ছোটবেলায় বাংলার দুর্ধর্ষ ডাকাতদের গল্প নিশ্চয় অনেকেই শুনেছেন। কেউ কেউ হয়ত বইতে পড়েছেনও। শক্ত সমর্থ পেশিবহুল চেহাড়া, ইয়া বড় গোঁফ, কপালে লাল তিলক, হাতে বল্লম বা লাঠিধারী সেই সব ডাকাতদের কাহিনি শুনলে আজও যেন শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়। আর বাংলার ডাকাত-কথার সঙ্গে ওতোপ্রোতোভাবে জড়িয়ে রয়েছে যে বিষয়টি তা হল কালীপুজো। শোনা যায়, সেই সময় অনেক ডাকাতই নাকি নিয়মিত মা কালীর পুজো করত। মায়ের পুজোর পরেই তারা যেত ডাকাতি করতে। আবার ডাকাতি করে ফিরে এসে সমস্ত লুঠ করা সামগ্রী অর্পণ করত মায়ের পায়ে। কোনও কোনও ডাকাত তো আবার মায়ের সামনে নরবলিও দিত। ডাকাতদের পূজিতা সেইসব কালীই ধীরে ধীরে 'ডাকাতকালী' (Dakat kali) নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন। আসন্ন দীপান্বিতা অমাবস্যার (Kali Puja 2021) আগে বাংলার সেইসব প্রাচীন ডাকাতকালীদের গল্পই জেনে নেওয়া যাক।
সিঙ্গুরের ডাকাত কালী - হুগলির সিঙ্গুরের পুরুষোত্তমপুরের ডাকাতকালীর নাম শোনা যায় দিকে দিক। কেউ কেউ বলেন রঘু সর্দার বা রঘু ডাকাতই নাকি এই কালী (Singur Dakat Kali) প্রতিষ্ঠা করে। কারও কারও মতে আবার এই কালীর প্রতিষ্ঠাতা গগন ডাকাত বা বিশু সর্দার। তবে অনেকে আবার বলেন, চালকেবাটির মোড়ল দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।
ত্রিবেণীর ডাকাত কালী - হুগলির ত্রিবেণীর একটি কালীমন্দিরের সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে ডাকাতদের নাম। শোনা যায় রঘু, বিষে সহ আরও বেশকয়েকজন ডাকাত ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে মায়ের পুজো দিত। কথিত আছে, একবার নাকি সাধক রামপ্রসাদকে বলি দেওয়ার জন্য ডাকাতরা মন্দিরে ধরে নিয়ে যায়। কিন্তু বলি দিতে যাওয়ার আগেই গান ধরেন রামপ্রসাদ। যা শুনে নাকি ডাকাতদল ঘুমিয়ে পড়েছিল।
কেলেগড়ের ডাকাত কালী - হুগলি জেলার এই এলাকার নামকরণ হয় এক জমিদারের নামানুসারে। এলাকার জমিদারের নাম ছিল কালাচাঁদ। সেই জমিদারের নামানুসারেই এলাকার নাম হয় কেলেগড় বা কালীগড়। কালাচাঁদ ছিল কালীসাধক। শোনা যায়, দিনের বেলায় সে পরম ধার্মিক রূপে থাকত। কিন্তু সূর্য ডুবলেই সে হয়ে উঠত ভয়ঙ্কর ডাকাত। লুঠপাটের পাশাপাশি অনেককে ধরে এনে বন্দি করেও রাখত কালাচাঁদ। তারপর সেই বন্দিদের মা কালীর সামনে বলি দিত সে।
ডাকাত সর্দার প্রহ্লাদের বামা কালী - প্রায় সাড়ে তিনশো বছরেরও বেশি সময় আগে আউশগ্রামের পাণ্ডুক গ্রামে বামা কালীর প্রতিষ্ঠা করে ডাকাত সর্দার প্রহ্লাদ। কার্তিক মাসের অমাবস্যায় ২২ ফুটের মূর্তি তৈরি করে দেবীর পুজো হয়। পাণ্ডুক গ্রামের মেটে পরিবারের পূর্ব পুরুষরাই নাকি সেই ডাকাতদলের সদস্য ছিল। তাই সেই প্রচলিত রীতি মেনে আজও বামা কালীর পুজোতে সেই ডাকাত পরিবারের সদস্যরা কোনও না কোনও জিনিস চুরি করে আনে বলে শোনা যায়। পাশাপাশি এই আউশগ্রামেরই বননবগ্রামের মেটে পাড়াতেও রয়েছে এক ডাকাতকালীর অধিষ্ঠান। এই কালীকে অনেকে পাণ্ডুকের বামা কালীর বোন বলেও মনে করেন।
তেলোভোলের মাঠের ডাকাত কালী - একবার কামারপুকুর থেকে দক্ষিণেশ্বর যাওয়ার পথে তেলোভেলোর মাঠে সঙ্গীদের থেকে কিছুটা পিছিয়ে পড়েন মা সারদাদেবী। সঙ্গীরা সারদাদেবীকে পিছনে ফেলে চলে যাওয়ার পর ডাকাতদের কবলে পড়েন তিনি। কিন্তু ডাকাত সর্দারের কাছে নিজেকে তাঁর মেয়ে বলে পরিচয় দেন সারদাদেবী। ব্যাস, সারদাদেবীর সেই কথা শুনে মন গলে যায় ডাকাত সর্দারের। সেই রাতে পরম যত্নে সারদেদেবীকে নিজের বাড়িতে রাখে সর্দার। রাতে মুড়ি মুড়কি ও চালভাজা খেতে দেওয়া হয় মাকে। পরদিন সর্দার নিজেই পৌঁছে দেয় সারদাদেবীকে। এরপর সেখানেই মেয়ে রূপে সারদা মা-কে প্রতিষ্ঠা করে সর্দার। সেই থেকে এখনও সেখানে মেয়ে রূপে পূজিতা সারদেদেবী।
আরও পড়ুন -মালিককেই শিং দিয়ে গুঁতিয়ে আছড়ে মারল মোষ, পালটা গ্রামবাসীরা যা করলেন...