মাদক নিয়ন্ত্রক আইনের অধীনে আপাতত পুলিশের জালে বাংলাদেশের চর্চিত অভিনেত্রী পরীমনি। আপাতত জেলেই কাটছে তার দিনি। আগের দফায় আদালতে হাজির করা হলে কাঠগড়ায় পুরোটা সময় পরীমনি ছিলেন নিশ্চুপ। কিন্তু গতকাল (মঙ্গলবার) ফের আদালতে তোলা হলে তাঁকে কান্নাকাটি করতে দেখা যায়।
পরীমনিকে আদালত থেকে বের করার সময় তিনি সাংবাদিকদের উদ্দেশে হাত নেড়ে বলতে থাকেন, ‘সাংবাদিক ভাইয়েরা, আপনারা তদন্ত করেন, আমাকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে। আপনারা সাংবাদিক কী করছেন।'
মঙ্গলবার পরীমনিকে দেখতে থানায় হাজির হয়েছিলেন তাঁর দাদু শামসুল হক গাজী। শতায়ু শামসুল দাবি করেন, পরী নিজের জন্য জীবনে কিছু করেনি। সব মানুষের জন্য দান করেছে। এখন পরিস্থিতির শিকার হয়ে গেছে। নিজে একটা ফ্ল্যাট পর্যন্ত করেনি। সব মানুষের জন্য বিলিয়ে দিয়েছিল। পরীমনি খুব ছোটবেলায় তার মাকে হারান। একটু বড় হয়ে বাবাকে হারিয়ে পিরোজপুরে এই দাদুর কাছেই বড় হন।
এদিকে মাদকের মামলা তদন্তাধীন থাকায় বিতর্কিত পরীমনির সদস্যপদ স্থগিত করেছে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি। সদস্যপদ স্থগিত হওয়ায় আপাতত পরীমনি সমিতির কোনো কাজে অংশ নিতে পারবেন না।
গত ৪ অগাস্ট পরীমনির বনানীর বাড়িতে অভিযান চালায় র্যাব। পরীমনির সঙ্গে তার সহযোগী আশরাফুল ইসলাম দীপুকেও সেদিন গ্রেফতার করা হয়। র্যাবের দাবি পরীমনির বাড়ি থেকে ১৮.৫ লিটার বিদেশি মদ, চার গ্রাম আইস, এক স্লট এলএসডি এবং একটি পাইপ উদ্ধার করা হয়।
পরীমনির বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের যে ধারায় মামলা হয়েছে, তাতে একটি ধারায় অপরাধের বর্ণনা অনুযায়ী তার সর্বনিম্ন এক বছর থেকে ৫ বছর সাজা হতে পারে। আরেকটি ধারা অনুযায়ী, ৬ মাস থেকে এক বছর সাজা হতে পারে। নায়িকার বিরুদ্ধে করা এ মামলায় অপরাধ প্রমাণ হলে, সে অনুযায়ী তিনি এই শাস্তি পাবেন।
পরীমনিকে নিয়ে এখন জোর চর্চা চলছে বাংলাদেশে । দাবি করা হচ্ছে, কেবল মাদক নয়, বাংলাদেশের একাধিক উচ্চবিত্তের শারীরিক চাহিদা নাকি মেটাতে হয়েছে পরীমণিকে। কাটাছেঁড়া চলছে তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও। পরীমনি নাকি অন্ধকার জগতে পা বাড়িয়েছিলেন, এমনটাই দাবি করছেন তদন্তকারী আধিকারিকরা।
এই অবস্থায় পরীমনির পক্ষে দাঁড়ানোর লোকের বড় অভাব বাংলাদেশে। তাও স্রোতের বিপরীতে যারা হেঁটে এই মামলায় পরীর হয়ে কথা বলেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম তসলিমা। পরীমনির গ্রেফতারির পর থেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় বারবার সরব নারীবাদী তসলিমা নাসরিন। পরীকে মিথ্যে মামলায় ফাঁসান হয়েছে। পরীমনিকে ধ্বংস করতেই ষড়যন্ত্র হচ্ছে, নিজের সোশ্যাল পোস্টে এমনটাই লিখেছেন তসলিমা।
বাংলাদেশ জুড়ে পরীমনির জীবনযাত্রা নিয়ে যখন চলছে জোর চর্চা, সেই পরিস্থিতিতে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানের রচয়িতা তথা প্রখ্যাত লেখক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট আব্দুল গফ্ফর চৌধুরীও পাশে দাঁড়িয়েছেন অভিনেত্রী পরীমনির।
অভিযুক্ত অভিনেত্রীর হয়ে বছর ৮৬-র এই লেখক-সাংবাদিক বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আবেদন করেছেন। পরীমনির সঙ্গে যা করা হচ্ছে, তাকে সংশ্লিষ্টদের ক্ষমতার অপব্যবহার বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। তাঁর মতে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে যেহেতু নারীর ক্ষমতায়ন শুরু হয়েছে, সেজন্যই তাঁর প্রতি এই আবেদন রেখেছেন তিনি।
বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে পাঠানো আবেদনে তিনি লিখেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে এই আবেদন আমার একার নয়। দেশে প্রশাসন, একটি বিত্তশালী গোষ্ঠী এবং একটি মিডিয়া গোষ্ঠী মিলে একটি ২৮ বছরের তরুণীকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করার যে ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে, সে সম্পর্কে সচেতন নাগরিক সমাজের আবেদন। পরীমনিকে গ্রেফতার করার জন্য দু’-চার জন র্যাব কিংবা পুলিশের সদস্য গেলেই হত, সেখানে যে যুদ্ধযাত্রা করা হয়েছিল, তাতে মনে হয়েছিল কোনও ভয়ঙ্কর ডাকাতকে গ্রেফতারের জন্য এই যুদ্ধযাত্রা'। পাশাপাশি অভিযোগ পত্রে তিনি আরও লেখেন, গ্রেফতারের পর থেকেই পরীমনির বিরুদ্ধে একটার পর একটা অপপ্রচার ছড়ানো হচ্ছে। বোঝাই যায়, কোনও একটি মহল থেকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই অপপ্রচার করা হচ্ছে। অর্থাৎ বিচারের আগেই বিচার।
গত জুন মাসে আশুলিয়ার বোট ক্লাবকাণ্ডে আলোচনায় আসেন পরীমনি। সেসময় তিনি ব্যবসায়ী নাসির ইউ আহমেদ-সহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্তার অভিযোগ করেন। সেই অভিযোগ তিনি ফেসবুক লাইভে এসেও জানান। এরপর সাভার থানায় ধর্ষণেরচেষ্টা ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলা করেন। পরীমনির করা মামলায় বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও উত্তরা ক্লাবের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট নাসির ইউ মাহমুদ-সহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। যদিও পরে ধৃতরা সকলেই জামিন পেয়ে যান। সেই ঘটনায় মুখ খোলায় পরীমনিকে চক্রান্তের শিকার হতে হচ্ছে কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন বিশিষ্ট জনদের একাংশ।
সিটি ব্যাঙ্কের এমডি মাসরুর আরেফিন পরীমনিকে সাড়ে তিন কোটি টাকার গাড়ি উপহার দিয়েছিলেন। এমন খবর প্রকাশ পেয়েছিল সংবাদমাধ্যমে। যদিও তা অপপ্রচার বলে স্বয়ং দাবি করছেন আরেফিন। সিটি ব্যাঙ্কের এমডি মন্তব্য করেছেন, পরীমনিকে নিয়ে যা চলছে তা একটা রীতিমত সার্কাস। মঙ্গলবার রাতে এমন মন্তব্য লিখে নিজের ফেসবুকে একটি পোস্ট করেছেন মাসরুর আরেফিন।
পরীমনিকে ব়্যাব গ্রেফতার করেছে। চয়নিকা চৌধুরীকেও ব়্যাব গ্রেফতার করেছে। প্রশ্ন উঠছে সাধারণ পুলিশ কেন গ্রেফতার করলো না? পরীমনি কি সন্ত্রাসী? পরীমনির জন্যে আইন-শৃঙ্খলা কি ভেঙ্গে পড়ছিলো? এদিকে গত শনিবার প্রায় হাজার খানেক তৌহিদী জনতা ‘ইসলাম রক্ষায়’ রূপসার শিয়ালী গ্রামে হিন্দুদের ওপর আক্রমন চালায়, তাঁরা ১৪টি মন্দির, মূর্তি ভাংচুর, ১৭০টি ঘরবাড়ি তছনছ করে। ব়্যাব কিন্তু সেখানে যায়নি, পুলিশও না।
পরীমনির গ্রেফতারির পর সরব নেটদুনিয়াও। অনেকেই বলছেন, পরীমনির বাড়িতে যারা নিয়মিত যাওয়া-আসা করতেন, তারা কোথায়, তাদের ধরা হচ্ছে না কেন? গ্রাম থেকে আসা স্মৃতিকে যারা ‘পরীমনি’ বানিয়েছেন, নেপথ্যের সেই কারিগরদের মুখোশ উন্মোচন করার আহ্বান নেটিজেনদের। তাদের মত, মদ রাখা বা মদ্যপানে যদি পরীমনি দোষী হয়, তাহলে তার সঙ্গে যারা মদ্যপান করেছে, তারাও তো সমান অপরাধী। তাহলে শুধু পরীমনি শাস্তি পাবে কেন? এরকম অসংখ্য প্রশ্ন ঘুরছে সোশ্যাল মিডিয়ায়।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং একজন মহিলা। সেখানে বিচার হওয়ার আগে এক তরুণীর জীবন ধ্বংস করে দেওয়ার খেলা চলছে। ব্যক্তিমানুষ পরীমনিরও ন্যায়বিচার প্রাপ্য। আইনের বিচারের আগেই কেউ যেন সমাজের বিচারের হাতে টুকরো না হয়ে যান। পরীমনি মামলায় এই আবেদনই এখন করছেন তসলিমা, আব্দুল গফ্ফর, মাসরুর আরেফিনরা।