রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনের দুটি বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চল দোনেস্ক এবং লুহানস্ককে স্বাধীন অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে উত্তেজনা আরও বেড়েছে। রাশিয়া ইউক্রেনের সীমান্তে দেড় লাখের বেশি সেনা মোতায়েন করেছে, যা নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো বলছে, রাশিয়া যে কোনও সময় ইউক্রেনে হামলা করতে পারে। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন বলেছেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শুরু হতে পারে।
যদিও রাশিয়ার দাবি, তাদের আক্রমণ করার কোনও পরিকল্পনা নেই। এবং তার বাহিনী ন্যাটোর বিস্তার থেকে দেশকে রক্ষা করতে ইউক্রেন সীমান্তে রয়েছে। এদিকে পুতিনের এই ঘোষণা আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলোকে বেশ উদ্বেগের মধ্যে ফেলেছে। আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলোও রাশিয়ার উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা করেছে। এখন কোন দেশ, কোন দিকে তা নিয়েও বিতর্ক তীব্র হয়েছে। ভারত কাকে সমর্থন করবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া উভয়েরই নজর সেদিকে। তবে ভারত এখনও পর্যন্ত এই ইস্যুতে তার নিরপেক্ষতা বজায় রেখেছে।
আরও পড়ুন : 'অবিলম্বে ফিরে আসুন,' ইউক্রেনে ভারতীয় পড়ুয়াদের বার্তা কেন্দ্রের
ইউক্রেন ইস্যুতে প্রধান দেশগুলোর অবস্থান কী?
ভারত-
ভারত আমেরিকা এবং রাশিয়া উভয়ের কাছাকাছি। আমেরিকা চায় ভারত সমর্থন করুক কিন্তু ভারতের কৌশলগত অংশীদারিত্ব রাশিয়ার সঙ্গে বেশি। প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের জন্য রাশিয়ার উপর ভারতের নির্ভরতা রয়েছে। এখানে চিনের সঙ্গে সীমান্তে উত্তেজনার মধ্যেও ভারতের জন্য রাশিয়ার সমর্থন জরুরি। এমন পরিস্থিতিতে ভারতের পক্ষে কারও পক্ষ নেওয়া খুবই কঠিন হবে। ভারত এখনও পর্যন্ত নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছে। মঙ্গলবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইউক্রেনের পরিস্থিতি নিয়ে জরুরি বৈঠকে ভারত ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান নিয়েছে এবং বলেছে যে এই বিষয়ে সব পক্ষেরই সংযম ব্যবহার করা উচিত।
জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি টিএস তিরুমূর্তি ভারতের অবস্থান স্পষ্ট করে বলেছেন, "ভারত চায় ইউক্রেন-রাশিয়া সীমান্ত উত্তেজনা অবিলম্বে হ্রাস হোক এবং সমস্ত দেশের বৈধ নিরাপত্তা স্বার্থ অক্ষুণ্ণ থাকুক।" তিনি জানান, কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। সাম্প্রতিক সময়ে উত্তেজনা প্রশমনে উভয় পক্ষের উদ্যোগ নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংও ইউক্রেন-রাশিয়া ইস্যু নিয়ে বলেছেন, ভারত চায় আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হোক। রাজনাথ সিং আশা প্রকাশ করেছেন, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে কোনও না কোনও সমাধান নিশ্চয় বেরিয়ে আসবে।
আমেরিকা-
আমেরিকা প্রথম থেকেই ইউক্রেন সীমান্তে রুশ বাহিনী জমায়েতের বিরোধিতা করে আসছে। আমেরিকা প্রথম থেকেই দাবি করে আসছে, রাশিয়া যে কোনও সময় ইউক্রেনে হামলা চালাতে পারে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ইউক্রেনের দুটি বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চলকে স্বাধীন ভূখণ্ড হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ায় রাশিয়ার উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। জো বাইডেন রাশিয়ার দুটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ভিইবি এবং রাশিয়ান মিলিটারি ব্যাংককে নিষিদ্ধ করেছেন। বাইডেন ঘোষণা করেছেন, রাশিয়ার অর্থনীতির কিছু অংশ আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থা থেকে সরানো হচ্ছে। এর পাশাপাশি রাশিয়ার ধনী ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে আমেরিকা।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন -
ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট চার্লস মাইকেল ইউক্রেনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে জানিয়েছেেন, ইউক্রেনের বিরুদ্ধে হুমকি সমগ্র ইউরোপের জন্য হুমকি। ইউনিয়নের তরফে রাশিয়ার ব্যাংক এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের আর্থিক বাজারে রাশিয়ার প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নও রাশিয়াকে বৈশ্বিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে বাদ দিতে পারে।
ব্রিটেন-
ব্রিটেন জানিয়েছে, ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরু হয়েছে এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করা হবে। প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন, রাশিয়ার পদক্ষেপ ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করবে।
আরও পড়ুন : Impact of Russia Ukraine Crisis: রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ হলে ভারতে কোন কোন জিনিসের দাম বাড়বে?
চিন-
সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়া ও চিনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে এবং আমেরিকার সাথে চিনের সম্পর্ক খারাপ অবস্থায় পৌঁছেছে। কিছুদিন আগে চিনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই রাশিয়ার নিরাপত্তা উদ্বেগকে ন্যায্যতা দিয়ে বলেছিলেন, গোটা বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা দরকার। রাশিয়া চায় না ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগদান করুক, তবে আমেরিকা, পশ্চিমা দেশ এবং ইউক্রেন নিজেও চায় ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হোক। এ নিয়ে উত্তেজনা বেড়েছে। রাশিয়ার এই নিরাপত্তা উদ্বেগের কথা উল্লেখ করে চিন বলেছে, রাশিয়ার উদ্বেগ বিবেচনায় নেওয়া উচিত। চিনের পক্ষ রাশিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে, তবে এখন পর্যন্ত চিন রাশিয়ার সাম্প্রতিক পদক্ষেপকে সমর্থন করেনি। চিনও ভারতের মতো ভারসাম্যপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছে। তবে বলা হচ্ছে, চিন জাতিসংঘ বা অন্যান্য ফোরামে রাশিয়াকে সমর্থন করতে পারে।
ফ্রান্স -
রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট পুতিন সোমবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ইউক্রেনের দুটি অঞ্চলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। পুতিনের সম্বোধনকে 'পাগলামি' বলে অভিহিত করেছে ফ্রান্স। ফ্রান্স বলেছে যে রুশ প্রেসিডেন্ট ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে এবং এখন ফ্রান্স রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে।
রাশিয়ার উপর ইউরোপীয় ইউনিয়নের আরোপিত নিষেধাজ্ঞাকে স্বাগত জানিয়েছে ফ্রান্সও। ম্যাক্রোঁ ক্রমাগত বলে আসছেন যে ইউক্রেনে হামলা চালালে রাশিয়াকে বড় মূল্য দিতে হবে।
জার্মানি -
জার্মানি রাশিয়ার নর্ড স্ট্রিম 2 গ্যাস পাইপলাইন বন্ধ করে দিয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে জার্মানিতে গ্যাস পৌঁছে দিতে যাচ্ছিল রাশিয়া। রাশিয়ার সাম্প্রতিক পদক্ষেপের পরিপ্রেক্ষিতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে জার্মানি। জার্মানি প্রথম থেকেই ইউক্রেনের পাশে দাঁড়িয়েছে।
বেলারুশ -
বেলারুশ রাশিয়ার খুব ঘনিষ্ঠ ছিল। রাশিয়া-ইউক্রেন উত্তেজনা চরমে এবং যে কোনও সময় যুদ্ধ শুরু হতে পারে, বেলারুশ রাশিয়ার সঙ্গে সামরিক মহড়া চালাচ্ছে। ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া সামরিক মহড়াটি ২০ ফেব্রুয়ারি শেষ হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু এখন এটি আবার বাড়ানো হয়েছে এবং উভয় দেশের সেনাবাহিনী ইউক্রেনের সীমান্তের কাছে সামরিক মহড়া চালাচ্ছে।
আরও পড়ুন : Russia-Ukraine Conflict: কেন ইউক্রেন দখল করতে চায় রাশিয়া? ঠিক কী নিয়ে অশান্তি?
বেলারুশ সোমবার বলেছে যে ন্যাটো প্রত্যাহার করলে রুশ বাহিনী তার ভূখণ্ড ছেড়ে যাবে। ন্যাটো দেশ পোল্যান্ড, লাটভিয়া এবং লিথুয়ানিয়া বেলারুশের সাথে সীমানা ভাগ করে, যেখানে ন্যাটো বাহিনী মোতায়েন করেছে।
ইতালি- ইতালি বলেছে, তারা ন্যাটো সম্পর্কিত প্রতিশ্রুতি বজায় রাখবে।
ক্রোয়েশিয়া-
ক্রোয়েশিয়াও এই ইস্যুতে রাশিয়ার পক্ষ নিয়েছে। ক্রোয়েশিয়া বলেছে যে রাশিয়ার নিরাপত্তা উদ্বেগ বিবেচনা করা প্রয়োজন। কিছুদিন আগে ক্রোয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোরান মিলানোভিচ বলেছেন, রাশিয়ার সঙ্গে বিরোধ বাড়লে তিনি রাশিয়াকে নয়, বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ ইউক্রেনকে সমর্থন করবেন না। তার বক্তব্য নিয়ে যখন দেশে তোলপাড় শুরু হয়েছিল, তখন প্রধানমন্ত্রী আন্দ্রেজ প্ল্যাঙ্কোভিচকে তা খণ্ডন করতে হয়েছিল। তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে তিনি ইউক্রেনের জনগণের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। একই সঙ্গে তিনি এ কথাও স্মরণ করেন যে, ক্রোয়েশিয়া যখন যুগোস্লাভিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিল, তখন প্রথম ইউক্রেনকে স্বীকৃতি দিয়েছিল।
জাপান -
জাপান বলেছে, রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা করলে আমেরিকাকে সমর্থন দেবে। প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা রাশিয়ার সাম্প্রতিক পদক্ষেপের নিন্দা করে বলেছেন, এটি আন্তর্জাতিক আইন এবং ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন।
আরও পড়ুুন : Russia Ukraine Crisis: ইউক্রেন নিয়ে ঘোষণা করে বিপাকে পুতিন? মার্কিন তত্পরতা শুরু
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো-
রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে তা মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশেই গভীর প্রভাব ফেলবে। এসব দেশে মূল্যস্ফীতি বাড়বে, যার কারণে দেশগুলোতে উত্তেজনা ও হিংসা বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। এতে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাও সৃষ্টি হতে পারে। ন্যাটোর সদস্য তুরস্কও রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ। তবে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান রাশিয়ার সাম্প্রতিক পদক্ষেপকে অগ্রহণযোগ্য বলেছেন। তিনি বলেছেন, সব পক্ষকে আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলতে হবে। তুরস্ক পশ্চিমা দেশগুলোর সমালোচনাও করেছে যে তারা এই সংকটকে সঠিকভাবে মোকাবেলা করতে পারছে না। একই সঙ্গে আমেরিকার সঙ্গে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রভৃতি দেশের নৈকট্য বাড়লেও রাশিয়ার সঙ্গেও তাদের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। অতএব, এই দেশগুলির পক্ষে কারও পক্ষ নেওয়া কঠিন হবে।