scorecardresearch
 

TMC-র নেতা-নেত্রীদের মুখে 'জয় শ্রীরাম', BJP-র ফাঁদে পা?

প্রথমদিনে অনেকে হতচকিত হয় দেবের এহেন রামভক্তি দেখে। তবে কি এখানেই বিজেপির সাফল্য যে তাদের ফাঁদে পা দিতে বাধ্য হল তৃণমূল? হিন্দুত্ব বিজেপির কর্মসূচি; সেই কর্মসূচির জালে জড়িয়ে গেল তৃণমূল? কিন্তু পরদিন যখন দেখা গেল শতাব্দী রায় বা আরও অনেক তৃণমূল নেতা জয় শ্রীরাম ধ্বনি দিচ্ছেন, তখন মনে হচ্ছে এ তো বিজেপির ফাঁদে পা দেওয়া নয়, এ তো পাল্টা রণকৌশল। 

Advertisement
Mamata Banerjee and Jai Shree Ram Politics Mamata Banerjee and Jai Shree Ram Politics

'জয় শ্রীরাম'। এই স্লোগান- তুমি কার?
 
এ কি, বিজেপির কপিরাইট? এ কি ধর্মীয় উচ্চারণ না কি এটি দলের রাজনৈতিক কণ্ঠস্বর?

এতদিন বিজেপি নেতারা গলার শিরা ফুলিয়ে বলতেন জয় শ্রীরাম, এবার দেখা গেল ঘাটালে তৃণমূল প্রার্থী অভিনেতা দেব বলছেন জয় শ্রীরাম!

প্রথমদিনে অনেকে হতচকিত হয় দেবের এহেন রামভক্তি দেখে। তবে কি এখানেই বিজেপির সাফল্য যে তাদের ফাঁদে পা দিতে বাধ্য হল তৃণমূল? হিন্দুত্ব বিজেপির কর্মসূচি; সেই কর্মসূচির জালে জড়িয়ে গেল তৃণমূল? কিন্তু পরদিন যখন দেখা গেল শতাব্দী রায় বা আরও অনেক তৃণমূল নেতা জয় শ্রীরাম ধ্বনি দিচ্ছেন, তখন মনে হচ্ছে এ তো বিজেপির ফাঁদে পা দেওয়া নয়, এ তো পাল্টা রণকৌশল। 
 
জয় শ্রীরাম কি শুধুই বিজেপির? রাম তো সকলের, তৃণমূল নেতারা বলেন, 'জয় বাংলা'। তখন বিজেপি নেতারা বলেন, এই স্লোগান তো বাংলাদেশের। আওয়ামি লিগের হাসিনাপন্থী নেতারা মূলত এই স্লোগান দেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই স্লোগান দেবেন কেন? পরে দেখা গেল, তৃণমূলের সকল নেতা এই স্লোগান দিচ্ছেন। বলছেন, জয় বাংলা। এখন বিজেপি নেতারা যদি এ রাজ্যে এসে বলতে থাকেন জয় বাংলা, তাতে কি বিজেপি তৃণমূলের ফাঁদে পা দিয়ে দেবে? 

আরও পড়ুন

জয় শ্রীরাম স্লোগানটি অবশ্য ঠিক জয় বাংলার মন্ত্রের সঙ্গে তুলনীয় নয়। কারণ জয় শ্রীরাম ধ্বনির সঙ্গে ধর্মীয় মেরুকরণ, তা থেকে রাজনৈতিক মেরুকরণের ভাবনাও যুক্ত হয়ে আছে।  পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান জনসমাজ প্রায় ৩০ ভাগ। যেসব রাজ্যে সংখ্যালঘু মুসলমান জনসংখ্যা বেশি, সেই রাজ্যগুলোয় বিজেপির জন্য মস্ত বড় রাজনৈতিক ল্যাবরেটরি- মুদ্রার দু'টি পিঠ। এইসব রাজ্যে উগ্র-হিন্দুত্বের প্রসারের সম্ভাবনাও বেশি হয়। যেমন, অসমে বিজেপি এই ধর্মীয় তথা রাজনৈতিক মেরুকরণের সুফল পেয়েছে। সেখানে বিগত বিধানসভা নির্বাচনে মুসলিম দল গুলোর জোট শক্তিশালী হয়, ভোট তাদের পৃথক প্রতিনিধিত্বের কংগ্রেসের সাবেক মুসলমান ভোটব্যাঙ্ক ভেঙে যায়, লাভের গুড় খায় বিজেপি। হিন্দু ভোট আরও সুসংহত হয়ে যায় পুবের এই রাজ্যটিতে। হিন্দু অহমিয়া ও বাঙালি যৌথভাবে হিন্দুত্ববাদী ভোট রাজনীতিতে শামিল হয়।

Advertisement

 পশ্চিমবঙ্গেও বিজেপির গেমপ্ল্যান ছিল একই। আসাদুদ্দিন ওয়াইসি প্রথমে সচেষ্ট হন। উত্তরবঙ্গের পুর ও পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রথমে ওয়েসি তাঁর দলের প্রার্থী দেন। কিন্তু তাঁরা জিততে পারেননি। বিজেপি ও ওয়েসিস দু'পক্ষেরই মনে হয় বাংলায় উর্দুভাষী মুসলমানদের চেয়ে বাংলাভাষী মুসলিম সংখ্যায় বেশি, তারা আগে বাঙালি তারপর মুসলমান, অনেকটা বাংলাদেশের মুসলিম সমাজের মতো ।ওয়েসি তাই হায়দরাবাদে যে কৌশল নিয়েছিলেন তা পরিত্যাগ করে ফুরফুরা শরিফের সাহায্য নিয়ে গঠিত হয় 'ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট'। পীরজাদা মহম্মদ আব্বাস সিদ্দিকি এই দলের কান্ডারি। ওয়েসি নন, সিদ্দিকিই হলেন বাংলার মুসলমান সমাজের মুখ। বিজেপির অঙ্ক, শতকরা প্রায় ৩০ ভাগ ভোট যাতে মমতার তৃণমূল কংগ্রেস এককভাবে না পায়। এই ভোট যদি সিদ্দিকি অ্যান্ড কোম্পানি ভেঙে দিতে পারে তাহলেই তো মমতার লোকসান, বিজেপির লাভ। 

 ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে বিজেপির সর্বত্র জয় শ্রীরাম ধ্বনি দিতে লাগল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্ররোচিত ও উত্তেজিত করা, তাঁকে রাগিয়ে দেওয়ার কৌশল ছিল বিজেপির। মুখ্যমন্ত্রীর গাড়ির সামনে এসে জয় শ্রীরাম স্লোগান দেওয়াটা যে খুব সুস্থ রুচির পরিচায়ক, তা কেউই বলবে না। তবে বিজেপির কার্য এতে সিদ্ধ হয়েছিল। মমতা গাড়ি থেকে নেমে এই স্লোগান দেওয়ার বিরোধিতা করেন। তাঁর যুক্তি ছিল একটাই, জয় শ্রী রামের স্লোগান এভাবে দেওয়াটা হল ধর্ম বা রাম নামের রাজনৈতিক অপপ্রয়োগ। এটা মানা যাবে না। কিন্তু বিজেপির প্রচার কৌশল ছিল একথা বারংবার বলা যে, মমতা রামের নামটুকু পর্যন্ত সহ্য করতে পারছেন না। রাম নাম নেওয়ার বিরুদ্ধে এই 'সেকুলার' নেত্রী। সে বার ১৮টি আসন পায় বিজেপি। এতগুলো আসন যে বিজেপি পেতে পারে, তা প্রত্যাশা করেননি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। 

২০২১ সালে কিন্তু তৃণমূল উক্ত বছরে মমতার নিজে হয়তো জয় শ্রীরাম স্লোগান দেননি, কিন্তু কেউ এই স্লোগান দিলেও তিনি তাতে তাড়াহুড়োয় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেননি। উল্টে তৃণমূল নেতারা, এমনকী, মমতা-অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও বলেছেন, জয় শ্রীরাম নয়, জয় সিয়া-রাম। সীতার নাম-ই বা বাদ যাবে কেন? ২০২১ সালে এক জনসভায় ব্রাত্য বসু নিজেও স্লোগান দেন জয় শ্রীরাম। তাঁর বক্তব্য, রাম কি কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি? এক জনসভায় আমজনতার সামনে ব্রাত্যর ডাক, আপনারাও সবাই বলুন জয় শ্রীরাম। এবার ২০২৪ সালে তৃণমূল জয় শ্রীরামের ধ্বনি তুলে মেরুকরণের বিজেপি রাজনীতিকে আরও গুলিয়ে দিয়েছে। এখন তো দেব-সহ বহু তৃণমূল নেতাই জয় শ্রীরাম ধ্বনিতে প্রচারস্থল মুখরিত করছেন।

 আসলে তৃণমূল জয় শ্রীরাম স্লোগানের বিরোধিতা করলে বিজেপির লাভ হয়, কিন্তু তৃণমূল এই বিরোধিতা না করলে তো বিজেপিরও অসুবিধা। বিজেপি এখন কী বলছে? 

রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলছেন, রাবণও একবার গেরুয়া কাপড় পরিধান করেন। সীতা হরণের সময়। মিথ্যে সাধু সেজেছিলেন রাবণ। তৃণমূলও এখন জয় শ্রীরাম বলছে, এ হল মিথ্যে সাধুত্ব। আমরা বিজেপি জয় শ্রীরাম বলি আন্তরিকতার সঙ্গে, ওরা বলছে, বিজেপির চাপে পড়ে, রাজনৈতিক ধোঁকাবাজি দেওয়ার জন্য। এটা স্বতঃস্ফূর্ত নয়। 

রামনবমীর দিন এবার বহরমপুরে কিঞ্চিৎ গোলযোগ হলেও সেভাবে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা দেখা যায়নি। কারণ, জয় শ্রীরাম তথা হিন্দুত্ব নিয়ে এবার বিজেপি প্রণাম তৃণমূলের সেই 'তু তু ম্যায় ম্যায়' সংঘাতের রাজনীতি দেখা যায়নি। আরও বেশি সংখ্যায় হিন্দু ভোট পাওয়ার জন্য বিজেপি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে 'বেগম' ও মুসলিম ভোটের অভিভাবিকা হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছে। পাশাপাশি মমতাও হিন্দু ভোট টানতে আরও বেশি করে রাম-সীতা তথা হিন্দুত্ব তাসের সদ্ব্যবহার করেছেন। তৃণমূল ছাড়াও বিজেপি-বিরোধী শিবির সংখাগরিষ্ঠ হিন্দুত্বের দীর্ঘদিনের এই আবেগ ও ভোটকে ধরে রাখতে দৃঢ় সংকল্প। 

Advertisement

জয়রাম রমেশের মতো কংগ্রেস নেতা বলেছেন, আমার নামেও তো 'রাম' আছে। পদবী রমেশ-ও রামেরই নাম। ফটোগ্রাফারকে দেখিয়েছেন, বাড়িতে রাখা হিন্দি 'রামচরিতমানস'। তারপর বলেছেন, আমরাও রামভক্ত। তবে আমরা রামের রাজনৈতিক অপপ্রয়োগ করার বিরুদ্ধে। মমতাও ২০২৪-এর লোকসভা ভোটে রণকৌশলে রাম ও রহিম দু'পক্ষের সমন্বয় সাধন করতে বলছেন। উল্টে রাজ্য বিজেপি নেতাদের এবার ইদের উৎসবের দিন দেখা গেল, মুসলমানদের সঙ্গে উৎসব-পরব- ইফতারে যোগ দিতে। কেন? মুসলিম ভোটের আশায়, না কি বাঙালি উদার হিন্দু ভোটের কথা ভেবে যারা উগ্র-হিন্দুত্বের পক্ষে নয়,  উদার বহুত্ববাদের পক্ষে?

আসলে এক-একটা স্লোগান এক-একটা দলের অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে। একদা 'বন্দে মাতরম' মানে ছিল কংগ্রেস, 'ইনকিলাব জিন্দাবাদ' মানে বামপন্থী, 'লং লিভ নভেম্বর রেভোলিউশন' বললে কমিউনিস্টরা জনসভায় তাদের ভোটব্যাঙ্কের সঙ্গে সহজে যুক্ত হতে পারত। অরুণ জেটলি বিজেপি নেতা হলেও খুব উদারবাদী ছিলেন। তিনি একদা আমাকে বলেছিলেন, ভোপালে এক জনসভায় তিনি উন্নয়ন-সংস্কার নিয়ে অনেক কথা বললেও তেমন হাততালি পাননি, কিন্তু বক্তৃতা শেষে তিনি যখন বললেন, 'জয়শ্রীরাম' , তখন জনসভার সমস্ত কর্মী চিৎকার করে জয় শ্রীরাম বলতে লাগল। ওই যে বললাম, এক-একটা স্লোগান এক-একটা দলের স্নায়ু স্পন্দন হয়ে ওঠে। 

 বাংলায় বাঙালি রামায়ণ ও রামকে ভালবাসে, তবে জয় শ্রীরাম রাজনৈতিক স্লোগানের মাধ্যমে মেরুকরণের উগ্র-রাজনীতিতে তারা কতটা সক্রিয় তা নিয়ে আমার ঘোরতর সন্দেহ আছে।

Advertisement