সময়টা নব্বইয়ের দশক। একগাল দাড়ি, উসকো-খুসকো চুল, স্কিনটাইট জিন্স আর ঢলঢলে জামা পরা এক যুবক হঠাৎই যেন ধুমকেতুর মতো এসে বাংলা গানের চিরাচরিত সংজ্ঞাটাই বদলে দিলেন। তাঁর গানের লাইনে যেন ধরা পড়ল আমজনতার মনের কথা। যাতে ছিল না কোনও ভারি ভারি শব্দের বাহার। যা ছিল, তা হল খুব সহজ ভাষায় অনেক গভীর অর্থ। সঙ্গীতের দুনিয়ায় সেই বিশেষ ধারার নামকরণ হল 'জীবনমুখী গান' হিসেবে। আর সেই জীবনমুখী গানকে যিনি বাঙালির নিত্যদিনের প্লে লিস্টে যুক্ত করে দিয়েছিলেন তিনি নচিকেতা চক্রবর্তী (Nachiketa Chakraborty)।
১৯৯৩ সালে অ্যালবাম প্রকাশ
যদিও শুরুর পথটা অবশ্য একেবারেই মসৃণ ছিল না। প্রতিটা দিনেই ছিল নতুন করে বাঁচার লড়াই, নিজেকে প্রমাণের চেষ্টা। লিখে গিয়েছেন একের পর এক গান, সুরও দিয়েছেন তাতে। কিন্তু শুনবে কে? তাঁর গানের বিষয়বস্তু নিয়ে অনেকেই সেই সময় তাচ্ছিল্য বা রসিকতাও করেছেন। তবে সবাই নয়, কেউ কেউ তাঁর ওপর আস্থাও রেখেছিলেন। আর বাস্তবেই সেই আস্থা একদিন সত্যি হিসেবে প্রমাণিত হয়। ১৯৯৩ সালে মুক্তি পেল নচিকেতার (Nachiketa Chakraborty) অ্যালবাম। ব্যাস, রাতারাতি 'কেয়ার অফ ফুটপাথ নচিকেতা' পৌঁছে গেলেন শ্রোতাদের ঘরে ঘরে। হয়ে উঠলেন যুবসমাজের নয়নের মণি, যাকে বলে ইউথ আইকন। যদিও প্রথমেই অবশ্য সর্বস্তরের শ্রোতাদের স্বীকৃতি পাননি। তবে ধীরে ধীরে ৮ থেকে ৮০, সমস্ত অংশের শ্রোতা-দর্শকদের সমীহ ও ভালবাসা অর্জন করে নেন বাংলা গানের এই নতুন ধারার জনক।
বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর বাঁধলেন গান
অনেক সময়ই বিভিন্ন ঘটনা, সামাজিক ব্যাধি বা চলমান পরিস্থিতি দাগ কেটেছে নচিকেতার (Nachiketa Chakraborty) মনে, যা থেকে জন্ম নিয়েছে গান। যেমন ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর কলকাতায় কয়েকদিনের জন্য কারফিউ জারি করা হয়। সেইসময় নচিকেতা লেখেন 'এই বেশ ভাল আছি'। পরবর্তীকালে এটিই হয়েছিল তাঁর অ্যালবামের নাম। শুধু তাই নয়, সমাজের নৈতিক অবক্ষয়, পিঠে ডিগ্রির বোঝা নিয়ে যুবকের বেকারত্বের জ্বালা, গায়ের রং কালো হওয়ার কারণে বিয়ে না হওয়া মেয়েটার মনের অবসাদ, এক শ্রেণির রাজনৈতিক নেতার সর্বস্ব লুটেপুটে খাওয়ার চেষ্টা, সবই উঠে এসেছে নচিকেতার কলমে। আবার বৃদ্ধ বাবা-মায়ের প্রতি ছেলেমেয়েদের অবহেলা বা চিকিৎসার নামে কোনও কোনও ডাক্তারের রোগীর পরিবারকে সর্বশান্ত করে দেওয়ার মতলবকেও গানের মধ্য দিয়েই বিঁধেছেন তিনি।
সমকালীন শিল্পীদের অনেকেই মনে করেন নচিকেতা চক্রবর্তীর (Nachiketa Chakraborty) ভাবনাচিন্তা ও দর্শন অন্যদের থেকে একেবারেই আলাদা। নিজের ভাবনা দিয়ে আর পাঁচটা সাধারণ মানুষকে ভাবতে শিখিয়েছেন তিনি। তাই তো জীবনমুখী গানের এই শিল্পীর কথা ধরেই বলতে হয়, তাঁকে ভালবাসা যায়, তাঁর সমালোচনা করা যায়, কিন্তু তাঁকে উপেক্ষা করা যায় না।
আরও পড়ুন - UK-US নয়, শ্যাম্পু আবিষ্কার হয়েছে ভারতেই! জানতেন?