বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর যাত্রীদের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে বন্ধ করে দেওয়া হয় বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে চলাচলকারী মৈত্রী, বন্ধন, মিতালী এক্সপ্রেস সার্ভিস। পাঁচ মাস বন্ধ থাকার পর বাংলাদেশ থেকে ভারতের মাটিতে ফিরল মিতালি এক্সপ্রেস। বাংলাদেশের ইঞ্জিন ট্রেনের কামরাগুলিকে সীমান্ত পার করে ভারতে নিয়ে আসে। হলদিবাড়ি স্টেশনে পৌঁছানোর পর সেই ইঞ্জিন ফিরে যায় বাংলাদেশে। এরপর হলদিবাড়ি থেকে ফাঁকা কামরাগুলিকে ইঞ্জিনের সাহায্যে নিয়ে আসা হয় নিউ জলাপাইগুড়ি স্টেশনে। এই প্রসঙ্গে হলদিবাড়ি স্টেশনের স্টেশন মাস্টার অমিত তেওয়ারি সংবাদ মাধ্যমকে জানান, ট্রেনের কামরাগুলি এসেছে। ট্রেনের সব কামরাই অক্ষত রয়েছে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক হিংসার প্রভাব পড়েনি কোনও কামরায়।
দীর্ঘ ৬ মাস পর ভারত ফিরল মিতালী এক্সপ্রেস , যা ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ট্রেন হিসেবে পরিচিত। গত মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর, কোচবিহার জেলার হলদিবাড়ি স্টেশনে ফিরে আসে এই ফাঁকা ট্রেনটি। গত ১৭ জুলাই ছিল মিতালী এক্সপ্রেসের শেষ যাত্রা, তারপর থেকেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে ট্রেনটি আর চলাচল করেনি। বিশেষ করে, কট্টরপন্থী মৌলবাদীদের তাণ্ডব এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার কারণে ট্রেনটি বন্ধ হয়ে যায়। তবে এবার, দুই দেশের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের বৈঠকের পর মিতালী এক্সপ্রেস আবার ভারতে ফিরে এসেছে, যা ভারতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। প্রসঙ্গত, মিতালি এক্সপ্রেসের রুট ছিল নিউ জলপাইগুড়ি থেকে ঢাকা স্টেশন পর্যন্ত।
জুলাইতে ঢাকায় সরকার পতনের পর ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাস পরিষেবা কিছুদিন বন্ধ থাকার পর তা-ও সচল হয়েছে। কলকাতা বা দিল্লির সঙ্গে আকাশপথে পুনর্বহাল গিয়েছে ঢাকা বিমানবন্দরের যোগযোগও। এমনকি মহম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার পুজোর আগে ইলিশও পাঠিয়েছিল ভারতে। কিন্তু কোনো অজ্ঞাত কারণে দু'দেশের রেল যোগাযোগ পরিষেবা স্তব্ধ! ১৯ জুলাই থেকে বন্ধ কলকাতা-ঢাকা মৈত্রী এক্সপ্রেস। ২০ জুলাই থেকে বন্ধ কলকাতা-খুলনা বন্ধন এক্সপ্রেস। বাংলাদেশ রেলওয়েজের অনুরোধে জুলাই মাসে এই দুটি রুটে ট্রেন বন্ধ হয়েছিল। ফলে অসুবিধায় পড়েছেন দুই দেশের সাধারণ নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্ত মানুষ, যাঁদের চাইলেই বিমানে সফর করার সঙ্গতি নেই, এদিকে বাসযাত্রা রোগীদের ক্ষেত্রে কষ্টকর। ২১ নভেম্বরে এ বিষয়ে এসেছিল নতুন বিজ্ঞপ্তি। যাতে জানা গিয়েছিল, রেক ফিরলেই চলবে ট্রেন।
প্রসঙ্গত, প্রতিদিন বাংলাদেশ থেকে কয়েক হাজার মানুষ ট্রেনে কলকাতায় আসতেন কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে। সমান্তরাল এক 'মেডিক্যাল ট্যুরিজম' তৈরি হয়ে উঠেছিল ইস্টার্ন বাইপাস-লাগোয়া একাধিক বেসরকারি হাসপাতাল জুড়ে। পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ হল রেলের আর্থিক ক্ষতির বিষয়টি। কলকাতা টার্মিনালে ইমিগ্রেশন কাউন্টার স্ক্যানার-সহ সমস্ত পরিকাঠামো মাসের পর মাস পড়ে রয়েছে। অথচ বন্ধন এবং মৈত্রী এক্সপ্রেস খাতে ট্রেন পিছু ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় লক্ষ টাকার টিকিটের দাম প্রতিদিন ফেরত দিয়ে চলেছে রেল। এই পরিস্থিতিতেই বাংলাদেশ থেকে মিতালী এক্সপ্রেসের ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশ করার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
চারটি বাতানুকূল এগজ়িকিউটিভ কামরা, চারটি বাতানুকূল চেয়ার-কার ছাড়াও ব্রেকভ্যান ও পাওয়ার কার মিলিয়ে মোট ১০-কামরার মিতালী এক্সপ্রেস নিউ জলপাইগুড়ি (এনজেপি) থেকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট পর্যন্ত যাতায়াত করে। কামরাগুলি ভারতীয় রেলের। ট্রেনটির জন্য একটিই রেক বরাদ্দ রয়েছে। চিলাহাটি জ়িরো পয়েন্ট থেকে বাংলাদেশের ইঞ্জিন যাত্রিবাহী ট্রেনটিকে বয়ে নিয়ে যায় সে দেশের গন্তব্য-স্টেশন অবধি। মিতালী এক্সপ্রেস ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। এটি দুই দেশের মধ্যে পরিবহন ও বাণিজ্যের উন্নতির পাশাপাশি সাংস্কৃতিক বিনিময়ের সেতুবন্ধনও সৃষ্টি করে। এই ট্রেনটির চলাচল আবার শুরু হওয়ায় দুই দেশের সম্পর্কের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
মিতালী এক্সপ্রেসে সাধারণত ব্যবসায়ী, পর্যটক, এবং বিভিন্ন কাজে যাতায়াতকারী যাত্রীরা বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে চলাচল করেন। এই ট্রেনের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হয়, বিশেষত ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সাংস্কৃতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে। গত ৬ মাসে এই সেবা বন্ধ থাকায়, উভয় দেশের মধ্যে যোগাযোগ কিছুটা কমে গিয়েছিল। তবে, মিতালী এক্সপ্রেসের ফিরে আসা এক নতুন আশার সঞ্চার করেছে, যা দুই দেশের মধ্যে পুনরায় সম্পর্ক জোরদার করতে সাহায্য করবে।
অন্যদিকে, ভারতীয় রেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, মিতালী এক্সপ্রেসের বগিগুলির পুরোপুরি পরীক্ষা করা হয়েছে এবং কোনও ক্ষতির কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ সঠিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে, যাতে ভবিষ্যতে ট্রেনটি আরও নিরাপদভাবে চলাচল করতে পারে। তবে, এটি স্পষ্ট যে, এখনও পর্যন্ত মিতালী এক্সপ্রেসের ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনও নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। পরে এই ট্রেনের পুনরায় চালু হওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।