শুধু দার্জিলিং, কার্শিয়াং, কালিম্পংয়ের প্রচলিত ও অপ্রচলিত জায়গায় একদিন করে থাকতে চান, তাহলে হয়তো এক জীবনও কম পড়ে যাবে। বিশেষ করে আধুনিক পর্যটনে হোমস্টে কালচার চালু হওয়ার পর ঘোরার জায়গা আরও বেড়ে গিয়েছে। হলফ করে বলা যায়, যতগুলি জায়গা এ রাজ্যের উত্তরবঙ্গের পাহাড়ে আছে, আপনি সবগুলির নামই শোনেননি।
তাহলে ঘুরতে যাঁরা ভালবাসেন, তাঁরা কী করবেন? ঘুরবেন না? কেন ঘুরবেন না! সব কোনওদিনও সম্ভব না হলেও, সব জায়গার ফ্লেভার নিতে পারবেন আপনি। তাও খুব সহজেই মাত্র ৫ দিনে। এ জন্য আমরা আপনাদের জন্য একটা রুট ছক কষে দিচ্ছি। যা মাগ্গি গণ্ডার বাজারে শুধু সহজ নয়, সস্তাও বটে। ৫ দিনে আপনি গর্ব করে বলতে পারবেন সব জায়গা ঘুরেছি।
প্রথমেই কলকাতা, দিল্লি বা যে কোনও জায়গা থেকে বাগডোগরা বিমানবন্দর কিংবা এনজেপি স্টেশনের টিকিট কেটে ফেলুন সুবিধামতো।দুটোই উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রবেশদ্বার, শহর শিলিগুড়িকে কেন্দ্র করে রয়েছে। এবার আপনি এনজেপি স্টেশন থেকে টয়ট্রেন থাকলেও তাতে উঠবেন না। কারণ তাহলে আপনার একটা সারাদিন টয়ট্রেনের যাত্রায় চলে যাবে। এটা না হয় অন্য কোনও সময়ের জন্য বরাদ্দ রাখুন। এবার গাড়ি ভাড়া করে নিন।
প্রথম দিন
১. শিলিগুড়ির বাগডোগরা হোক কিংবা এনজেপি, সেখান থেকে সড়কপথে প্রথমে দেড় ঘন্টা যাত্রা করে মিরিক চলে যান।
২. মোটামুটি সকালে ৯ টা থেকে সাড়ে ৯ টার মধ্যে মিরিকে পৌঁছে প্রাতরাশ সেরে নিতে পারেন। এখানে দেশি-বিদেশী সমস্ত রকমের খানাই পাওয়া যায়। ঘন্টা দুয়ের মিরিক ঘুরুন। পর্যটকদের অন্যতম প্রধান ভ্রমণ স্থানটি হল মিরিক লেক।
৩. দুপুর ১২ টার দিকে বেরিয়ে চাখরলিং বৌদ্ধমন্দির চলে যান। এখান থেকে গোটা কাঞ্চনজঙ্ঘা সহ পাহাড়ের দৃশ্য অতুলনীয়। এখান থেকে টিং-লিং ভিউ পয়েন্টে গিয়ে সেখানে চা খেতে খেতে চটপট ছবি তুলে ফেলুন যাত্রাকে সাক্ষী রেখে।
৪. এবার আশপাশে যেখানে ইচ্ছে লাঞ্চ সেরে নিতে পারেন। লাঞ্চ সেরে এবার দার্জিলিং-এর উদ্দেশে রওনা হন।
৫. পথে তিব্বতীয় উদ্বাস্তু মানুষদের উদ্দেশ্যে নির্মিত তিব্বতীয় রিফিউজি সেলফ হেল্প সেন্টার ঘুরে আসতে পারেন। এখানে তিব্বতীদের সুসজ্জিত হস্তশিল্পগুলোকে স্মারক হিসেবে কিনে নিতে পারেন।
৬. রাতে ঘুরুন ম্যাল, আশপাশে গ্লেনারিজ, কেভেন্টারস ছাড়াও বহু বাঙালি-অবাঙালি রেস্তোরাঁ আছে। এবারে আপনার গন্তব্য কিন্তু কার্শিয়াং।
দ্বিতীয় দিন
অর্কিডের শহর ছোট্ট কার্শিয়াং। সকালে উঠে অলস হাঁটতে বেরিয়ে কার্শিয়াংয়ে একাধিক ছোট রেস্তোরাঁ রয়েছে। সেখানে প্রাতঃরাশ খেতে পারেন।আর নইলে কার্শিয়াং টুরিস্ট লজের সুস্বাদু খাবার খেতে পারেন। এবার বেড়িয়ে পড়ুন। অম্বোটিয়া টি-গার্ডেন, ঈগল ক্র্যাগ ভিউ পয়েন্ট ঘুরে আসুন। এবার লাঞ্চের জন্য পছন্দমতো জায়গা খুঁজে নিন। লাঞ্চ সেরে চলে যান গিদ্দা পাহাড়ে। এখানকার দৃশ্য মনোরম। এখানেও ছবি তোলেন সকলে।
এরপর চলে যান ডাউহিল। এখানকার শতাব্দীপ্রাচীন ভিক্টোরিয়া বয়েজ, ডাউহিল গার্লস দেখার মতো। তাছাড়া এখানকার জঙ্গলে ভূতের গুজব রয়েছে। যাতে দিনের বেলাতেও গা ছমছম করে। এখানে বিকেল পর্যন্ত কাটিয়ে চলে আসুন সেন্ট মেরিজ চার্চে। এবার হোটেলে ফিরে একটু বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যায় দার্জিলিং ফিরে যান। ঘন্টা খানেক লাগবে। রাতে ঘন্টাখানেক ম্যালে ঘোরাঘুরি করার সময় দার্জিলিং চা, কফি উপভোগ করতে পারেন।রাতে খাবার খেয়ে বিশ্রামে চলে যান।
তৃতীয় দিন
সকালে টাইগার হিলে পৌঁঁছে যেতে হবে সূর্য ওঠার আগে। কারণ আপনি দেখবেন সানরাইজ। আকাশ পরিষ্কার না থাকলে অবশ্য মেঘের ছবি তুলে ফিরতে হবে। পরিষ্কার থাকলে কাঞ্চনজঙ্ঘার উপর দিয়ে সূর্য ওঠার দৃশ্য স্বর্গীয় অনুভূতি। সেখানে ঘুরে ছবি তুলে, ব্রেকফাস্ট সেরে নিন। এরপর ঘন্টাখানেক হিমালয়ান মাউন্টেনিং ইনস্টিটিউটে ঘুরে আসুন। সেখানে জানতে পারবেন পর্বতারোহণের খুঁটিনাটি। প্রসিদ্ধ পর্বত আরোহীদের ব্যবহার্য সমস্ত রকম প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম আজও এখানকার সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত আছে। এরপর রোপওয়েতে চড়ার আনন্দ নিতে পারেন। এই রোপওয়ে থেকে চা বাগানের সৌন্দর্য রোমাঞ্চকর লাগে। রোপওয়ে থেকে মাত্র ১ কিমি দূরেই আছে পিস প্যাগোডা। এখান থেকেও হিমালয়ের অসাধারণ দৃশ্যর প্রত্যক্ষদর্শী থাকতে পারেন। এরপর লাঞ্চ করতেও পারেন, না খিদে পেলে বাতাসিয়া লুপে চলে যান। এখানে টয়ট্রেন গরুর গাড়ির চেয়েও ধীরে চলে। ফলে ছবি তোলার জন্য আদর্শ জায়গা। পার্কে সময় কাটিয়ে নিয়ে লাঞ্চ করেন নিন। এরপর বৌদ্ধ মনাস্ট্রি দর্শনের অধ্যাত্ম দর্শনের সঙ্গে একাত্ম হতে চাইলে বাতাসিয়া লুপ থেকে মাত্র ২.০০ কিমি অদূরে ঘুম মনাস্ট্রি পরিদর্শন করে আসতে পারেন। এরপর চলে আসুন চিড়িয়াখানা, রাজভবন দেখতে। ম্যালের কাছেই। সন্ধ্যায় আশপাশে ঘুরুন, কেনাকাটা করুন, ম্যালে ঘুরুন।
চতুর্থ দিন
এরপর দিন সকালে উঠে রওনা হয়ে যান কালিম্পং। দেড় ঘন্টা সময় লাগবে পৌঁছতে। পথে প্রাতঃরাশ সেরে নিতে পারেন, অথবা প্রাতঃরাশ সেরে বেরিয়ে যান। কালিম্পংয়ে এর দর্শনীয় স্থান দূরবীনদারা পাহাড়, দূরপিন মনেস্ট্রি। মনাস্ট্রি থেকে কাছে অনেকগুলো ভিউ পয়েন্ট রয়েছে। ঘুরে নিন।কালিম্পং থেকে মাত্র ২কিমি দূরে অবস্থিত সুডস গার্ডেন রিট্রিট। এখানে দুপুরের আহার সম্পন্ন করে পৌঁছে যান হাটবাজার। প্রত্যক্ষদর্শী থাকতে পৌঁছে যেতে পারেন হাট বাজার। কেনাকাটাও করতে পারেন। বিকেলে চা খেয়ে কালিম্পং থেকে এবার বেড়িয়ে পড়ুন লোলেগাঁও এর উদ্দেশ্যে। কালিম্পং জেলার দৃশ্যসদৃশ একটি ভ্রমণ স্থান হল লোলেগাঁও। কালিম্পঙ থেকে এই ছোট্ট গ্রামটির দূরত্ব প্রায় ২৮ কিমি।
পঞ্চম দিন
লোলেগাঁওতে সময় দিতে হবে। এর আদিম সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে ঘুরে বেড়ান। ফ্লাস্কে চা নিয়ে ঘুরুন। একবেলা গোটাটাই হেঁটে ঘুরে বেড়ান। এখানে খাসমহল-এর ক্যানোপিওয়াক বিখ্যাত। এখানে কাঠের ঝুলন্ত ব্রিজ পরিদর্শন করে আসতে কিন্তু একদম ভুলবেন না। আর ছবি তো বলতে হবে না নিশ্চয়! পরের বেলায় লাভা ঘুরে আসতে পারেন। আর সে পথে ফেরার দরকার নেই। লাভা হয়ে গরুবাথান হয়ে মালবাজার চলে যান। সন্ধ্যায় সরাসরি নিউ মাল জংশন থেকে কলকাতার জন্য কাঞ্চনকন্যা পেয়ে যাবেন। নইলে শিলিগুড়ি ২ ঘন্টা লাগবে পৌঁছে যান। যদি পরদিন বিমানে ফেরার টিকিট থাকে তাহলে বিমানে সেকন্ড হাফে টিকিট রাখুন আর বিমানবন্দরে যাওয়ার আগে সোজা চলে যান শিলিগুড়িতে বেঙ্গল সাফারি পার্কে। এটা এই ক্যাটেগরির ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম পার্ক। মন খুশি হয়ে যাবে।
খরচ
খরচ সব মিলিয়ে গাড়ি ভাড়া বাদ দিয়ে ১০ হাজার টাকার মধ্যে হয়ে যাবে। তবে গাড়ি ভাড়া প্রতিদিন বদলে যায়। দরাদরি করে নিতে হবে। যদি আগে থেকে ফিক্স করে আনেন, তাহলে খরচ অনেকটা কম হবে।
এ ছাড়া রাস্তায় ইচ্ছেমতো বহু জায়গা রয়েছে, যেখানে বাড়তি সময় দিতে ইচ্ছে করবে। উ ত্তরবঙ্গের সমস্ত পাহাড়ে এমন অনেক নাম না জানা ঝোরা, গহ্বর রয়েছে যা আপনাকে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়াতে বাধ্য করবে। এভাবে ঘুরলে আপনি বুক ফুলিয়ে বলতে পারবেন আপনি গোটা দার্জিলিং পাহাড় ঘুরেছেন। তাতে একটুও বাড়িয়ে বলা হবে না। তাহলে আর কী ছুটি দেখুন, আর বেড়িয়ে পড়ুন।