সোনার গয়না বন্ধক রেখে ঋণ নেওয়ার গ্রাহকের সংখ্যা ভারতে প্রচুর। বহু মানুষ গোল্ড লোন নেন। যার নির্যাস, একাধিক গোল্ড লোন সংস্থা ব্যবসা করছে রমরমিয়ে। তবে এবার স্বর্ণ ঋণ বা গোল্ড লোনের নিয়মের ক্ষেত্রে বড়সড় পরিবর্তন আনছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বা RBI। আরবিআই-এর এই নিয়মের জেরে চাপ হয়ে যেতে পারে নন ব্যাঙ্কিং ফিন্যান্স কোম্পানিগুলির (NBFC)। বেশির ভাগ NBFC গোল্ড লোনের উপরে ব্যাপক ভাবে নির্ভরশীল। তাদের কাছে আরবিআই-এর নয়া নিয়ম চ্যালেঞ্জিং হতে চলেছে। চলতি মাসেই আরবিআই জারি করে দিয়েছে নতুন নিয়ম।
আরবিআই-এর নয়া নিয়ম অনুযায়ী, এখন থেকে শুধুমাত্র সোনার দাম বিবেচনা করে ঋণ দেওয়া যাবে না। লোন অনুমোদনের আগে বিচার করতে হবে ঋণগ্রহীতার আয়ের উৎস ও আর্থিক সামর্থ্য। এর ফলে গোল্ড লোন দেওয়ার আগে সংস্থাগুলিকে ঋণগ্রহীতার ক্রেডিট অ্যাসেসমেন্ট করতেই হবে। এত দিন সোনার দামের উপরেই লোন দেওয়া হত। ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে বিচার্য হবে, গ্রাহকের ক্রেডিট অ্যাসেসমেন্ট।
আরবিআই-এর নিয়ম বলছে, গোল্ড লোন বা স্বর্ণ ঋণ দেওয়ার আগে গ্রাহকের স্থায়ী আয় রয়েছে কিনা, ঠিক সময়ে ঋণের টাকা ফেরত দিয়ে বন্ধকী সোনা ছাড়ানোর ক্ষমতা রয়েছে কিনা, সব বিষয় দেখতে হবে সংস্থাকে। ঋণগ্রহীতার আর্থিক সামর্থ যাচাই করাই বাধ্যতামূলক।
এছাড়া, NBFC সহ গোল্ড লোন সংস্থাগুলিকে এখন থেকে আরও কড়াভাবে Loan-to-Value (LTV) অনুপাত পর্যবেক্ষণ করতে হবে। সোনার মূল্য ও ঋণের পরিমাণের এই অনুপাত হিসেব করার সময় এখন থেকে সুদের হারকেও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ফলে, আগের তুলনায় ঋণগ্রহীতারা সোনা বন্ধক দিয়ে কিছুটা কম পরিমাণে ঋণ পেতে পারেন। কারণ, আগের মতো শুধু সোনার বাজারদর দেখে লোন অনুমোদন দেওয়া যাবে না।
S&P Global Ratings-এর ক্রেডিট অ্যানালিস্ট সিঞ্জয় ভার্গিস জানাচ্ছেন, এই নতুন ব্যবস্থায় যেতে গিয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলিকেও শুরুতেই খরচের মুখে পড়তে হচ্ছে। ঋণগ্রহীতার আর্থিক সামর্থ্য ও নগদ টাকার প্রবাহ (cash flow) বিশ্লেষণ করার জন্য যে নতুন পদ্ধতি চালু করতে হবে, তার জন্য প্রযুক্তি বিনিয়োগ, প্রশিক্ষণ ও কাগজপত্র যাচাইয়ের বাড়তি খরচ পড়ছে NBFC-দের ওপর। অর্থাৎ, কেবল ঋণগ্রহীতার জন্য নয়, এই নিয়ম বদলের প্রভাব ঋণদাতাদের দিকেও স্পষ্টভাবে পড়ছে। অনেক সংস্থাই তাদের বিদ্যমান ক্রেডিট মডেল পাল্টে, নতুন মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালু করতে বাধ্য হচ্ছে।
এই নতুন নিয়ম চালুর জন্য যাবতীয় প্রযুক্তিগত প্রক্রিয়া শেষ করার জন্য NBFC গুলিকে ২০২৬ সালের পয়লা এপ্রিল পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে। তবে নতুন পদ্ধতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে সংস্থাগুলিকে যে সময়সীমা দিয়েছে আরবিআই, তাতেও আসন্ন চ্যালেঞ্জগুলি ঝেলতেই হবে।
নতুন নিয়ম মেনে চলার জন্য ঋণদাতাদের প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত পরিকাঠামো ও মূল্যায়ন পদ্ধতি গড়ে তুলতে হবে, যার জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে খরচ বাড়বে এবং নানা রকম কার্যকরী চ্যালেঞ্জও দেখা দেবে। এই সময়সীমা যতটা না ছাড়, তার চেয়েও বেশি এক রূপান্তরের চাপ—যেখানে NBFC ও অন্যান্য সংস্থাগুলিকে দ্রুত গতিতে নিজেদের কাজের ধরন বদলাতে হবে।
বস্তুত, ভারতের ক্রেডিট ইকো সিস্টেমে গোল্ড লোন বা স্বর্ণ ঋণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে ভারতে এমন বহু অঞ্চল রয়েছে, যেখানে আয়ের উত্সের পর্যাপ্ত নথি নেই বহু মানুষের কাছে। আরবিআই-এর মূল উদ্দেশ্য হল, এই সেক্টরকে আরও বেশি করে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা। কারণ, স্বর্ণ ঋণে ঝুঁকির পরিমাণ ব্যাপক হারে বাড়ছে।
S&P Global Ratings অনুসারে, স্বর্ণ ঋণ সেক্টরে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে চলেছে। যেখানে প্রয়োজন পড়বে নতুনত্ব, নিয়ম মানা এবং সতর্কতার নিখুঁত সমন্বয়ের। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের এই নতুন বিধিনিষেধ শুধু ঋণ দেওয়ার ধরনে নয়, পুরো ঋণ ব্যবস্থাপনাকেই পাল্টে দেবে। ফলে ঋণদাতাদের এখন থেকে নতুন প্রযুক্তি ও কৌশলের মাধ্যমে কাজ করতে হবে, আবার সেই সঙ্গে RBI-র প্রতিটি নির্দেশ মেনে চলার দায়িত্বও নিতে হবে। ভারতের সোনাভিত্তিক ঋণ শিল্প এখন এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, যেখানে ধীরে ধীরে ‘বন্ধকনির্ভর ঋণ’ থেকে ‘আয়নির্ভর ঋণ’-এর দিকে এগোচ্ছে গোটা সিস্টেম।
ঋণগ্রহীতার ঋণ পরিশোধ করার সামর্থের উপর নির্ভর করবে, তাঁকে গোল্ড লোন দেওয়া যাবে কিনা। এই প্রক্রিয়াটিকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে লাগু করতে হবে সংস্থাগুলিকে।
যার প্রভাব পড়বে ভারতের ক্রেডিট ইকোসিস্টেমেও। দেশের ক্রেডিট ইকোসিস্টেম একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে।