিয়ে তার পায়ে পড়ে বলল, আমরা এর প্রতিকার চাই। কীভাবে এর প্রতিকার হতে পারে, আপনি বলুন?

Advertisement

সাধু তখন গ্রামবাসীদের বললেন, এখানে একটা উপায়ে জল পাওয়া যেতে পারে। তোমরা যদি এখানে একটা কুঁয়ো বানাতে পারো। আর শোনো, সেই কুঁয়োতে নিশ্চিত জল আসবে, কিন্তু যারা সেই কুঁয়ো খুঁড়বেন, তাদের মধ্যে একজন জীবিত ব্যক্তির কিন্তু প্রাণ চলে যাবে! কেননা, এই কুঁয়ো একজন ব্যক্তিকে খেতে চাইছে!

সন্ন্যাসীর এহেন মন্তব্য শুনে তো গ্রামের মানুষ অনেকেই মুষড়ে পড়ল।

গ্রামবাসীদের মধ্যে ঐক্য ছিল। ভালবাসা ছিল। তারা ভাবল, যদি জলের জন্য সেই গ্রামের একজন মানুষও প্রাণ দেয়, তাতে কারোরই মনে শান্তি আসবে না। সর্বদা তারা একটা মনোকষ্টে দিন কাটাবে।

তখন সমবেতভাবে সবাই ঠিক করল, তবে আর আমাদের কুঁয়ো খুঁড়ে কাজ নেই। আমরা জল-সংকটের মধ্যে থাকব, তবু ভাল। কিন্তু কোনও একজন সতীর্থ গ্রামবাসীর মৃত্যু কখনোই কাম্য নয়।

এরপর সবাই মিলে ঠিক করল, তাহলে একটা কাজ করা যাক, আমরা এই গ্রাম থেকে অনেক দূরে কোথাও চলে যাই। সেখানে গিয়ে যেখানে জল আছে, এমন জায়গা থেকে আমরা জল বয়ে নিয়ে আসব এই গ্রামের মানুষদের জন্য। যেভাবেই হোক, পানীয় জলের সমস্যা যাতে নিবারণ করা যায়, আমরা সেই চেষ্টা করব।

এইরকম একটা পরিস্থিতিতে যিনি সেই গ্রামের মন্দিরের পুজারী ছিলেন, যার নাম ছিল মোটারামজী, তিনি মনে মনে সঙ্কল্প করে বললেন, যদি একজনের বলিদানে গোটা গ্রামবাসী জল পায়, তাহলে আমি কেন সেই প্রাণী হব না? আমার প্রাণ কেন বলিদান দেব না? আমিই বলিদান দিই।

মোটারামজীর দিক থেকে সেটা সৎ চিন্তা। গ্রামবাসীরা তাকে অনেক করে বারণ করল। কিন্তু মোটারামজী কারোর কথায় কান না দিয়ে কুঁয়ো খুঁড়তে শুরু করে দিলেন। তিনি ঠিক করলেন, তিনি কুঁয়ো খুঁড়বেন এবং সেই কুঁয়ো থেকে যাতে জল বেরোয়, তার ব্যবস্থা করতে হবে।

কুঁয়ো খুঁড়তে খুঁড়তে হঠাৎ একদিন মোটারামজী অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এরপর তাঁর পেটে অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হল। তৎক্ষণাৎ ওই কুঁয়ো খুঁড়তে খুঁড়তেই মোটারামজী মারা গেলেন।

এদিকে আর একটু দূরে আর একটা গ্রাম, যার নাম ছিল নাগর। খাম্মাদ নামে আর একটা গ্রাম ছিল। সেখানে মোটারামজীর স্ত্রী ভোলাদেবী থাকতেন তাঁর বাবা-মায়ের সঙ্গে। জলের সঙ্কটের জন্যই তিনি সেখান চলে গেছিলেন। একদিন সকালে হঠাৎ ভোলাদেবীর হাতের চুড়িগুলো ভেঙে গেল! ভোলাদেবীর ভাবলেন, নিশ্চয়ই কোনও অঘটন ঘটেছে! ভোলাদেবীর মনে হল, তাঁর অন্তরাত্মা বলছে, তোমার স্বামীর স্বর্গবাস হয়ে গেছে! তাঁর পতিদেব ইহলোক থেকে বিদায় নিয়েছেন!

সালাসার
সালাসার

ভোলাদেবী সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মা’কে বললেন, মা, আমি সালাসারে চললাম।

তিনি যখন সালাসারে পৌঁছলেন, তখন তিনি দেখলেন, মোটারামজীর পার্থিব শরীর বিলীন হয়ে গেছে। এরপর তিনি সেই গ্রামবাসীদের বললেন, এই কুঁয়ো থেকে তোমরা কেউ জল খেও না। তিনি আরও বললেন, যেখানে গণ্ডসের শাখা আছে, সেখানে জাঠ মানুষরা থাকে। আমি তোমাদের জাঠ এলাকার সেই জল খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। সতী মায়ের আদেশ হয়েছে, ওই গণ্ডস শাখাটি থেকে জাঠরা— তারা এই জল আনার ব্যবস্থা করবে। সেখানকার যে জাঠ, তারা খুব সেবাপরায়ণ। সেখানে জাঠেরা মিলে একটা পুকুর খুঁড়ল। পুকুর খুঁড়ে তারা সেখানকার জল নিয়ে এল এই সালাসার গ্রামে।

তখন থেকে সালাসার গ্রামের মানুষজন মোটারামজীর স্ত্রী ভোলাদেবীকে সতী মায়ের মত মানতে শুরু করল। সেই থেকে এই গ্রামের নামও হয়ে গেল সতীগ্রাম। সেই জাঠরা ২০০ বিঘে মত জমি দিয়েছিল এই গ্রামের মানুষদের সেবা করার জন্য, এই জলাধার তৈরি করার জন্য।

Advertisement

আর একটি অতীতের কাহিনি পাওয়া যায়।

সে ৫০০ বছর আগেকার কথা। এরপর ভোলাদেবী এবং তাঁর পরিবারের বংশধরেরা এই গ্রামে বসবাস করতে শুরু করল। তখন চুরু গ্রামে একের পর এক পুরোহিতরা এলেন। এরপর সেখানে সালাসার নামে যে গ্রামটা তৈরি হল, সেই সালাসার গ্রামেই জন্ম নিলেন মোহনদাস নামে একজন সাধু। তিনি লক্ষ্মীরামজীর সবথেকে ছোট ছেলে ছিলেন। তাঁর জন্মের সময় জ্যোতিষীরা বলেছিলেন, তিনি হবেন একজন মস্ত বড় সাধক। এই মোহনদাসই এই গ্রামের উন্নয়ন, সামাজিক সমস্যা— সমস্ত কিছু মেটানোর কাজ করতেন। তিনি বিয়ে থা করেননি। তিনি তাঁর বোনের সঙ্গে থাকতেন। কথিত আছে, তাঁর বোনও একজন সাধ্বীর মতো জীবন কাটিয়েছেন।

মোহনদাস এই হনুমান মন্দির স্থাপনা করেছিলেন। গ্রামের কোনও একজন জাঠ-কৃষক লাঙল চালাতে চালাতে মাটির তলা থেকে এই মূর্তিটা খুঁজে পান। প্রথমে তার লাঙলের ফলায় একটা পাথর এসে ঠেকে। তখন তার মনে হল যে, এখানে একটা কিছু আছে। তিনি মাটি খুঁড়ে বার করে দেখেন একটা মূর্তি। মোটারামের বংশধর ওই মোহনদাসজী যেহেতু স্থানীয় পুজারী ছিলেন, তাই সেই জাঠ-কৃষক সেই মূর্তিটা মোহনদাসজীর হাতে তুলে দেন। সেই থেকে মোহনদাসজী সেই মূর্তিটাকে হনুমানজী রূপে পুজো শুরু করেন।

মোহনদাসজী ছিলেন হনুমানের ভক্ত। এখানকার যে জনশ্রুতি এমন যে, মোহনদাসজী হনুমানজীর সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন। তিনি তাঁর সাধনার দ্বারা জোরজবরদস্তি করে হনুমানজীকে তাঁর ঘরে নিয়ে গেছিলেন। তাঁর বোন— তিনিও সাধ্বী বলে পরিচিত। তিনি তাঁর ভাইকে বারবার অনুরোধ করেছিলেন, হনুমানজীকে একবার তাঁর ঘরে নিয়ে আসতে হবে। সেই কথা শুনে তাঁর বোনের দাবি মেটানোর জন্যেও মোহনদাসজী তাঁর বাড়িতে হনুমানজীকে নিয়ে এসেছিলেন। তাঁর বোন হনুমানজীর পছন্দের সমস্ত খাবার খাইয়েছিলেন।

মোহনদাসজী ছোটবেলা থেকেই বিয়ে করবেন না ঠিক করেছিলেন। বিয়ের ব্যাপারে তাঁর একটা ধনুকভাঙা পণ ছিল। মোহনদাসজীর বোন তাঁকে বিয়ে দেওয়ার জন্য খুব চেষ্টা করেছিলেন। এমনকি তার বিয়ের জন্য একটি মেয়েও ঠিক করেছিলেন। কিন্তু তাদের যখন বিয়ে ঠিক হয়, তার কিছুদিন আগেই সেই মেয়েটির মৃত্যু হয়। তারপর মোহদাসজীর বোন আর কখনোই মোহনদাসজীকে বিবাহের জন্য চাপ দেননি।

তারপর থেকে কান্হিবাই এবং মোহনদাস— তারা দুই ভাইবোন একসঙ্গে বসবাস করতেন। এই গ্রামের মানুষ আজও কানহিবাইয়ের মূর্তি স্থাপনা করে তাঁর পুজো করে।

এই গ্রামে মোহনদাসজীর সমাধি এখানে আছে। মোহনদাসজী এখানে মস্ত বড় সাধু বলে পরিচিত।

সালাসার ধাম মন্দিরের সবথেকে বড় বৈশিষ্ট্য হল, এখানে হনুমানকে বলা হয় বালাজী। বালাজী সাধারণত বিষ্ণুকে বলা হয়। দক্ষিণ ভারতের যে মন্দির, সেখানে বালাজী টেম্পল মানে বিষ্ণু টেম্পল। দক্ষিণ ভারতে বালাজীকে বলা হয়, লর্ড বিষ্ণু। কিন্তু রাজস্থানের সালাসারে হনুমানের মন্দিরকে কেন বালাজী বলা হয়, সেই নিয়ে নানানজনের নানান প্রশ্ন আছে। অনেকে বলেন, যেহেতু এখানে বালক হনুমান বেশে বালাজীকে পুজো করা হয়, তাই তিনি বালাজী। আবার অনেকে বলেন, বালাজী আসলে হনুমান বিষ্ণুরই রূপ। সুতরাং, বিষ্ণু এবং হনুমান আলাদা নয়। হনুমানের অবতার হল রাম। আবার যিনি রাম, তিনি একাধারে বিষ্ণুও বটে। তাই বালাজী নামেই এখানে বিষ্ণুর পরিচয়।

রাজস্থানের সালাসারে একমাত্র হনুমানের মূর্তি এখানে পাওয়া যায়, যেখানে হনুমানের গোঁফ এবং দাড়ি আছে। সেটা একটা অদ্ভুত মূর্তি! লাল রঙে শোভিত এই মূর্তি। অবশ্য হনুমানজীর সঙ্গে লাল রঙটা সর্বত্রই দেখা যায়।

লক্ষ্য করলাম, এখানকার সমস্ত দোকান, সমস্ত হোটেল— সবকিছুর সঙ্গে এই বালাজি নামটি জড়িত। অর্থাৎ, এই বালাজি শব্দটি হল এখানকার পাসওয়ার্ড, যেই পাসওয়ার্ড দিয়ে পৌঁছনো যায় একটা আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডলে। বালাজি শব্দটা এখানে খুব জনপ্রিয় একটা শব্দ।

Advertisement

এরপর এখানকার মন্দিরের কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা বলি। এই মন্দিরের সবথেকে যেটা বড় বৈশিষ্ট্য, সেটা হল, এখানে মন্দিরে কোনো পাণ্ডা নেই। এখানে কোনো পাণ্ডাদের অত্যাচার নেই। এখানে পুজো দেওয়ার আলাদা করে কোনো ব্যবস্থা নেই। এখানে সারাক্ষণ মন্দির খোলা থাকে। সেই ভোর পাঁচটায় মন্দির খুলে যায়। রাত্রি দশটা অবধি মন্দির খোলা থাকে। সারাদিন ধরে অনবরত মানুষের স্রোত আসছে। একটা অদ্ভুত ঘুরপ্যাঁচ রাস্তা আছে। কখনো সেটা একতলা থেকে দোতলায় উঠে যাচ্ছে। আবার দোতলা থেকে একতলায় নেমে যাচ্ছে। সেই রাস্তাটার দু’দিক দিয়ে স্টিলের রড দেওয়া হয়েছে। অনেক সময় অনেক জনসভাতে মানুষদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যেরকম ব্যরিকেড বানানো হয়, অনেকটা সেইরকম। এটা আমি একদা অযোধ্যায় রামলালার মন্দিরেও দেখেছিলাম। সেই রড ধরে মানুষজনকে দেখতে দেখতে আমরা এগোচ্ছিলাম।

সালাসার বালাজীর মন্দিরে মাঝে মাঝেই ভক্তরা সবাই মিলে চিৎকার করে ‘জয় শ্রীরাম’ বলে উঠছে। অনেক সময় আবার ‘জয় বালাজী’ বলছে। যে ধরনের মানুষ এখানে আসছে, তাতে ধনী-দরিদ্র, স্থানীয় লোক, বাইরের থেকেও লোকজন আসছেন। এখানে রাজস্থানের মানুষ সবথেকে বেশি আসে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু রাজস্থানের এই জায়গাটা মাড়োয়ারিদের জায়গা, তা নয়।

আমরা জানি, মাড়োয়ারিরা রাজস্থানী হয়। তবে সব রাজস্থানী কিন্তু মাড়োয়ারি হয় না। মাড়োয়ারিরা মাড়োয়ার এলাকা থেকে আসেন। শেখাওয়াত নামে যে অঞ্চল, এটা সেই এলাকায় পড়ে। তাদেরকে শেখাওতি বলা হয়। মাড়োয়ারি এবং শেখাওতিদের আকার-প্রকৃতিতেও অনেকরকমের বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে। মাড়োয়ারিদের পৃথুল শরীর হয়। শেখাওয়াতিরা কিন্তু খুব পেটা চেহারার হয়। তারা খুব পরিশ্রমী হয়। চাষবাস করাটাই তাদের মূল পেশা।

আমি ছোটবেলা থেকে যত বই পড়েছি; যেমন, মেগাস্থিনিস, হিউয়েন সাং, ভূ-পর্যটক— যারাই এসেছেন, তারা যখন ভারতবর্ষকে দেখেছেন, তারা বিভিন্ন গ্রামে গেছেন এবং গ্রামে গিয়ে শুধু গ্রামের যে অর্থনীতির বর্ণনা দিয়েছেন, তা নয়। গ্রামের মানুষের বর্ণনা দিতে গিয়ে তাদের বেশ-ভূষা, তারা কী ধরনের জামাকাপড় পরে, তাদের শরীরের গঠন, যেটা রীতিমতো নৃতাত্ত্বিক গবেষণাতেও কাজে লাগে। সেইসমস্ত লেখকদের লেখাগুলো ইতিহাসের উপাদানের হিসেবে কাজে লাগে।

সেই সমস্ত প্রাচীন রচনার কথা স্মরণ করতে করতে আমিও এখানকার যারা মানুষ তাদের আকার-প্রকৃতি দেখছিলাম। তাদের খুব পেটা চেহারা। এমনকি এখানকার মেয়েদেরও চেহারাটা অনেকটা হরিয়ানার জাঠ মহিলাদের সঙ্গে মেলে। অনেকে হাতে বেশ বড় বড় বালা পরে আছে। তাদের খুব লম্বা লম্বা হাত। তাদের হাতের আঙুলগুলোও বেশ লম্বা। দেখেই বোঝা যায়, তাদের গায়ে বেশ জোর আছে। তারা খুব পরিশ্রমী। তাদের গায়ের রং যে খুব কালো, তা নয়। তবে রোদে পুড়ে তাদের গায়ের রংটা কিছুটা তামাটে হয়ে গেছে। তারা হচ্ছে স্থানীয় বাসিন্দারা।

এদের মধ্যে অনেক বৃদ্ধরা একযোগে বিভিন্ন জায়গায় জটলা করে বসে আড্ডা মারছে, বিড়ি খাচ্ছে। এদের মধ্যে যারা ঠাকুর হয়, তারা কানে দুল পরে। আমাদের ড্রাইভার, যে জয়পুর থেকে আমাদের এই সালাসারে নিয়ে এলো, সে ছিল ঠাকুর। সে বলছিল, আমাদের কানে যে দুল, এটা আমাদের ঠাকুর কা প্যাহেচান হ্যায়।

তবে আজকাল তো এখানে অল্পবয়সী ছেলেরাও স্টাইল করেও কানে দুল পরছে দেখলাম। তারা আবার নানারকম স্টাইল করে চুলে ছাট দিচ্ছে, যেরকম দিল্লিতেও দেয় আজকাল।

এইখানে যে বাজার-দোকান, সেখানে সবথেকে বেশি বিক্রি হচ্ছে লাড্ডু। কেননা, মন্দিরে লাড্ডু-প্রসাদ দেওয়া হয়। এখানে মিষ্টির দোকানগুলো মূলত লাড্ডুর। সেখানে বোঁদের লাড্ডু তো আছেই, এছাড়া চিঁড়ের লাড্ডুও পাওয়া যাচ্ছে। বহু জায়গায় লেখা আছে চিঁড়ের লাড্ডু। চুরমা হচ্ছে ওদের প্রিয় খাবার। চুরমা হল এক প্রকারের গুঁড়ো মিষ্টি।

Advertisement

মজার ব্যাপার হল, এখানে আলাদা করে কোনো পুজারী পুজো দেন না। এখানে মূল জিনিসটা হল দর্শন। দর্শনের পর আপনি যে প্রসাদটা কিনছেন, সেই প্রসাদটাও ওখানে মন্দিরে দেওয়ার নিয়ম নেই। প্রসাদটা বাইরে বেরিয়ে একটা নির্দিষ্ট জায়গা করে দেওয়া হয়েছে, সেটা কখনও গাছতলায়, কখনও একটা বড় ড্রাম আছে, সেখানে প্রসাদগুলো রেখে দিয়ে আপনি চলে যাবেন। ওইটাই আপনি ঈশ্বরকে দিলেন। তারপরে ওই প্রসাদগুলো ওরা সমস্ত স্থানীয় ভিখাড়ি বা সাধারণ মানুষের মধ্যে বিলি করে দেওয়া হয়।

এখানে ভিখাড়ি কিন্তু তুলনামূলকভাবে অন্যান্য মন্দির থেকে অনেক কম। অবশ্য কিছু ভিখাড়ি মহিলাকে ঘুরতে ফিরতে দেখা যাচ্ছে। তারা লোকজনের কাছে পয়সা চাইছে। কেউ কেউ আবার হাতে একটা ঝাঁটা নিয়ে, সেটা দিয়ে মাথায় দুটো বাড়ি দিয়ে মেরে পয়সা নেওয়ার একটা প্রবৃত্তি রয়েছে দেখলাম। ওখানে পুজো দেওয়ার কোনও সিস্টেম দেখিনি। কাছেই একটা প্রাচীন অশ্বত্থ গাছ আছে, সেটা একটা অদ্ভুত আকৃতি নিয়ে নিয়েছে। ভক্তরা তাদের মনস্কামনা পূর্ণ করার জন্য সেই গাছটাতে নারকেল দিতে পারেন, সেখানে লালসূতো দিয়ে বেঁধে দিতে পারেন। সেখানে ভক্তরা মনস্কামনা পূর্ণ করার জন্য বালাজীর আবেদন জানাতে পারেন।

মজার ব্যাপার হল, এখানকার একজন ট্রাস্টির ছেলে, সে-ও এখানকার খুব গুরুত্বপূর্ণ একজন পুরোহিত হয়েছেন। তিনি বলছিলেন, আমরা পুজো দিই না। আমরা ভেতরে পুজো করি। অর্থাৎ, মন্দিরের মধ্যে যে পুজো, আরতি। সারাদিনে বেশ কয়েকবার সেখানে আরতি হয়, ভোরবেলা মঙ্গল আরতি থেকে শুরু করে রাত্রিবেলা শয়ন আরতি পর্যন্ত। আরতি হয় মন্দিরের দরজা বন্ধ করে। আরতির সময় বিভিন্ন জায়গায় টিভি স্ক্রিন লাগিয়ে দেওয়া হয়, সেই টিভি স্ক্রিনে মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আরতি দেখে। পাশেই জুতো খুলে রেখে তারা সেই আরতি দেখে।

মন্দিরের ভেতরে প্রবেশ নিষিদ্ধ। যদিও সেই মন্দিরের ভেতরে জায়গাও খুব কম। মন্দিরের গর্ভগৃহে ঢুকে আরতি দেখার সেইরকম কোনও ব্যবস্থা নেই। তবে বাইরে থেকে দেখেই আরতি উপভোগ করতে পারে মানুষজন। মাইক্রোফোনে সেটা প্রচারিত হয়।

সেখানকার পুরোহিত বলছিলেন, আমরা কেন আপনার কাছ থেকে পয়সা নিয়ে, পুজোর সামগ্রী নিয়ে পুজো করতে যাব? আমাদের এখানকার প্রথা হচ্ছে, আপনি সরাসরি ঈশ্বরকে দর্শন করুন। তাঁর সঙ্গে কথা বলুন। আমাদের ভায়া হয়ে পুজো দেওয়ার প্রয়োজনীয়তাটা কোথায়? আমরা কী করব, আমরা তো আপনার প্রতিনিধি হয়ে ঈশ্বরকে বলব। তারজন্য আমরা প্রণামী নেব। কিন্তু এখানে সেই ব্যবস্থাটা নেই।

তবে হ্যাঁ, কেউ কেউ এখনও ওখানে গিয়ে পুজো দেওয়ার জন্য পুজারীদের চাপ দেয়। আর পুরোহিতরাও দিয়েও দেয়। অনেক ভিআইপি-রা তো সেটা করেই থাকেন। যেরকম মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলত— তিনি এসেছেন। তিনি তো একেবারে সামনে বসে পুজো দিয়েছেন। ভিআইপিদের জন্য এমন ব্যবস্থা পৃথিবীর সব জায়গাতেই হয় কিনা জানি না, ভারতে তো সবসময়েই হয়ে থাকে। তবে সে সুযোগটা আমরা পাইনি বলে আমাদের কখনোই নিজেদেরকে বঞ্চিত বলে মনে হয়নি।

আমরা তিনদিনে তিনবার খুব সুন্দরভাবে বালাজীকে দর্শন করেছি। দর্শন করতে গিয়ে আমরা দেখেছি, সেখানে একদিকে মোহনদাসের একটা মূর্তি আছে। আর একদিকে রয়েছে সালাসার বালাজীর মূর্তি। আর একদিকে রয়েছে একসঙ্গে অনেকগুলো হনুমানজীর মূর্তি। তিনটে ভাগে বিভক্ত মন্দিরের গর্ভগৃহ।

এরপর বাইরে বেরিয়ে এসে খুব সুন্দর ব্যবস্থা দেখলাম। সেখানে চটি রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। প্রসাদের মধ্যে মূলত লাড্ডু। আর ফুলের মধ্যে মূলত গাঁদাফুল।

সালাসারের ইতিহাস পড়তে গিয়ে দেখছি, এইখানে একটা সরোবর তৈরি হয়েছিল, যে সরোবর এখানকার গ্রামবাসীদের তৃষ্ণা নিবারণ করেছিল। পানীয় জলের সংকট দূর করেছিল। এখন কিন্তু সেই পুকুর বা নদীর কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অনেককেই জিজ্ঞাসা করলাম। কেউ কেউ বললেন, একটা পুকুর ছিল বটে। তবে এখানে কাছাকাছি বেশিরভাগ মানুষই সে খবর জানেন না। আমরাও দেখতে পাইনি সেই পুকুর।

Advertisement

তবে ওখানে মরুভূমি এলাকাতে যেরকম জলের সমস্যা মেটানোর জন্য কৃত্রিমভাবে লেক তৈরি করা হয়, জয়পুর যাওয়ার পথে বড় একটা লেক তৈরি করা হয়েছে। মজার ব্যাপার, স্থানীয় সংবাদপত্র রাজস্থান পত্রিকা এবং ভাস্কর— এই দুটো কাগজেই দেখা যাচ্ছে, জলের সমস্যা এখানে নাকি এখনো খুব তীব্র।

দেখছিলাম, বিরোধী শিবিরের সমস্ত নেতা-কর্মী হবে, তারা মূলত মহিলা, তারা সমবেতভাবে পানীয় জলের সংকট নিবারণের দাবিতে স্থানীয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে অনশন করছে, ধরনা দিচ্ছে। এই ঘটনাটা সেই দিনের, যখন অশোক গেহলাত এখানে মন্দিরে পুজো দিতে আসছেন।

এই ঘটনাটা দেখে আমার মনে হল, এই মন্দির স্থাপনার সময় থেকে কৃষিক্ষেত্র এবং পানীয় জলের সংকট আজও কিন্তু থেকে গেছে। আমরা এত উন্নত হয়েছি, সভ্য হয়েছি। কিন্তু ভারতের এই প্রত্যন্ত গ্রামে এলে বোঝা যায়, মানুষ এখনো এসব এলাকায় কত কষ্টে বসবাস করছেন!

এখানকার বাজারে গিয়ে দেখলাম, ফুড স্ট্রিটের মতো বাজারের মধ্যে একটা রাস্তা তৈরি হয়ে গেছে। এখানে নানানরকমের স্টল। স্টলগুলোর মধ্যে কোথাও ফুচকা বিক্রি হতে দেখলাম না। এখানে দেখলাম, ভুট্টা সিদ্ধ করে, তার সঙ্গে নানানরকম মশলা মিশিয়ে বিক্রি করছে। সেটাকে বলে মশালা সুইট কর্ণ। ওটা একটা উপাদেয় খাদ্য।

এখানে ভাল দুধ পাওয়া যায়। কেননা, প্রচুর গরু আছে। গোশালা আছে। গরুদের চেহারা দেখলে বোঝা যায় যে, গরুরা এখানে যথেষ্ট ভাল তাদের রক্ষণাবেক্ষণ আছে। আর গরুর দুধ যে খাঁটি, সেটা চা খাওয়ার সময় বোঝা যায়। মাটির ভাঁড়ে চা খেলাম আমরা। সেখানে চায়ের দাম তুলনামূলকভাবে বেশি। কুড়ি টাকা করে নিল। কিন্তু ঘন দুধের চা। এখানে বড় কড়াইয়ে দুধ ঢেলে তাতে কেশর দিয়ে মালাই-সহ বিক্রি হচ্ছে। সন্ধেবেলায় এখানকার স্থানীয় লোকেরা এটা পান করে থাকেন। এটা তাদের কাছে একটা বিলাসিতা। কুড়ি টাকায় ছোট গ্লাস আর ত্রিশ টাকায় বড় গ্লাস দুধ বিক্রি হচ্ছে। কেশর দেওয়াতে দুধের রঙ হলুদ রঙের দেখাচ্ছে। এটাও এখানকার লোকেরা একটা গুরুত্বপূর্ণ পানীয় হিসেবে গ্রহন করে।

এছাড়া এখানে খুব বিক্রি হয় কুলফি মালাই। আইসক্রিমের বড় গাড়ি এবং তাতে নানানরকমের ওই কুলফি থাকে। এটাকে মটকা কুলফি বলে। এছাড়া এখানে নানারকমের ডালের কচুরি পাওয়া যায়। শুকনো কচুরি ২০ টাকা। তাতে সমস্ত মশলা দিয়ে, ঝোল মিশিয়ে যদি বানিয়ে দেয়, তাহলে ৩০ টাকা। এটা হচ্ছে এখানকার সকাল-সন্ধ্যার জলখাবার। যেরকম বেনারসে গেলে দেখা যায়, আটার পুরি আর আলুর

সবজি। এখানে আবার সেটা তেমন জনপ্রিয় নয়। এখানে জনপ্রিয় হচ্ছে, কচুরি আর আলুর ঝোল তরকারি। তবে রাজস্থানী খাবার সমস্ত দোকানেই পাওয়া যায়। এখানে মূলত নিরামিষ খাবারেরই প্রধান্য। সালাসারের কোথাও আমি আমিষ খাবারের দোকান দেখতে পাইনি। তবে কেনা খাবার যে কতটা জনপ্রিয় হয়েছে, সেটা এখানে এলে বোঝা যায়। চাউমিনের আলাদা কর্ণার তৈরি হয়েছে। বালাজী চাইনিজ কর্ণার। সেখানে রান্না করা ম্যাগিও পাওয়া যায় দেখলাম। চাইনিজ খাবার যেহেতু খুব সহজে রান্না হয় এবং খিদেও মেটায়। তাই তুলনামূলকভাবে সস্তাও।

কর্মসূত্রে গত ৪০ বছরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ঘোরার সুযোগ হয়েছে। সাংবাদিক হিসেবে ঘোরা তো। এমন এমন জায়গায় ঘুরেছি, যেটাতে অনেক সময় টুরিস্ট হিসেবে ঘোরা সবসময় সম্ভব হয় না। যেমন হয়ত, বাকিংহাম প্যালেসের ভেতরে ঘুরেছি। হোয়াইট হাউসে ক্লিনটন আমাদের নৈশভোজ খাওয়াতে নিয়ে গেছেন। অটলবিহারী বাজপেয়ী তখন প্রধানমন্ত্রী। মনমোহন সিংহের সঙ্গে আবার সেই একই বাড়িতে ওবামা এবং প্রেসিডেন্ট গেছি তাঁর ওবাল অফিস দেখেছি। নিউইয়র্কের ইউনাইটেড নেশনে তন্য তন্য করে ঘুরেছি। হাটসন নদীর তীরে ইউনাইটেড নেশনের অফিসের কফিশপে বসে গপ্পো করেছি বিদেশের বিভিন্ন সাংবাদিকদের সঙ্গে। অনেক সময় সেভাবে হয়ত সাইট সিইং হয়নি। কখনো কখনো তারই মধ্যে ফাঁক-ফোকর নিয়ে সুইজারল্যান্ডে বা প্যারিসে নদীতে বোটক্রুজ করেছি।

Advertisement

এখন মনে হয়, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ঘোরার চেয়ে ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত, বিশেষ করে গ্রামীণ ভারতটা নিবিড়ভাবে দেখতে খুব ইচ্ছে করে। আবার পশ্চিমবঙ্গে থেকে বেরিয়ে এসে যেহেতু কর্মসূত্রে সারাজীবনটাই তো দিল্লিতে কাটিয়েছি। যার ফলে, পশ্চিমবঙ্গের জেলাগুলো খুব গভীরভাবে দেখা। সেখানকার মানুষজনকে বোঝা, তার একটা আলাদা মজা আছে। সেই মজাটা নিতে খুব ইচ্ছে করে। জানি না, শরীরের সমর্থন কতটা সঙ্গে থাকবে।

সমাজতাত্ত্বিক বিনয় ঘোষ যেমন শুধু পশ্চিমবঙ্গে ঘুরেছেন, তা-ই নয়। তখন তো কেউই সেভাবে জেলার ওপর কাজ করেনি, তিনি যেভাবে তাঁর সমাজতত্ত্ব, তাঁর জাতপাত এবং একেকটা জেলার যে তত্ত্বতালাশ করেছেন। ‘পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি’ বলে বহু খণ্ডে তিনি বই লিখে দিয়ে গেছেন। সেটা কিন্তু ভোলবার নয়। বিনয় ঘোষকে আমরা অনেকেই ভুলে গেছি। উত্তম কুমার যেদিন মারা গেছিলেন, বিনয় ঘোষ সেদিন মারা গেছিলেন। তার ফলে বিনয় ঘোষের মৃত্যুর খবরও সংবাদপত্রে বোধহয় ছাপাও হয়নি।

এখন মনে হয়, অনেক সমাজতাত্ত্বিক কাজকর্ম হচ্ছে জেলাগুলো ধরে ধরে। এমনকি ‘লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্স’ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে এসে গবেষণা করছে। কিন্তু বিনয় ঘোষের মত ওইরকমভাবে জেলায় জেলায় ঘোরা এবং জেলাকে দেখা, খুব কম মানুষই করেছেন। এমনকি তথাকথিত যারা সাবঅলটার্ণ পলিটিকাল সাইন্টিস্ট, তারা তো অনেক সময় বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। তারা দীর্ঘ সময় আজকাল বিদেশেই থাকেন আজকাল। তারা তাত্ত্বিকভাবে যথেষ্ট মুনশিয়ানার সঙ্গে কাজকর্ম করছেন, সেখানে নিম্নবর্গদের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে। তবে নিম্নবর্গরা ঠিক কীভাবে আছেন, তাদের জনজীবনের সঙ্গে যুক্ত হওয়া, সেটা কিন্তু খুব কম মানুষই এখনও পর্যন্ত করছেন।

আমার ফেসবুক বন্ধু অর্কময় দত্ত মজুমদার, ইন্ডিয়া টুডে-র সাংবাদিক, সালাসার সম্পর্কে আমার বক্তব্যের প্রেক্ষিতে খুব সুন্দর একটা মন্তব্য করেছেন ফেসবুক পোস্টে। সেইটা আমি আপনাদের জানাতে চাই। অর্ক বলছে, আমাদের ভারতবর্ষটা যেন পঞ্চব্যঞ্জনে সাজানো একটা বিরাট থালা। তাতে নানানরকমের পদ আছে। প্রত্যেকটা পদই অপূর্ব! তাই কী আস্বাদন! কী বিভিন্নতা! আমরা সেই বিভিন্নতার মজাটা না নিয়ে, বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের সন্ধান না করে, আমরা এক একটা পদ নিয়ে লড়াই করছি যে, এই পদটা অমুক পদটার থেকে ভাল। তোমার পদ আর আমার পদ। অর্থাৎ, এই সুক্তোটা ওই ছ্যাঁচরার থেকে অনেক গুণ ভাল। এ এক অদ্ভূত প্রতিযোগিতামূলক সমাজতত্ত্ব!

সালাসারে এসে মনে হচ্ছে, একথা ঠিক যে, এখানে রাজস্থানের মানুষ সবথেকে বেশি এসেছেন। এখানকার যে বৈশিষ্ট্য, সেটা ভারতের আর পাঁচটা শহরের থেকে অনেকটাই আলাদা। আমরা যেরকম খুব বেনারসে যাই। বেনারসের যে ভিড়, আর বেনারস তো শুধু হিন্দু সভ্যতার আদিমতম শহর নয়, বেনারস হল গোটা ভারতীয় সভ্যতার একটা আদিমতম শহর। মার্ক টোয়েনের সেই বিখ্যাত কথা— ইতিহাসের থেকেও প্রাচীন এই কাশী শহরটা। মানে, ইতিহাসের থেকেও পুরনো।

বেনারসের সঙ্গে যদি তুলনা করি, সেখানে আবার অনেকরকমের মিল-অমিল— দু’রকমই আছে। যেরকম, সালাসারে একটাও ফুচকার দোকান পাচ্ছিলাম না। আবার আমরা দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে বাসস্ট্যান্ডের কাছে যখন চলে গেলাম; অর্থাৎ, মন্দির চত্বরের পাঁচ মাইলের ওপাড়ে যাওয়ার পর, তখন দেখলাম, সেখানে অনেক কাপড়-জামার দোকান, জুতোর দোকান, এমনকি ওষুধের দোকান আছে। মন্দির চত্বরে তো একটাও ওষুধের দোকান খুঁজে পাইনি। শুধু একটা আয়ুর্বেদিক ওষুধের দোকান ছিল। আসলে সেখান থেকে শহর শুরু হচ্ছে। আইসিআই ব্যাঙ্ক আর স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার এটিএম আছে দেখলাম। তবে এই দুটো ব্যাঙ্কের এটিএম। অন্য কোনো ব্যঙ্কের এটিএম নেই।

Advertisement

এখানে রাজস্থানের মানুষ এসেছে। হরিয়ানার মানুষ এসেছে। বিহারের মানুষ এসেছে। বাঙালি যে আসে না, তা নয়। বাঙালি তুলনামূলকভাবে খুব কম। মুসলমান সমাজটা কার্যত অনুপস্থিত। আজকে তো একটা পীরের পরব আছে। কিন্তু সেখানে কোনো মুসলিমদের দেখা গেল না।

এখানে খুব বিখ্যাত মেলা হয়, যেটাকে আশ্বিনের মেলা বলে। এই একাদশীর পরেই আশ্বিনের মেলা শুরু হয়। আজ এখানে অনন্ত চতুর্দশী। মহারাষ্ট্রে তো বিরাটভাবে পালিত হয় চুতর্দশী। এই তিথিতে সেখানে গণেশ পুজো হয়। এটা হল অনন্ত চতুর্দশী। এই অনন্ত চতুর্দশী নিয়েও এখানে নানারকমের উৎসবও রয়েছে।

আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে, এখানে বৈষ্ণবদের মন্দির আছে। তিরুপতির মন্দির আছে। আবার শিবের মন্দিরও আছে। এই অনন্ত চতুর্দশী নিয়েও এখানে নানান রকমের উৎসব রয়েছে। এখানে মোহন গুরু স্বামীর যে মন্দির, তার মধ্যে একটা শিবের লিঙ্গ আছে। খুব ভাল লাগল, সন্ন্যাসী মোহন দাস জী-র একটা খুব সুন্দর চালিশা আছে। বোধহয় স্থানীয় ভক্তরাই করেছেন। এটা মোহন দাসের চালিশা। সেই চালিশাটা আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুরোটা পড়লাম। সেই চালিশার প্রত্যেকটা শব্দগুলো জুড়ে দিলে একটা উপনিষদ হয়ে যায়। যারা করেছেন, তারা নিশ্চয়ই গ্রামীণ পণ্ডিত। তারা হয়ত এশিয়াটির সোসাইটিতে কোনও পদক পান না। কিন্তু তাদের যে গভীরতা, সেটা এই চালিশা পড়লে বোঝা যায়।

এখানে যারা আসছেন, তাদে মধ্যে জিন্স পরা মানুষ কম দেখেছি। জিন্স পরে যে কেউ এখানে আসে না, তা নয়। এখানে ধনীরা আসেন বিরাট বিরাট শীততাপ নিয়ন্ত্রিত গাড়িতে করে দল বেঁধে অনেক পরিবার নিয়ে, যারা মূলত উত্তর ভারতীয় পাঞ্জাব এবং মাড়োয়ারি। আবার প্রচুর গরীব মানুষও আসেন।

দেখছিলাম, প্রচুর গরীব মানুষ এসেছেন। আমি অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম তাদের দেখে যে, কী আনন্দে তারা মন্দিরে আছেন। আনন্দ করছেন। তাদের যে অভাব বা দারিদ্র, সেটার সঙ্গে তো তারা সারাজীবন ধরে লড়াই লড়ছে। কিন্তু এখানে এসে তাদের চোখেমুখে সেই অভিব্যক্তিতে দারিদ্রের যে কালিমা, সেই কালিমা যেন একটা তীর্থ দর্শনে ঘুচে যায়। একটা অদ্ভুত প্রাপ্তির আনন্দ আছে। পুরুষ এবং নারী— সবার মধ্যে দেখলাম। নারীদের মধ্যে যেন একটু বেশি চোখে পড়ে। বাচ্চারাও প্রচুর আনন্দ করছে। আর হনুমান হল বাচ্চাদের খুব প্রিয় দেবতা। এখানে প্রচুর গদা বিক্রি হয়। প্লাস্টিকের গদা, স্টিলের গদা, গেরুয়া রঙের গদা। এছাড়া এখানে পতাকা লাগানোর একটা প্রথা আছে। লম্বা লম্বা লাঠি দিয়ে সেখানে রামের নামে, হনুমানের নামে হাতে করে পতাকা কিনছে। দক্ষিণেশ্বরে পুজো দেওয়ার জন্য আমরা প্যাড়া কিনি, শালপাতায় মোড়া একটা নিজস্ব ডিজাইনের প্যাড়া, সেটা যেমন ওখানকার একটা সিস্টেম, এখানে সেইরকমভাবে ওই পতাকা বিক্রি হয় মন্দিরে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

এখানে দেখলাম, মোবাইল ফোন নিয়ে মন্দিরে ঢুকতে দেয়। মোবাইল ফোন রেখে যেতে হবে না। তার ওপর কড়া নিষেধাজ্ঞা বা মোবাইল ফোন জমা দেওয়ার জন্য দক্ষিণেশ্বরে যেরকম পয়সা দিতে হয়, সেসব ব্যবস্থা এখানে নেই। শুধু বলা আছে, মোবাইলটা সুইচ অফ করে রাখতে হবে। এখানে মন্দিরের মধ্যে বিগ্রহের কোনো ছবি তোলা নিষিদ্ধ। এছাড়া মোবাইল নিয়ে যাওয়াতে কোনো বিরোধ নেই।

সবথেকে যেটা ভাল লাগছিল, সেটা হচ্ছে, এখানে মানুষ অনেক দূর-দূরান্ত থেকে হেঁটে হেঁটে আসেন, ঠিক যেরকম আমরা বাবা তারকেশ্বরে যাওয়ার যে প্রথা রয়েছে। শ্রাবণ মাসে যেরকম প্রচুর লোক হাঁটতে হাঁটতে বাবা বিশ্বনাথের মাথায় জল ঢালতে আসেন,

এখানেও সেরকম দূর-দূরান্ত থেকে রাজস্থানের অন্যান্য প্রান্ত থেকে হেঁটে হেঁটে এখানে দর্শন করতে আসেন। এখানে দর্শনটাই সবথেকে বড় জিনিস।

Advertisement

এবারে আসি গ্রামীণ জীবনে যে কৃষির যে সমস্যা, পানীয় জলের সমস্যা, সে বিষয়ে। দুঃখ লাগে, ৭৫ বছর হল স্বাধীনতা হয়ে গেছে। আমরা যারা খুব আধুনিক, যারা কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, আমরা যারা মনে করি, এই ধরনের কুসংস্কার এবং যে সমস্ত দেব-দেবীর পুজো করা— এগুলো অর্থহীন। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, স্বাধীনতার পর নেহেরু বলেছিলেন, মন্দিরটা হচ্ছে আসলে ভিলাইয়ের স্টিল প্ল্যান্ট। রৌরকেল্লার স্টিল প্ল্যান্ট। এগুলোই নাকি আসল মন্দির। উন্নয়ন হবে। কারখানা হবে। মানুষের চাকরি হবে। তা ৭৫ বছর পর কেন এখনও এখানে পানীয় জলের সংকট? কেন মানুষের এখানে সেভাবে শিক্ষার প্রসার হল না? যদি কুসংস্কারও বলি, তাহলে এই কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে বালাজীর মন্দিরে তারা কেন পুজো দিতে আসছে?

এখানে আশেপাশে অনেক ভোজনালয় রয়েছে। মূলত নিরামিষ ভোজনালয়। এখানে পেঁয়াজ-রসুন ছাড়াও রান্না হয়। বেনারসে যেরকম জনবসতির সঙ্গে মন্দির। লোকালয়ের সঙ্গে মিলিয়ে-মিশিয়ে চারদিকে গলি, এখানে তা নয়। এখানে মন্দির এলাকাটাই আলাদা। মন্দির এলাকার মধ্যে যেসব দোকানগুলো দেখছিলাম। প্রচুর মিষ্টান্ন ভাণ্ডার আছে। অধিকাংশই বালাজী মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। এছাড়া আছে আঞ্জনি মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। এইসব যে দোকানগুলো, এই দোকানগুলোর দোতলাটাও ওই মালিকের। দেখছিলাম, ওপরটা খোলা জানালা দেওয়া।

বড় বড় উনুন আছে ওখানে। মিষ্টির যে কারখানা সাধারণত আমরা দেখি, দিল্লিতে বা কলকাতাতেও, অনেক সময় কারখানাটা মিষ্টির দোকানের সঙ্গে যুক্ত থাকে না। কারখানাটা একটু দূরে হয়। কারিগররা মিষ্টি তৈরি করে মিষ্টির দোকানে সেটা নিয়ে আসে। বিভিন্ন সময় এসেগুলো গাড়ি করে আসে। এখানে দোতলাতে মিষ্টি তৈরির জন্য দুধ, চিনি এবং অন্যান্য সরঞ্জাম ওপরের সেই ঘরে রাখা আছে। তবে আমাদের বাঙালিদের মিষ্টি রসগোল্লা, সন্দেশ এবং আরও কতরকমের ভ্যারাইটি পাওয়া যায়। এখানে সেসব বৈচিত্র নেই। এখানে মূলত লাড্ডু, বোঁদে এবং চুরমা, চিঁড়ের প্যাড়া। দোকানে লেখা আছে, দেশি ঘি কা চুরমা ইঁহা মিলতা হ্যায়। শিব ভোজনালয়, জয়লক্ষ্মী মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, সত্যম মিষ্টান্ন ভাণ্ডার—এইসব দোকানের নাম। আর আছে পবিত্র ভোজনালয়, সত্যম ভোজনালয়, চৌধুরি মিষ্টান্ন ভাণ্ডার।

সবথেকে মজার ব্যাপার হচ্ছে যে, লাক্সের বিজ্ঞাপনের সলমান খান, সৌরভ গাঙ্গুলি, সেসবও মন্দিরের ভেতরে পর্যন্ত ঢুকে পড়েছে। একচুয়ালি অখণ্ড ভারত নির্মাণে এইসমস্ত বিপণন-শিল্প বড় একটা জায়গা নিয়েছে।

যেমন, একজন দূরের গ্রাম থেকে এসেছে কস্তুরি মেথি বিক্রি করতে। পেটা কালো চেহারা। কানে দুল। দেখলেই বোঝা যাচ্ছে, তিনি একটা জাঠ-চাষী। তিনি খুব সস্তায় কস্তুরি মেথি বিক্রি করছে। আবার বলেও দিচ্ছে, একদম তুলে এনে এখানে বিক্রি করছি।

সে একেবারে মন্দিরের সমনে একেবারে বসে গেছে। দোকানগুলোতে প্যাকেটে করে যে মেথি বিক্রি হয়, তার যা দাম, সেখানে সে অনেক সস্তায় তিনি বিক্রি করছেন। আমি তাকে বললাম, আমি তোমার একটা ছবি তুলব? তা সেই জাঠ চাষী বললেন, দাঁড়াও, আগে মাথার পাগড়িটা একটু ঠিক করে নিই। এরপর তিনি একটা পোজ দিলেন। ওই পরন্ত দুপুরে, গরমের মধ্যেও তার মনে বেশ ফুর্তি ছিল। তার মেথিটা যে বিক্রি হচ্ছে, সেই আনন্দটাও আছে তার মনে।

ভারতের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, এই সমস্ত প্রাচীন যে জনপদ, এখানে সেইসময় অনেক সাধু, বিশিষ্ট নাগরিক হিসেবে সেই এলাকার মানুষের দুঃখ-দুর্দশা মোচন করা, তাদের সমস্যার সমাধান করা— এইসব কাজে ব্রতী হতেন। ভারতীয় পরম্পরায় সবসময় সাধু-সন্ন্যাসীরা জঙ্গলে গিয়েই তপস্যা করেছেন, এমন নয়। সালাসারের মোহনদাসজীর যে জীবনকাহিনী, তার প্রতি যে এখানকার মানুষের শ্রদ্ধা, তার একটা মস্ত বড় কারণ হচ্ছে, পানীয় জলের সংকট থেকে শুরু করে এখানকার ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখানো, তাদেরকে যথার্থ জ্ঞানের অনুসন্ধানী করে তোলার চেষ্টা— এইসব মোহনদাসজী করেছেন। এমনকি এই এলাকায় সেইসময় অনেক সময় ডাকাত আসত। সেইসব ডাকাতরা জনগণের কাছ থেকে টাকাপয়সা, গয়নাগাটি লুঠ করত। এইসব ডাকাতদের গল্প আমরা বিভিন্ন রাজ্যের ইতিহাসে পড়েছি। ব্রিটিশ লেখকের ঠগী কাহিনি আমরা পড়ছি এবং জেনেছি। কিন্তু এই এলাকায় মোহনদাসজী সেই ডাকাতদের মোকাবিলা করেছেন। অস্ত্র দিয়ে নয়, তাদের সঙ্গে কথা বলে, তাদের বুঝিয়ে, মোহনদাসজী তাদের ভক্ত করে দিয়েছিলেন। যেইসব ডাকাতরা ধুতি পড়ে, মাথায় পাগড়ি বেঁধে, হাতে তরোয়াল নিয়ে ডাকাতি করতে আসত, সেইসব ডাকাতদের মোহদাস বশ করতে পেরেছিলেন।

Advertisement

এছাড়াও মানুষের সুখ-দুঃখের, পরিবারের সুখ-দুঃখের সমস্ত বিষয়ে মোহনদাসজী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা নিয়েছিলেন। সেই কারণে এখনও মানুষ মোহনদাসকে শ্রদ্ধা করছেন। তাঁর সমাধিতে, চরণ চিহ্নে, তাঁর বোনের চরণ চিহ্নে ভক্তরা প্রণাম ঠুকছেন। তাঁর সমাধির সামনে বসে হনুমান চালিশা পড়ছেন।

দেখলাম, মোহনদাসজীর যে চালিশা তৈরি করেছিলেন এখানকার পণ্ডিতরা, সেই চালিশাটাও মন্দিরের দেওয়ালে লাগিয়ে দিয়েছেন। হিন্দিতে লেখা সেই চালিশাটাও খুব চিত্তাকর্ষক। সবমিলিয়ে একটা জিনিস বোঝা যায় যে, আমাদের শ্রেণীহীন সমাজ তো শুধু কমিউনিস্টরা কেন, ৭৫ বছরের শাসনের পরেও হয়নি। সেই দারিদ্র, সেই দুঃখ, সেই ধনী এবং দরিদ্রের তফাৎ।

এখানেও যখন অশোক গেহলাত মন্দিরে পুজো দিতে আসেন, তখন তাঁর ভিআইপি ট্রিটমেন্ট হয়। সাধারণ মানুষরা সেটা পায় না। এই যে ভিআইপি-গিরি, এটা নিয়েও অনেক হাসি-ঠাট্টা চলছে এখানকার সাধারণ মানুষদের মধ্যে। আমাদের গাড়ির যে ড্রাইভার, সে গাড়ি চালাতে চালাতে একটা হোটেলের সামনে গাড়ি আটকে রেখে দিয়েছে। সেখানে রাস্তাটা সরু। সে চিৎকার করে বলছে, ক্যায়া হো গয়া রে? তু পাওয়ার ক্লাব মে হ্যায় ক্যায়া? এই যে ‘পাওয়ার ক্লাব’, এই কথাটা এখানে একটা খুব জনপ্রিয় শব্দ হয়ে গেছে। পাওয়ার ক্লাবে থাকতে পারলে ভাল। রাজনীতির ঝাপট তো আছেই। যদিও অশোক গেহলত এখানে এসে বলেছেন, আমি রাজনীতির কোনো কথা বলব না। আজ আমি এখানে শুধু পুজো দিতে এসেছি।

এখানে আর একটা বিষয় আমাকে খুব আনন্দ দিয়েছে। আবার আশ্চর্যও হয়েছি। দেখছি, রামকৃষ্ণ পরমহংসের একটা মর্মর মূর্তি স্থাপনা করা হয়েছে। তিনি মন্দিরের দিকে তাকিয়ে বসে আছেন। এখানে নিচে লেখা রয়েছে, রামকৃষ্ণ পরমহংস এবং তার নিচে হিন্দিতে লেখা আছে, ‘ইয়ে সাচ হ্যায় কী, পরমাত্মা কা বাস ব্যাঘ্র মে ভি হ্যায়। পরন্তু উসকে পাস জানা উচিত নেহি। উসি প্রকার ইয়ে ভি ঠিক হ্যায়, কী পরমাত্মা দুষ্ট পুরুষ মে ভি বিদ্যমান হ্যায়। পরন্তু উসকা সঙ্গ উচিত নেহি।’ ঠাকুরের এই কথাটা হিন্দিতে লেখা রয়েছে। আমি জানি না, কেন এই উপদেশটাই সবথেকে পছন্দ হয়েছে এখানকার সালাসারবাসী হিন্দিভাষী মানুষদের।

আর উল্টোদিকে লেখা রয়েছে, ‘পানি অর উসকা বুলবুলা একই চিজ হ্যায়। বুলবুলা পানি সে বনতা হ্যায় অর পানি মো টহেলতা হ্যায়। তথা অন্ত মে ফুটকট পানি মে হি মিল জাতা হ্যায়। উসি প্রকার জীবাত্মা অর পরমাত্মা একই চিজ হ্যায়। ভেদ কেবল ইতনা হি হ্যায় কি, ইয়ে ছোটা হোনে সে পরিমিত হ্যায়। অর দুসরা অনন্ত হ্যায়। এক পরতন্ত্র হ্যায়। অর দুসরা স্বতন্ত্র হ্যায়।’ এটাও ঠাকুরের একটা বাণী, যেটা এখানে হিন্দিতে লেখা রয়েছে। ঠাকুরের মূর্তি স্থাপনা করা হয়েছে। তার পাশে আরও বেশ কয়েকটা মূর্তি স্থাপনা হয়েছে। আর তার পাশেই রয়েছে মোহনদাসজীর মূর্তি। অর্থাৎ, ‘স্থানীয় সন্ত শিরোমণি মোহনদাস। পুরে সব ভক্ত কি আশ।’ মোহনদাসজী সমস্ত ভক্তের আশা পূরণ করেন।

প্রথমে মনে হয়েছিল যে, এখানে মুসলমান সমাজ নেই। কিন্তু সকালবেলা রাজস্থান পত্রিকায় পড়ছি, হজরত মহম্মদের জন্মদিনে চুরু জেলার যেটা আসলে সদর, সেখানে বিরাট মুসলিম সমাজের শান্তিপূর্ণ শোভাযাত্রা বেরিয়েছে এবং সেখানে অনেক অনুষ্ঠান হচ্ছে। এ খবরটা ছেপেছে রাজস্থান পত্রিকার প্রথম পাতায়। সুতরাং, মুসলিম সমাজ একেবারে যে নেই, তা নয়। হয়ত সংখ্যায় কম। এখানে কোনো ভেদাভেদ নেই। ঝগড়াঝাটিরও কোনো খবর পাওয়া যায় না।

Advertisement

সালাসারের কাছেপিঠে যে গ্রাম আছে, সেই গ্রামগুলিতে প্রচুর পুরনো হাভেলি আছে। এই হাভেলিগুলো আড়াইশ বছর, তিনশ বছর, চারশ বছরের পুরনো হাভেলি পর্যন্ত রয়েছে। এই শহরে এই পুরনো হাভেলির ইতিহাসকে কেন্দ্র করে মানুষের আগ্রহ অপরিসীম। স্থানীয় মানুষেরাও এইসব হাভেলি দর্শন করতে যায়। অনেক হাভেলি আছে, যেগুলো সরকার অধিগ্রহণ করেছে। অনেকগুলো প্রাইভের ট্রাস্টে আছে। আশিটার মত এই রকম হাভেলি এখনও বেঁচে আছে। বহু হাভেলি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। তো, এই হাভেলিগুলোতে একধরনের মুরাল বা রঙের পদ্ধতি আছে, সেগুলোতে প্রাকৃতিক রঙ ব্যবহার করা হত। সেই সমস্ত প্রাকৃতিক রঙ এখনো দেওয়ালে অক্ষত রয়েছে, এত বছর পরেও। সেখানে দেখার মতো সমস্ত চিত্রকলা আছে। অনেক জায়গায় সেইসমস্ত রঙের উপরে সোনার জরির কাজ করা হত।


এখানে সুরানা কি হাভেলি, হাওয়া মহল, মামা-ভাঞ্জা কি হাভেলি, বাগলা কি হাভেলি, লোহিয়া কি হাভেলি— এগুলো খুব প্রসিদ্ধ। ধার্মিক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে প্রত্যেক বছর সালাসার বালাজিতে দেশ-বিদেশ থেকে লাখ লাখ পর্যটক আসে। এখানে বছরে দু’বার মেলা হয়। একবার চৈত্র মাসে আর একবার আশ্বিন মাসে এখানে লক্ষ্মী মেলা বলে।

বালাজি দর্শন করতে মহারাষ্ট্র, পঞ্জাব, গুজরাট, হরিয়ানা, দিল্লি, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, এমনকি কলকাতা থেকেও অনেক পর্যটক আসে। জেলার পশ্চিম প্রান্তের যে সমস্ত এলাকা, সেখানে একটা প্রসিদ্ধ কৃষ্ণ মৃগ অভয়ারণ্য আছে। সেই অভয়ারণ্যে এখনো লোকে দেখতে যায়। এই কৃষ্ণ মৃগ অভয়ারণ্যেই সলমান খান শিকার করতে গিয়ে বিপদে পড়েছিল। শীতকালে এখানে যে মেলা হয়, সেটা বরাবারই খুব মস্ত বড় মেলা হয়।

১৯৯৭ সালে একজন কালেক্টর এসেছিলেন চুরুতে। তাঁর নাম ছিল ইসি ভট্ট। তিনি একটা চুরু মহোৎসব শুরু করেছিলেন। সেই চুরু মহোৎসব খুব জনপ্রিয় হয়ে যায়। লাগাতার তিন বছর সেটা চলেছিল। পর্যটকদের আগমনে সেই চুরু উৎসব এত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে, ভাবা যায় না। সেই উৎসবটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সেটা এখন আর হয় না। তার কারণ, কোভিডের সময় সেটা বন্ধ হয়। তারপর থেকে আর ওটা চালু হয়নি।

তৎকালীন যে কালেক্টর ছিলেন, নবীন মহাজন, তিনি একবার চেষ্টা করেছিলেন আবার মেলাটা চালু করার। কিন্তু আর সফলতা পাওয়া যায়নি। তারপর থেকে এখানে চুরু উৎসবের যে পর্যটক, সেই পর্যটকের সংখ্যাটা কমে গেছে। এখনও এই এলাকায় দাবি আছে, আবার চুরু উৎসব কেন শুরু করা হচ্ছে না?

Advertisement

যাই হোক, এইটুকু বুঝলাম, এখানে ভিআইপিদের কেউ এলে সবকিছু ভুলে গিয়ে অশোক গেহলতের পেছনে দৌড়চ্ছে, এমনটা দেখলাম না। আজ আবার রাজ্যপাল কলরাজ মিশ্র— তিনি উত্তরপ্রদেশের ব্রাহ্মণ নেতা ছিলেন, যিনি এখন রাজ্যপাল, তিনি আসছেন। তিনি এখানে এসে মধ্যাহ্ন ভোজনও করবেন। পুজো দেবেন। তাঁকে কেন্দ্র করেও কোনও বিশেষ নিরাপত্তা কিছু দেখছি না। যদিও বলা হয়েছে, ওঁর কাছাকাছি কেউ যেতে পারবে না। একটা নিরাপত্তা বেষ্টনী থাকবেই। তাই বলে গোটা শহরটাকে যে স্তব্ধ করে দেওয়া, সেইরকম কোনো ব্যাপার দেখছি না। আর সেই সফরকে কেন্দ্র করে মিডিয়ারও কোনো ভিড় দেখছি না। বরং একটা জিনিস চোখে পড়ল, বিজেপি থেকে বেরিয়ে গিয়ে একজন নেতা, তিনি একটি নতুন দল করেছেন, তিনি অদ্ভুত একটা গাড়ি বানিয়েছেন। আগে যেমন গ্রামের লোকেদের সেই সার্কাস পার্টির গাড়ি বেরতো কিংবা ম্যাজিশিয়ানদের গাড়ি বেরতো, ওইরকম নানারকমের রঙ-চঙ, নানারকমের জানলা, সেখানে থেকে কেউ লোক নেই। কিন্তু ভেতর থেকে একটা মাইকে ঘোষণা হয়ে চলেছে, মুখ্যমন্ত্রী হবেন হনুমান বেলিওয়াল। রাষ্ট্রীয় লোকতান্ত্রিক পার্টি। সেই দলকে আপনি ভোট দিন।

এটা ঠিক বুঝতে পারছি না, এই পৃথক দল এবং একটা বিশেষ জাতির দল, সেইটা বিজেপি ভোট কতটা কাটবে, নাকি তাদের কী ভূমিকা হবে, সেটাও স্পষ্ট নয়। এই দলটাকে কংগ্রেস কোনভাবে মদত দিচ্ছে কি দিচ্ছে না, সেগুলোও পরে জানার চেষ্টা করব। আপাতত এটা দেখলাম, সালাসারে এই যিনি আর কী দলটা করেছেন, তিনি এখানকার স্থানীয় সাংসদ ছিলেন বিজেপির। কোনও কারণে বিজেপির সঙ্গে গোলমাল বেঁধে তিনি বিজেপি থেকে বেরিয়ে গেছেন। এই লোকটি সম্পর্কে আরও জানা প্রয়োজন।

TAGS:
Advertisement