হাওয়ায় দুলছে কাশফুল। নীল আকাশে মাঝে মধ্যেই উঁকি মারছে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ (যদিও আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনায় সবসময় সেটা দেখারও জো নেই)। পাড়ায় পাড়ায় বাঁশের মণ্ডপে খুটখাট আওয়াজ। কুমোরপাড়ায় দম ফেলার সময় নেই। কারণ উমা আসছেন...
হাতে আর মাত্র কয়েকটা দিন। তারপরেই বাজবে ঢাক। আবাহন করা হবে মা দুর্গাকে। বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবকে ঘিরে প্রতি বছরই মনের কোণায় 'পুজো আসছে, পুজো আসছে' বলে যে উত্তেজনা তৈরি হয়, সেই উন্মাদনা যেন এ বার একেবারেই ফিকে। 'পুজো বলে যেন মনেই হচ্ছে না' ধরনের অনুভূতি দানা বেঁধেছে বহু মানুষের হৃদয়েই। কলকাতার চিরাচরিত পুজোর মার্কেটিংয়ের কেন্দ্রস্থল শ্যামবাজার-হাতিবাগান কিংবা গড়িয়াহাট যেন এবার অনেকটাই খাঁ খাঁ করছে। পুজোর শপিংয়ে কারওরই তেমন খুব একটা উৎসাহ নেই। অনেকেই কিনছেন বটে, তবে পুজোর কেনাকাটা করার মধ্যে যে বাড়তি আনন্দ চোখেমুখে থাকে, তা এবার বড্ড ফিকে। দুর্গাপুজোর মতো আনন্দোৎসবের চেনা ছবিটা এবার এক লহমায় বদলে দিয়েছে ৯ অগাস্টে আরজি কর মেডিক্যালের সেই শিউরে ওঠা ঘটনা। তিলোত্তমার বিচার চাইছেন সকলে। প্রতিবাদ চলছে...জনতা বলছে, 'পুজোয় আছি, উৎসবে নেই'।
দুর্গাপুজোর আগে বাঙালি মনকে এভাবে নাড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা এই প্রথম নয়। ঠিক ৪৬ বছর আগে পুজোর আনন্দ নিমেষেই ফিকে হয়ে গিয়েছিল। সালটা ১৯৭৮। পুজোর একেবারে মুখে ভয়াবহ বন্যায় ডুবে গিয়েছিল বাংলার একাংশ। মৃত্যু, অনাহার মিলিয়ে সে বছর গ্রামগঞ্জের অনেক এলাকাতেই দেবীর বোধন হয়নি। কলকাতায় পুজো হলেও তা নমো নমো করেই সারা হয়েছিল। ছিল না সেই চেনা আড়ম্বর।
১৯৭৮ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর। সেদিন বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। টানা ৩ দিনের রেকর্ড বৃষ্টিতে দক্ষিণবঙ্গের অধিকাংশ জেলা ডুবে গিয়েছিল। ওই বছর সেপ্টেম্বরে বৃষ্টি হয়েছিল ৯৪৪.৭ মিমি। নাগাড়ে বৃষ্টি, নদী বাঁধে ভাঙন, ডুবে গিয়েছিল বাংলা। বাদ যায়নি কলকাতাও।
মহানগরীর রাজপথ যেন নদীর চেহারা নিয়েছিল। বালিগঞ্জ স্টেশনের কাছে নৌকা চলেছিল। গড়িয়াহাটের চারপাশের রাস্তা জলের তলায়। লেকটাউন, শ্রীভূমিতে কোমর সমান জল। সকলে ঘরবন্দি। জলবন্দি মানুষের সে কী অসহায় চেহারা!
গ্রামের ছবিটা ছিল আরও করুণ। বন্যার গ্রাসে পড়েছিল ১৬টি জেলা। মেদিনীপুর, হাওড়া, হুগলি, বাঁকুড়া, নদিয়া, মুর্শিদাবাদ জেলা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। লক্ষ লক্ষ মানুষ বন্যার কবলে পড়েছিলেন। কেউ বাড়ির ছাদে কোনওরকমে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আবার কেউ গাছে উঠে কোনওরকমে নিজেকে বাঁচিয়েছিলেন। বহু মানুষের মৃত্যুও হয়েছিল। যে দিকে চোখ যায়, শুধুই জল আর জল। সে এক অভিশপ্ত সময়ের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে বাংলা।
সেপ্টেম্বরের শেষে ভয়ঙ্কর বন্যার গ্রাসে যখন বাংলা, তার ক'দিন বাদেই ছিল দুর্গাপুজো। ১ অক্টোবর ছিল মহালয়া। কিন্তু প্রকৃতির রোষে সে বার পুজোর আনন্দ যেন বিষাদে পরিণত হয়েছিল। বহু গ্রামেই সে বার পুজো করা যায়নি। যেখানে বা পুজো হয়েছে তা-ও নাম কা ওয়াস্তের মতোই। অনেকটা নিয়মরক্ষার্থে।
৪৬ বছর পর বাঙালি মনে দুর্গাপুজোর সেই উৎসাহ আবার ফিকে হয়ে গেল। এবার অবশ্য প্রকৃতির দোষ নয়। দোষটা 'ম্যান মেড'। ধর্ষণ-খুনের মতো ঘটনায় বিচার চেয়ে পথে জনতা-জনার্দন। মা দুর্গার কাছে যেন একটাই প্রার্থনা, 'মেয়েটার বিচার হোক'। বহু পুজো কমিটিই রাজ্য সরকারের অনুদান ফিরিয়ে দিয়েছে। আবার অনেকেই জাঁকজমক ছাড়াই পুজোর আয়োজন করছেন। এ বছর ভবানীপুরে মল্লিক বাড়ির পুজোর ১০০ বছর। শতবর্ষের পুজোয় এলাহি আয়োজনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি সব বদলে দিয়েছে। মল্লিকবাড়ির সদস্য তথা টলিপাড়ার কোয়েল মল্লিক জানিয়েছেন, এবার পুজো দেখার জন্য সাধারণ মানুষের জন্য তাঁদের বাড়ির দরজা বন্ধ থাকবে। পরিবারের মধ্যেই আড়ম্বরহীন ভাবে দেবীর আরাধনা করা হবে।
এবারও পুজোর মুখে দক্ষিণবঙ্গের কয়েকটি জেলায় বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। টানা বৃষ্টি আর ডিভিসির ছাড়া জলে এবারও বহু এলাকা প্লাবিত। আরজি করকাণ্ডের পাশাপাশি এই দুর্যোগে সেসব এলাকাতেও উৎসবের ছবি পাল্টে গিয়েছে।
৪ বছর আগে করোনা অতিমারির সময়ও পুজোর আনন্দে খানিকটা ভাঁটা পড়েছিল ঠিকই। তবে সে বার মানুষের মনে করোনা নামক ভাইরাসের ভয় ছিল, কিন্তু পুজো ঘিরে উৎসাহকে টলাতে পারেনি মারণ ভাইরাস। তাই অনেকেই মাস্ক পরে মণ্ডপে ভিড় জমিয়েছিলেন। যদিও ভিড় করে প্রতিমা দর্শনে নিষেধাজ্ঞা ছিল। তবে জনমানসে পুজোর সেই উদ্দীপনার ছবিটা অটুট ছিল। ২০০৭ সালে পুজোর আগে আগেই রিজওয়ানুরকাণ্ড ঘটেছিল। সে বছরও প্রতিবাদ-আন্দোলনে গর্জে উঠেছিল শহর। তবে ১৯৭৮ সালের পর বহু বছর বাদে এবার পুজো ঘিরে বাংলার আকাশে-বাতাসে যেন সেই চেনা আনন্দধারা বইছে না। কেউই আর গাইছেন না, 'আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে'। বরং ধ্বনিত হচ্ছে 'উই ওয়ান্ট জাস্টিস'।