জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেম কি এক? ঠিক এই প্রশ্নটাই ওঠে, যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয়তাবাদ নিয়ে কথা হয়। আসলে দেশপ্রেম হল, একটি অনুভূতি। তিনি মনে করতেন, জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেম এক নয়। রবীন্দ্রনাথের জীবনে বারবার আমরা দেখেছি, দেশপ্রেম ফুটে উঠেছে। যা জাতীর ঊর্ধ্বে।
রবীন্দ্রনাথ নিজের জাতীয়তাবাদ নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি, তিনি তাঁর জাতীয়তাবাদী ভাবনায় সমগ্র ভারতবাসীকে উজ্জীবিত করেছেন এবং আজও করছেন। তবে রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদী যেমন সত্য, একই সঙ্গে তিনি আন্তর্জাতিকতাবাদীও। তিনি উগ্র জাতীয়তাবাদকে প্রশ্রয় দেননি। কারণ, এর ভয়াবহতা তিনি জানতেন।
রবীন্দ্রনাথের মতে জাতির ধারণা সম্পূর্ণ আধুনিক ও পশ্চিমি। কবির মত ছিল, যে কোনও সমাজ যখন নিজেকে শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণে মরিয়া হয়ে ওঠে, অপরের উপর বল প্রয়োগ শুরু করে, তখনই তা মানবজাতির পক্ষে ক্ষতিকর হয়। কারণ মানুষ তখন ক্ষমতাকেই অগ্রাধিকার দিতে শুরু করে ও আধুনিক হওয়ার চরম নেশায় মত্ত হয়ে যান্ত্রিক হয়ে ওঠে। এর দ্বারা সমাজের মানবিক দিক অবলুপ্ত হতে থাকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখছেন 'যখন সংগঠনরূপী ইঞ্জিন বিশাল আকার গ্রহণ করে এবং যন্ত্রকুশলীরা যন্ত্রের অংশবিশেষে পরিণত হয়, তখন ব্যক্তি মানুষ শূন্যে বিলীন হয়ে যায়।' বোঝাই যাচ্ছে, উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরোধী ছিলেন রবি ঠাকুর।
তিনি মনে করতেন, জাতীয়তাবাদ উগ্র দেশপ্রেমের নামে বিচ্ছিন্নতাবাদকে প্রশ্রয় দেয়। ঠিক সেই কারণেই তিনি তাঁর বাল্যবন্ধু এএম বসুকে চিঠিতে লিখছেন, 'Patriotism cannot be our final spiritual shelter. I will not buy glass for the price of diamonds and I will never allow patriotism to triumph over humanity as long as I live'.
বস্তুত, 'গোরা', 'ঘরে বাইরে', 'চার অধ্যায়'-- তিন উপন্যাসে দেশপ্রেম নস্যাত্ করেছে উগ্র জাতীয়তাবাদকে। রবি ঠাকুর লিখছেন, 'বিশ্ব-মানবের প্রতি ভালোবাসা-বোধের বিপরীতে দাঁড়িয়ে যেমন কিনা প্রকৃত দেশপ্রেমের নিখুঁত স্ফুরণ ঘটতে পারে না, ঠিক তেমনি প্রগাঢ় দেশপ্রেমকে উপেক্ষা করে সত্যিকার মানবপ্রেম জাগরিত হতে পারে না।'
রবীন্দ্রনাথ তাঁর নেশন প্রবন্ধে লিখছেন, নেশন মানুষের মস্তিষ্কপ্রসূত, ইতিহাস থেকে জাত। তা কোন ভূখণ্ড, ভাষা ও ধর্মীয় ঐক্য গড়ে তোলার উপায় নয়। নেশন একটি সজীব সত্তা, যা অতীতের স্মৃতিকে সম্মান জানিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয় এবং নিজেদের উত্তরাঝিকারকে রক্ষা করে।
তথ্যসূত্র: নেশন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর