দোলযাত্রা আর হোলি কি এক? রঙের উৎসবের শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে অনেকেই গুলিয়ে ফেলেন। দোলাযাত্রার দিনেও 'হ্য়াাপি হোলি' লিখে বার্তা পাঠান। দোলযাত্রা ও হোলি রঙের উৎসব হলেও তা আদতে আলাদা। এমনকি উৎসবের কারণও ভিন্ন। ঠিক যেমন নবরাত্রি ও দুর্গাপুজোয় আদিশক্তির আরাধনা হলেও তা এক নয়! ঠিক তেমনই দোল ও হোলির নেপথ্যে রয়েছে ভিন্ন কাহিনি।
দোলযাত্রা হল প্রেমের উদযাপন। রাধা ও কৃষ্ণের সেই অমোঘ প্রেমের সাগরে ডুব দেওয়ার নামই দোল। যেখানে পরস্পরকে রং মাখিয়ে উদযাপন করা হয় দোল। যে রঙে কোনও জাত-পাত ধর্ম এমনকি লিঙ্গ নেই। যে রঙে রাঙিয়ে যান ধনী থেকে গরিব। যে রং বসন্ত ঋতুর। যে রঙে মানুষ বিলীন হন প্রেম ও ভক্তির সাগরে। আর হোলি হল, অধর্মের উপর ধর্মের বিজয়। যেখানে ভক্তের পাশে দাঁড়ান ভগবান। শাস্তি দেন দুর্বৃত্তকে। দোল ও হোলি আলাদা হলেও তাঁর ভরকেন্দ্রে কিন্তু শ্রী বিষ্ণু। সেই রহস্যই বলব এই প্রতিবেদনে।
পঞ্জিকা অনুসারে ফাল্গুন পূর্ণিমার রাতের পরদিন দোল পালন করা হয়। রাধা-কৃষ্ণের প্রেমরসই দোলের উপপাদ্য। বৃন্দাবনের কিশোর-কিশোরীর বসন্তের রঙের উদযাপনই দোল পূর্ণিমা। কথিত আছে, এই দিনই নিজের শারদপদ্মের গালে রঙের ছোঁয়া দিয়েছিলেন নন্দকিশোর। অনেকে আবার বলেন, বন্ধুদের সঙ্গে খেলছিলেন রাধা। ই রাধা গালে রং দিয়ে প্রেম নিবেদন করেছিলেন কৃষ্ণ। শ্রীকৃষ্ণ জন্মভূমি মথুরা ও বৃন্দাবনে ১৬ দিন ধরে উদযাপিত হয় দোল পূর্ণিমা।
বাংলায় দোলের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন শ্রী চৈতন্য। এই দিন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মতিথি। পশ্চিমবঙ্গের নদিয়ার নবদ্বীপ, মায়াপুর, কৃষ্ণনগরে মহা ধুমধামে উদযাপিত হয় দোল পূর্ণিমা। পুজো আচার থেকে সারাদিন ধরে চলে কীর্তন। ওড়িশাতেও ধুমধাম করে পালিত হয় শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মতিথি। দোল পূর্ণিমা উদযাপিত হয় অসম, ত্রিপুরা, বাংলাদেশেও। বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী দোলই বছরের শেষ উৎসব।
হোলি তাহলে কী? হোলির সঙ্গে জড়িয়ে শ্রী বিষ্ণুর আর এক রূপ। তিনি হলেন নৃসিংহ বা নরসিংহ। এ কাহিনিতে রয়েছেন আর এক চরিত্র। তিনি হলেন বিষ্ণুভক্ত প্রহ্লাদ। পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী, রাজা হিরণ্যকশিপুর পুত্র প্রহ্লাদ। সে বিষ্ণুভক্ত। অথচ অসুররাজ হিরণ্যকশিপুর বিষ্ণুকে নিজের শত্রু ভাবতেন। তাঁর ঘরেই কিনা বিষ্ণুর পুজো করছে! তা-ও আবার নিজের ছেলে! প্রহ্লাদকে মারার কৌশল করলেন হিরণ্যকশিপুর। নানা ভাবে বিফল হয়ে দায়িত্ব দিলেন বোন হোলিকাকে। যে হোলিকা বরপ্রাপ্ত, আগুন তাঁকে পোড়াতে পারবে না। প্রহ্লাদকে সঙ্গে নিয়ে আগুনের কুণ্ডে ঝাঁপ দিলেন হোলিকা। তবে আগুনের তাপ থেকে বাঁচকে পারেননি হোলিকা। তিনি জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যান। বেঁচে যায় প্রহ্লাদ। তাঁর গায়ে আগুনের আঁচ পর্যন্ত লাগেনি। তার পর থেকেই অশুভ শক্তির পরাজয় ও শুভ শক্তির জয় উদযাপন করতে প্রতিবছর চলে হোলিকা দহন। যা হোলির আগের দিন হয়। বাংলায় দোলের আগের দিন অনুরূপ ন্যাড়া পোড়ানো হয়।
প্রহ্লাদকে মারতে উদ্যত হলেন হিরণ্যকশিপুর। প্রহ্লাদকে জিজ্ঞাসা করলেন,'কোথায় তোমার বিষ্ণু?' প্রহ্লাদ বলেছিল,'শ্রী বিষ্ণু সর্বত্র। এই থামের মধ্যেও তিনি।' গদা দিয়ে থাম ভাঙলেন হিরণ্যকশিপুর। তখনই বেরিয়ে আসেন বিষ্ণুর নৃসিংহ অবতার। আসলে হিরণ্যকশিপুর বর পেয়েছিলেন। তাঁকে দিনে বা রাতে, জলে স্থলে বা আকাশে, নারী পুরুষ বা পশু কেউ মারতে পারবে না। এমনকি কোনও অস্ত্র দিয়েও তাঁকে মারা যাবে না। ব্রহ্মার বর পেয়ে নিজেরে অমর ভাবতে শুরু করেছিলেন হিরণ্যকশিপুর। অহংকার গ্রাস করেছিল তাঁকে। হিরণ্যকশিপুরকে সবক শেখাতে শ্রী বিষ্ণু নৃসিংহ রূপ নিয়েছিলেন। যা মানুষ নয়, আবার পশুও নয়। নিজের উরুতে বসিয়ে হিরণ্যকশিপুরের বুক চিড়ে দিয়েছিলেন নরসিংহ। যা স্থল নয়, আবার আকাশও নয়। আর এই ঘটনার সময় ছিল সূর্যান্ত। অর্থাৎ দিনও নয়, আবার রাতও নয়। এই কাহিনি হল অহংকারে মত্ত অশুভ শক্তির উপরে শুভ শক্তির বিজয়ের। যা আজও উদযাপিত হয়।
এর একটি পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, কংসের আদেশে শ্রী কৃষ্ণকে হত্যা করার জন্য তাঁকে স্তন্যপান করান পুতনা রাক্ষসী। বিষাক্ত দুধ খেয়েও শ্রী কৃষ্ণের কোনও ক্ষতি হয়নি। বরং তাঁর শরীর নীল হয়ে যায়। পুতনাকে হত্যা করেন কৃষ্ণ। রাধার দুধে-আলতা গায়ের রং দেখে বেশ বিমর্ষ হন কৃষ্ণ। তখন যশোদা পরামর্শ দেন, রাধাকেও যেন সেই রঙে রাঙিয়ে দেন। মায়ের আদেশ পালন করেছিলেন নন্দলাল।