'আমার মেয়ের প্যাড লাগবে। ব্লিডিং হচ্ছে। এখনই একটি প্যাড দিন আমায়।' এয়ারপোর্টে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষারত এক যাত্রী ইন্ডিগোর কাউন্টারে গিয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়েন। হতাশ হয়ে হেল্প ডেস্ক চাপড়াতে শুরু করেন তিনি। কেন ন্যূনতম পরিষেবাটুকুও উড়ান সংস্থা দিতে পারছে না, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। হতাশ এই যাত্রীর রাগের বহিঃপ্রকাশ দেখে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন নেটিজেনরাও।
পরিষেবা এবং যাত্রীসংখ্যার নিরিখে দেশের বৃহত্তম বিমানসংস্থা ইন্ডিগো। তবে গত ২ ডিসেম্বর থেকে পরের পর ফ্লাইট বাতিল এবং উড়ানে বিলম্ব হওয়ার কারণে কার্যত পঙ্গু অবস্থায় হয়েছে পরিষেবার। লক্ষ লক্ষ যাত্রী অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছেন। শুক্রবারই এই বেসরকারি বিমানসংস্থার একশোরও বেশি বিমান বাতিল করা হয়েছে।
প্রতিদিন প্রায় ২ হাজার ২০০টি ফ্লাইট পরিচালনা করে ইন্ডিগো। সময়ের ডেডলাইন বজায় রাখাই ইন্ডিগোর পরিচয়। কিন্তু এই হার নেমে এসেছে মাত্র ১৯.৭ শতাংশে। গত মঙ্গলবারও এই হার ছিল ৩৫ শতাংশ। আগামী দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে এই সমস্যার সমাধান হবে বলে জানিয়েছেন ইন্ডিগোর CEO।
এর আগে কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রণাধীন অসামরিক বিমান পরিবহণ বা DGCA ২০২৪ সালে ইন্ডিগোর কর্মী ও পাইলটদের জন্য কাজের সময়ের মেয়াদ বেঁধে দিয়েছিল। সেই সময়ে পাইলটদের জন্য ‘ফ্লাইট ডিউটি টাইম লিমিটেশনস’ নামের বিধি প্রকাশ করা হয়। সেই বছরেরই জুন মাসে ওই বিধি কার্যকর করার কথা ছিল। কিন্তু ইন্ডিগো সহ অন্য বিমান সংস্থাগুলির আপত্তিতেই তা বহু দিন কার্যকর করা যায়নি। নভেম্বর মাসে দ্বিতীয় পর্যায়ে ওই শ্রমবিধি কার্যকর করার পরেই বিপর্যস্ত হয় ইন্ডিগোর বিমান পরিষেবা। কর্মী অপ্রতুলতাই এই সঙ্কটের কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ নয়া বিধিতে কোনও পাইলট বা বিমানকর্মীকে নির্দিষ্ট সময়ের বেশি কাজে রাখা (অন ডিউটি) রাখা যাবে না। আর তার জেরেই এই সঙ্কট তৈরি হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
DGCA-র আগের নির্দেশিকায় বলা হয়েছিল,পাইলটরা আগাম ছুটি নিন বা না-নিন, সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টার বিশ্রাম দিতেই হবে তাঁদের। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শুক্রবার এই সংক্রান্ত নিয়মটি শিথিল করা হয়েছে। পাইলটদের রাতের কাজ বা নাইট সংক্রান্ত বিধিও শিথিল করছে DGCA। এবার থেকে সাপ্তাহিক বিশ্রামের দিনের বদলে অন্য কোনও ছুটি নেওয়া যাবে না।
কী কারণে এই বিভ্রাট, তা খতিয়ে দেখতে শুক্রবার উচ্চ পর্যায়ের তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রের অসামরিক বিমান পরিবহণ মন্ত্রক। পাইলটদের সংগঠন ‘ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান পাইলটস’-এর অভিযোগ, ইন্ডিগো দীর্ঘ সময় ধরে নতুন পাইলট এবং বিমানকর্মী নিয়োগ করেনি। নয়া বিধি কার্যকর হবে, তা জেনেও দীর্ঘমেয়াদি কোনও পরিকল্পনা করেনি ইন্ডিগো। বরং দীর্ঘ দিন ধরে নিয়োগপ্রক্রিয়া বন্ধ রেখেছে।
এই বেহাল পরিস্থিতির জন্য প্রযুক্তিগত ত্রুটি, শীতকালীন সময়সূচি পরিবর্তন, প্রতিকূল আবহাওয়া, বিমান ব্যবস্থায় ক্রমবর্ধমান যানজট এবং বিমানকর্মীদের কাজের সংশোধিত সময়সূচিকে দায়ী করেছে ইন্ডিগো।
কেন্দ্র বিধি শিথিল করার পর ইন্ডিগোর বিমান পরিষেবা স্বাভাবিক হবে কি না, হলেও কবে, তা স্পষ্ট নয়। তবে শুক্রবার দুপুরে আরও এক বার যাত্রীদের কাছে ক্ষমা চেয়েছে উড়ান সংস্থাটি।
শুক্রবার থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিমান বাতিল হলে পুরো টাকা যাত্রীদের ফিরিয়ে দেওয়া হবে। বিভিন্ন বিমানবন্দরে বিমানের জন্য অপেক্ষারত ইন্ডিগোর যাত্রীরা অভিযোগ করেছিলেন, তাঁদের খাবার এবং পানীয় জলও দেওয়া হচ্ছে না বলেও বিস্তর অভিযোগ ওঠে।বিমানসংস্থা জানিয়েছে, অপেক্ষমাণ যাত্রীদের কাছে খাবার এবং জল পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছে তারা। যাত্রীদের সুবিধার্থে বিভিন্ন শহরে হোটেলের বন্দোবস্ত করা হচ্ছে বলেও জানিয়েছে ইন্ডিগো।
গত ৩ তারিখ থেকে শুক্রবার ৫ তারিখ দুপুর ২টো পর্যন্ত কলকাতায় ইন্ডিগোর ৯২টি বিমান বাতিল করা হয়েছে। কলকাতায় আসা ও যাওয়া দুই ক্ষেত্রেই ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন যাত্রীরা।
এই কয়েক দিনে প্রায় ৩২০টি ইন্ডিগোর বিমান নির্ধারিত সময়ের তুলনায় দেরিতে কলকাতায় অবতরণ করেছে বা কলকাতা ছেড়ে অন্য রাজ্য ও শহরের উদ্দেশ্যে উড়ে গিয়েছে। শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত কলকাতায় আসার ক্ষেত্রে ৮টি বিমান বাতিল করা হয়েছে এবং কলকাতা থেকে উড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ১৮টি বিমান বাতিল করা হয়েছে। এছাড়া আসা ও যাওয়া উভয় ক্ষেত্রেই ১৩টি করে বিমান সময়ের থেকে দেরিতে পৌঁছেছে
দেশের সবথেকে বড় উড়ান সংস্থার শয়ে শয়ে ফ্লাইট বাতিল হওয়ায় দেশীয় বিমানগুলির ভাড়া এখন আকাশছোঁয়া। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে, দেশের ভিতরে এক শহর থেকে অন্য শহরে যাওয়ার খরচে অনায়াসেই লন্ডন বা প্যারিস ঘুরে আসা যাবে বলে মনে করছেন যাত্রীরা।
কারও গুরুত্বপূর্ণ মিটিং মিস হয়েছে, কারও প্রিয়জনকে হাসপাতালে দেখতে যেতে দেরি হয়ে গিয়েছে। কেউ বা নিজের বিয়ের আসরেই সঠিক সময়ে পৌঁছতে পারেননি। সব মিলিয়ে চরম দুর্ভোগের শিকার ইন্ডিগোর যাত্রীরা।
যাত্রীদের লাইন, সারি সারি লাগেজ, বিমানবন্দরগুলিতে বিশৃঙ্খল দশা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সকলেরই প্রশ্ন, হঠাৎ বাতিল হওয়া ফ্লাইটের টিকিটের টাকা কীভাবে ফেরত পাব?
ইন্ডিগোর ওয়েবসাইটে গিয়ে Support' অপশন ক্লিক করে 'Plan B' অপশন বেছে নিতে হবে। PNR/বুকিং রেফারেন্স নম্বর ও ইমেল আইডি দিতে হবে। এরপর Change Flight বা Cancel Flight - এই দুইয়ের মধ্যে যেটি প্রয়োজন সেটি বেছে নিতে হবে। একই টিকিটে নতুন সময় বা তারিখ বেছে নিতে পারবেন অথবা সরাসরি ফ্লাইট বাতিল করে রিফান্ডও পেতে পারেন।