বেশ কয়েকবছর ধরে আদিবাসী এলাকায় নিজেদের ঘাঁটি গেড়ে ২০১৯–এর লোকসভা নির্বাচনে জঙ্গলমহলের সব ক’টি আসনের দখল নেয় বিজেপি। এবারও আদিবসী অধ্যুষিত এই এলাকাকে নিজেদের পাখির চোখ করেছে গেরুয়া শিবির। তাই গত মাসে দক্ষিণবঙ্গ সফরে এসে বাঁকুড়ায় ছুটে গিয়েছেন অমিত শাহ। সারাদিন কাটিয়েছেন জেলা সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক করে। শুধু তাই নয় এলাকাবাসীর মন পেতে এক আদিবাসী পরিবারে মধ্যাহ্নভোজনও করেছেন শাহ। আগামী বিধানসভা নির্বাচনে জঙ্গলমহল যে একটা বড় ফ্যাক্টর হতে চলেছে তা বলাই বাহুল্য। তাই শাহের সফরের পরে কালক্ষেপ না করে নিজে বাঁকুড়ায় ছুটে গিয়েছেন তৃণমূলনেত্রী। করোনাকালে জনসভাও করেছেন। এবার পশ্চিম মেদিনীপুরে হাজির হয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। লক্ষ্য সেই ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে ঘর গোছানো। একসময় ‘জঙ্গলমহলের মা' উপমা পেয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু বর্তমানে কেন আদিবাসী অধ্যুষিত এই অঞ্চলের একটা বড় অংশ তৃণমূল কংগ্রেসের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিল, এই প্রশ্নই উঠে আসছে বারবার। যার মোকাবিলা করতে সেই আসরে নামতে হয়েছে তৃণমূলনেত্রীকেই।
সোমবার মেদিনীপুরের কলেজ মাঠে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভাকে ঐতিহাসিক আখ্যা দিতে চাইছে তৃণমূল। ১৯৯৮ সালে নিজের অনুগামীদের নিয়ে কংগ্রেস ভেঙে সাহস করে বেরিয়ে এসেছিলেন অগ্নিকন্যা। তারপর ১৩ বছরের দীর্ঘ লড়াইয়ের পর ২০১১ সালে ৩৪ বছরের বাম সরকারকে অপসারিত করে বাংলার মসনদে শুরু মমতারাজের। দেখতে দেখতে ৯ বছর পার করে গেছে সরকার। তৃণমূল সরকাররে হ্যাটট্রিক হবে কিনা সেনিয়ে শুরু হয়ে গিয়েছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। কিন্তু গত ২২ বছর ধরে নিজে হাতে যে দলটিকে গড়েছেন মমতা আজ যেন সেই দলই দাঁড়িয়ে রয়েছে খাদের কিনারায়। যেখানে ভাঙনের সংশয় সবসময় গ্রাস করছে দলনেত্রীকে। তাই জঙ্গলমহলে হারান জমি ফের পেতে তৃণমূলনেত্রীকেই স্বয়ং আসরে নামতে হয়েছে।
২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে শাসক দলের বিরুদ্ধে ব্যাপক হিংসার অভিযোগ উঠেছিল। তারপরেও জঙ্গলমহলের ৪ জেলা বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রাম ও পশ্চিম মেদিনীপুরে পঞ্চায়েতে ভাল ফল করে বিজেপি। আদিবাসী অধ্য়ুষিত এলাকায় গেরুয়া শিবিরের সমর্থন বেড়ে যাওয়ায় স্বভাবতই চিন্তিত ছিল শাসকদল। কারণ বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ায় দলের পর্যবেক্ষক ছিলেন যুব তৃণমূলের সর্বভারতীয় সভাপতি সাংসদ অভিষেক বন্দ্য়োপাধ্য়ায়। অন্য় দিকে ঝাড়গ্রাম ও পশ্চিম মেদিনীপুরের পর্যবেক্ষক ছিলেন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক সুব্রত বক্সী। শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশে জঙ্গলমহলে গিয়ে বৈঠক করতে হয়েছিল সুব্রত বক্সীকে। তারপরেও অবশ্য লোকসভা ভোটে ঘাসফুলের ভরাডুবি আটকানো যায়নি।
লোকসভা ভোটে ভরাডুবির পর জঙ্গলমহল পুনরুদ্ধারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল শুভেন্দু অধিকারীকে। সেই শুভেন্দুই এখন বেসুরো। তাই গত অক্টোবরে ঝাড়গ্রামে প্রশাসনিক সভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন দাবি করেছিলেন জঙ্গলমহলের সব কাজ হয়ে গিয়েছে। বাকি কিছুই নেই তারপরেই নেতাই গ্রামে ভিন্নসুর শোনা গিয়েছিল শুভেন্দু অধিকারীর কন্ঠে। তৎকালীন রাজ্যের পরিবহনমন্ত্রী দাবি করেছিলেন , এলাকার অনেকে বাড়ি পাননি, রয়েছে কাজের দাবি। এ সব নিয়ে মানুষের ক্ষোভও রয়েছে।
বাম আমলের শেষের দিকে জঙ্গলমহলের পরিস্থিতি উদ্বেগ জনক হয়ে উঠেছিল তা অস্বীকার করার উপায় নেই। ২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার পর যে অবস্থার উন্নতি হয়েছে তাও অনস্বীকার্য। জঙ্গলমহলে মাওবাদী তৎপরতাও মমতা জমানায় অনেক কমেছে। জঙ্গলমহলের উন্নয়নে নিজে উদ্যোগী হয়েছিলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী। বারবার ছুটে গিয়েছেন এই এলাকায়। নিজেদের সরকারি প্রকল্পগুলি ও একের পর এক উন্নয়নের কাজের খতিয়ান খাতায়-কলমে দিয়ে এসেছে রাজ্য সরকার। কিন্তু তারপরেও গত কয়েক বছরে জঙ্গলমহল এলাকায় তৃণমূলের জনপ্রিয়তার গ্রাফ কিন্তু নিম্নমুখী। আদিবাসী অধ্যুষিত এই অঞ্চলের একটা বড় অংশ তৃণমূল কংগ্রেসের দিক থেকে কেন মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। এই প্রশ্নেই এখন জেরবার দলের জেলা কমিটিগুলো। তাহলে কি এখানকার মানুষ সরকারি প্রকল্প থেকে বঞ্চিত হয়েছেন? উঠছে সেই প্রশ্ন।
জঙ্গলমহলে তৃণমূল হারল কেন? উত্তর খুঁজতে গিয়ে ধাক্কা খাচ্ছে দলের উন্নয়ন-তত্ত্ব। ঝাড়গ্রাম থেকে পুরুলিয়া যে সব আদিবাসী এলাকায় তৃণমূল জিততে পারেনি, সেখানে উন্নয়নের ‘সুফল’ মানুষের কাছে পৌঁছয়নি বলে মনে করছে দলীয় নেতৃত্ব। বাম আমলে জঙ্গলমহলে আমলাশোলের মতো অনাহার-ক্লিষ্ট গ্রামের নিদর্শন প্রকৃত অর্থেই অনুন্নয়নের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। যার জেরে রাজ্য রাজনীতিও তোলপাড় হয়েছিল। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে এখন উন্নয়ন হলেও মানুষের কাছে আদৌ তা পৌঁছচ্ছে, সেই উত্তর খুঁজতেই দিশাহারা তৃণমূল নেতৃত্ব।
গত বিধানসভা নির্বাচনে ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার মতো জেলায় আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলগুলির অধিকাংশ বিধায়ক তৃণমূলের। গত ৫ বছরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘনঘন এই সব এলাকা সফর করেছেন। জেলার প্রশাসনিক বৈঠকে উন্নয়নের কাজ খতিয়ে দেখা হয়। তা সত্ত্বেও উন্নয়ন না পৌঁছনোর দায় তাই স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের উপরেই চাপাতে চাইছে তৃণমূল। এমন অভিযোগও উঠছে, জনপ্রতিনিধিরা সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন না। এই আবহে নতুন করে জঙ্গলমহলে ফের মাওবাদীদের সক্রিয়তার খবরও পাওয়া যাচ্ছে।
একদা পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষ মুখ্যমন্ত্রীকে জঙ্গলমহলের মা বলেছিলেন। তারপর কালের নিয়মেই এখন বিজেপিতে নাম লিখিয়েছেন একদা মমতা ঘনিষ্ঠ প্রাক্তন এই আইপিএস। তারসঙ্গেই যেন পাল্টে গিয়েছে জঙ্গলমহলের সমীকরণও। তৃণমূল আমলের ১০ বছরের শাসনে শান্তি ফিরলেও বেড়েছে বেকারত্ব। ধীরে ধীরে গ্রামবাসীদের মধ্যে মাওবাদীদের নিয়ে পুরনো ভয় আশঙ্কাও আবার জেগে উঠেছে। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের আগে তাই মমতা নিজেই ময়দানে নেমেছেন গড় পুনরুদ্ধার করতে। গত মাসে বাঁকুড়ার পর সোমবার জনসভা করলেন পশ্চিম মেদিনীপুরে। যেখানে জঙ্গলমহলের উন্নয়ন নিয়ে পেশ করে গেলেন খতিয়ান। এদিন মেদিনীপুর কলেজ মাঠের ভিড়কে তুলনা করলেন ব্রিগেডের সঙ্গে। করোনা কালে জনসভা ঘিরে মানুষের উৎসাহ দেখে আপ্লুত হন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু এই ভিড়ের কতটা ভোট ব্যাঙ্কে ফিরে আসবে তা নিয়ে কিন্তু সংশয়ের অবকাশ থেকে যাচ্ছে খোদ তৃণমূল শিবিরেই।