তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়েই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন যে তিনি এবার অন্যান্য রাজ্যেও দলের সংগঠন বিস্তারে জোর দেবেন। সেই প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে ত্রিপুরায়। দলীয় নেতা-নেত্রীরা তো যাচ্ছেনই, নিয়ম করে সেখানে কর্মসূচি রাখছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও। কেবল ত্রিপুরা বললে ভুল হবে, উত্তর-পূর্বের আরও দুই রাজ্য অসম ও মেঘালয়তেও সংগঠন বিস্তারে মন দিয়েছে ঘাসফুল শিবির। আর এবার তাদের নবতম সংযোজন আরব সাগরের তীরে ছোট্ট রাজ্য গোয়া। এই প্রথম পশ্চিম ভারতের কোনও রাজ্যে পা রাখতে চলেছে তৃণমূল। কিন্তু গুজাত, মহারাষ্ট্র, কর্ণাটকের মত তাবড় তাবড় রাজ্য থাকতে কেন গোয়াকেই বাছল তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্ব? সেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
আগামী বছর গোয়ায় বিধানসভা ভোট
লক্ষ্য ২০২৪ সালের লোকসভা ভোট, তার আগেই তৃণমূলকে সর্বভারতীয় স্তরে নিয়ে যেতে চাইছেন নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। লোকসভা ভোটের আগে এখনও বছর আড়াই বাকি রয়েছে। এই সময়টার মধ্যে রয়েছে একাধিক রাজ্যে বিধানসভা ভোট। মনে করা হচ্ছে, বিজেপিকে জোর টক্কর দিতে এই বিধানসভা ভোটগুলিকে অ্যাসিড টেস্ট করতে চাইছে জোড়াফুল শিবির। ঠিক যেমন ত্রিপুরায় ২০২৩ সালের বিধানসভা ভোটের দিকে নজর রেখে এগোচ্ছে তৃণমূল, এবার গোয়াতেও সেই পথটাই ধরতে চাইছেন দলীয় নেতৃত্ব।
যে পথে এগোতে চাইছে তৃণমূল
কয়েকদিন আগেই তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন অসমের প্রাক্তন সাংসদ সুস্মিতা দেব। দীর্ঘ সময়ে কংগ্রেসের ছত্রছায়ায় রাজনীতি করেছেন অসমের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সন্তোষমোহন দেবের কন্যা। তার সেই অভিজ্ঞতাকেই অসম ও ত্রিপুরায় সংগঠন গড়ার কাজে লাগাতে চাইছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। ত্রিপুরাতেও সেই একই ফরমুলায় এগিয়েছে ঘাসফুল শিবির। গোয়াতেও তার অন্যথা হচ্ছে না। প্রসঙ্গত কংগ্রেস ভেঙেই কিন্তু একদিন জন্ম হয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেসের। ১৯৯৮ সালের পয়লা জানুয়ারি তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সময় তাঁর সঙ্গে দল ছেড়েছিলেন অজিত পাঁজা, মদন মিত্র, ফিরহাদ হাকিম, মুকুল রায়ের মত নেতারা। পরবর্তীকালে বাংলায় একাধিক কংগ্রেস নেতা দল ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেন। ২০১১ সালে পালা বদলের পরও কংগ্রেসের সেই ভাঙন অব্যাহত থাকে। সেইসঙ্গে নতুন করে ভাঙতে শুরু করে বামদলগুলি। বর্তমানে রাজ্য স্তরের বিজেপি নেতৃত্বও দল ছেড়ে তৃণমূলে যাচ্ছেন। তবে এখনও পর্যন্ত জাতীয় স্তরে তৃণমূল শক্তিশালী হচ্ছে কংগ্রেস ছেড়ে আসা নেতা নেত্রীদের মাধ্যমেই। আর তাতেই নবতম সংযোজন গোয়ার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী লুইজিনহো ফালেইরো।
গোয়ায় এবার 'খেলা হবে'
যেসব রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় রয়েছে, সেইসব রাজ্যে লড়াই করবে তৃণমূল, আগেই ঘোষণা করেছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০২২-এর ফেব্রুয়ারিতে গোয়ায় বিধানসভা নির্বাচন। তার আগে গত সপ্তাহেই তৃণমূলের তরফে সেখানকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে প্রতিনিধি দল পাঠানো হয়েছিল। সেখানে গিয়েছিলেন রাজ্যসভায় তৃণমূলের দলনেতা ডেরেক ও'ব্রায়েন এবং লোকসভার সাংসদ প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূলের দুই সাংসদ গোয়ায় যাওয়ার আগে প্রশান্ত কিশোরের সংস্থা আইপ্যাক সেখানে সমীক্ষার কাজ শেষ করে। ত্রিপুরাতেও ঠিক তৃণমূল ময়দানে নামার আগে এভাবেই সমীক্ষা করেছিল পিকের সংস্থা। আইপ্যাকের সেই প্রাথমিক রিপোর্টের ভিত্তিতেই দুই সাংসদের গোয়ায় যাওয়া। জানা যাচ্ছে দলের তরফে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ডেরেককে দক্ষিণ গোয়া এবং প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়কে উত্তর-পশ্চিম গোয়ার দায়িত্ব দিয়েছেন। তাঁরা ইতিমধ্যেই গোয়ার গ্রামেও গিয়েছেন এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন। গোয়ায় তৃণমূলের পতাকা নিয়ে প্রচারও শুরু হয়ে গিয়েছে।
গোয়ার আবেগের সঙ্গে বাংলার আবেগকে মেলানোর চেষ্টা
গোয়া আর বাংলার মধ্যে যে দুটি বিষয়ে সব থেকে বেশি মিল রয়েছে, তা হল মাছ আর ফুটবল। রাজ্যসভায় তৃণমূলের সদস্য ডেরেক ও'ব্রায়েন স্পষ্ট করে দিয়েছেন, পশ্চিমের এই ছোট্ট রাজ্যে সংগঠন বাড়াতে অন্য দল থেকে উপযুক্ত নেতাদের দলে নেবেন তাঁরা। এতেই মনে করা হচ্ছে যে সেই রাজ্যে কংগ্রেসের সংগঠনে ফাটল ধরানোরই ছক কষছে তৃণমূল। গত রবিবার ভবানীপুরে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমর্থনে প্রচার সভা থেকে রাখঢাক না করেই দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ত্রিপুরার পরে আর এক বিজেপি শাসিত রাজ্য গোয়াতে ক্ষমতা বৃদ্ধির চেষ্টা করছে তৃণমূল।
গোয়ার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এবার তৃণমূলে
কংগ্রেসের সঙ্গে ৪০ বছরের সম্পর্ক ছিন্ন করে গোয়ার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী লুইজিনহো ফালাইরো যোগ দিয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেসে। সোমবার কংগ্রেসের প্রাথমিক সদস্যপদ ছাড়ার পরপরই ফালাইরো প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রীকে। বর্ষীয়া লুইজিনহো ফালাইরো গোয়ায় কংগ্রেসের সভাপতির দায়িত্বও সামলেছেন৷ লুইজিনহোর কংগ্রেস ছাড়া নিঃসন্দেহে হাত শিবিরের কাছে অত্যন্ত বড় ধাক্কা৷ কারণ তার হাত ধরেই কংগ্রেসে আরও বড় ভাঙন ধরার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে৷।
ময়দানে নামবেন মমতাও
চলতি সেপ্টেম্বরেই গোয়া নিয়ে মমতা-অভিষেক-প্রশান্ত কিশোরের মধ্যে একান্ত এবং দীর্ঘ বৈঠক হয়েছে। নির্বাচন কমিশন সূত্রে ইঙ্গিত, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি নাগাদ গোয়ায় নির্বাচন হতে পারে। সেখানেই বিজেপি-র বিপক্ষে শক্তিশালী দল হিসাবে উঠে আসতে চাইছে তৃণমূল। গোয়া নির্বাচনের আগে লুইজিনহোর যোগদানের ফলে রাজ্যে তৃণমূলের প্রচার আরও সক্রিয় হবে। এই মুহূর্তে গোয়ায় কংগ্রেস খুব বেশি শক্তিশালী নয়। শোনা যাচ্ছে, এর পর রাজনৈতিক লড়াইয়ের প্রাথমিক ধাঁচটা বুঝতে গোয়ায় যেতে পারেন স্বয়ং তৃণমূলনেত্রীও। ফালেইরো দলে আনুষ্ঠানিক ভাবে যোদ দেওয়ার আগেই গোয়ায় তৃণমূল নেত্রীর নামের হোর্ডিংয়ে ছেয়ে গিয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে লোগো ও স্লোগানও। শোনা যাচ্ছে পুজোর পরই পশ্চিমের এই রাজ্যটিতে সফরে যেতে পারেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
কেন ছোট রাজ্য গুলোতেই নজর?
আপাতত দলের তরফে স্থির করা হয়েছে, ছোট ছোট রাজ্যগুলিতে প্রভাব বিস্তার করা হবে। কারণ হিসাবে বলা হচ্ছে, সেখানে রাজনৈতিক পদার্পণ কিয়দংশে সুবিধাজনক। অর্থ কম খরচ হয়, বড় রাজ্যের তুলনায় সংগঠন বিস্তারেও কম সময় ব্যয় করতে হয়। তৃণমূল নেতৃত্বের বক্তব্য, আপাতত পশ্চিমবঙ্গের বাইরে ছোট ছোট রাজ্যেই পা রাখা হবে, এটাই দলের কৌশল। এই প্রসঙ্গে ডেরেক ও ব্রায়েন স্পষ্ট করেছেন, ত্রিপুরার মত গোয়াও ছোট রাজ্য। উত্তরপ্রদেশে প্রভাব বিস্তার করতে যে লোকবল, সংগঠনের প্রয়োজন তার তুলনায় ছোট রাজ্যে জমি শক্ত করা সহজ। তাই ২০২২ সালে উত্তরপ্রদেশের লোকসভা ভোটে তৃণমূল প্রার্থী দিলেও গোবলয়ের রাজ্যটিতে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচন বা তার পরে লড়াইয়ে নামার পরিকল্পনা রয়েছে ঘাসফুল শিবিরের।
গোয়া বিধানসভার বর্তমান পরিস্থিতি
গোয়া বিধানসভায় মোট ৪০টি আসন। ত্রিপুরার ঠিক অর্ধেক। ২০১৭ সালের নির্বাচনে গোয়ায় কংগ্রেস জিতেছিল ১৭টি আসনে। ১৩টিতে বিজেপি। তার পরেও বিজেপি ওই রাজ্যে সরকার গঠন করে। কারণ সে সময় দল বদলে বিজেপিতে যোগদানের হিড়িক পড়েছিল। ফলে ক্ষমতার মসনদে বসেছিল গেরুয়া শিবিরই। এবার সেই গোয়াকে পাখির চোখ করে এগোচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস। আর পদ্ম শিবিরকে পরাস্ত করতে সেই সমীকরণকেই হাতিয়ার করতে চাইছে তৃণমূল।
বিভিন্ন রাজ্যে প্রভাব বিস্তার করতে গিয়ে কি বন্ধু হারাচ্ছে তৃণমূল?
২০২৪-এর দিকে তাকিয়ে কংগ্রেস ও তৃণমূল জোটের পথs এগোচ্ছে, এমন সম্ভাবনার কথা শোনা গিয়েছিল। জুলাইতে দিল্লি গিয়ে মমতার সনিয়া-রাহুলের সঙ্গে সাক্ষাৎ সেই সম্ভাবনাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। এরপর ভবানীপুর উপনির্বাচনে প্রার্থী দেয়নি কংগ্রেস। যেটা জোটের জন্য কংগ্রেস হাইকমান্ডের মমতাকে স্পষ্ট বার্তা বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশ। কিন্তু যেভাবে কংগ্রেস ভাঙিয়ে তৃণমূল ভিন রাজ্যে সংগঠন বাড়ানোর কাজ শুরু করেছে তাতে এই জোট কতটা বাস্তবায়িত হতে পারবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। পাশাপাশি দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পর্ক অত্যন্ত ভাল। এদিকে গোয়া বিধানসভায় লড়বেন বলে আগেই ঘোষণা করে রেখেছেন কেজরি। ফলে তৃণমূল গোয়া দখল করতে নামলে কেজরির দল আপের সঙ্গে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যেতে হবে। ফলত ভিন রাজ্যে প্রভাব বাড়াতে গিয়ে লোকসভা ভোটের জন্য জোটের আগেই একাধিক সঙ্গীর সঙ্গে রাজনীতির ময়দানে দূরত্ব বাড়তে পারে জোড়াফুল শিবিরের।