আজ ন্যাশনাল হ্যান্ডলুম ডে। ক্যালেন্ডারে যেমন ফাদার্স ডে মাদারস ডে আসে তেমনি আজ ন্যাশনাল হান্ডলুম ডে। ২০১৫ সালে ৭ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর নরেন্দ্র মোদী আজকের দিনটিকে ন্যাশনাল হান্ডলুম ডে বলে ঘোষিত করে।
কিন্তু নদিয়ার শান্তিপুর-ফুলিয়ার বেশিরভাগ মানুষই হ্যান্ডলুম অর্থাৎ হস্তচালিত তাঁত শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। তাদের জীবন-জীবিকা বলতে একমাত্র তাঁত শিল্প। কিন্তু বর্তমানে এই হস্তচালিত তাঁত বিলুপ্তির পথে। তাঁতি থেকে মহাজন' সকলের মুখেই বিষন্নতার সুর সরকারি সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে না কেউ। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে কলকাতার টাউন হলে এই দিনেই স্বদেশী আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল বিদেশি পণ্য বর্জন করে স্বদেশী পণ্য গ্রহণ।
এর স্মরণেই কেন্দ্রীয় সরকার দেশের হস্তচালিত তাঁতশিল্পকে তুলে ধরতে এবং তাঁতিদের সম্মানের উদ্দেশ্যে ২০১৫ সালে এই দিনটিকে জাতীয় হস্তচালিত তাঁত দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। আর নদিয়ার শান্তিপুরের বিখ্যাত জিনিসের মধ্যে শান্তিপুরের তাঁতের শাড়ি উল্লেখযোগ্য। শান্তিপুরের রাস উৎসবের যতটা খ্যাতি, তাঁতের শাড়ির খ্যাতি তার থেকে কোনও অংশে কম নয়।
জ্যাকার্ড তাঁত আাসার পর থেকেই মাঠা তাঁতের সংখ্যা কমতে থাকে। তারপরে মিল অর্থাৎ পাওয়ার লুম আসার পর মাঠা ও জ্যাকেট তাঁতে, দুটোই হারিয়ে যেতে বসেছে। আর এখন তো কথাই নেই। একটি রেপিয়ার মেশিনে সারাদিনে জামদানির মতো শাড়ি উৎপাদিত হয় কুড়ি-পঁচিশটি, যা জ্যাকার্ড মেশিন এ সময় লাগতো দিন পনেরো, আর হাতে? এক থেকে তিন মাস পর্যন্ত।
তবে সে সময় কদর ছিল। আজও আছে, তা সীমাবদ্ধ গুটিকতক মানুষের মাঝে। বিভিন্ন বাকি আমজনতা আস্থা রেখেছে কম দামে টেকসই বস্ত্রের উপরে। তার উপরে ড্রেস মেটিরিয়ালস হিসাবে নানান অত্যাধুনিক উপকরণ এসেছে তবুও প্রত্যেকের রমনিই স্বীকার করেন, শাড়িতেই সুন্দরী নারী।
শান্তিপুরের সর্বানন্দী পাড়া, কুঠির পাড়া, রামনগর পাড়া প্রভৃতি এলাকা গুলো পুরোপুরি তাঁতশিল্পের ওপরেই নির্ভরশীল ছিল। বাড়ির মহিলারা মূলত মাঠা তাঁত বুনতো। সঙ্গে উক্ত বহু মানুষের পরিবারগুলির অন্নসংস্থানের মূল উৎসই ছিলো তাঁতশিল্প। তখন তাঁতের শাড়ির চাহিদাও ছিল প্রচুর। কিন্তু পাওয়ারলুম আসার পর হ্যান্ডলুম শাড়ির চাহিদা তলানিতে ঠেকেছে। তাই মজুরিও গেছে কমে। স্বাভাবিক ভাবেই বন্ধ হয়ে গেছে বেশিরভাগ হস্তচালিত তাঁত।
যেসব বাড়িতে আগে ন-দশটা করে তাঁত বসানো ছিলো, সেখানে আজ কেনও রকমে হয়তো একটা তাঁতে এসে ঠেকেছে। বাইরে থেকে তাঁতীরা এসে দিনে যেখানে দুটো তিনটে করে শাড়ি বুনতেন....সেখানে আজ ভেঙে নষ্ট হয়ে গেছে সব তাঁত। বিভিন্ন তাঁতশিল্প সমিতি গঠন করে তাঁতীদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়ানোর চেষ্টা করা হলেও কোনও লাভ হয়নি। চাহিদা কমে যাওয়ায় তাঁতের শাড়ির পড়ে যাওয়া বাজারকে চাঙ্গা করা সম্ভব হয়নি।
সরকারি ভাবে তাঁতের শাড়ির কেনাবেচার কিছু ব্যবস্থা করা হলেও প্রত্যন্ত গ্রামের প্রান্তিক তাঁতিদের কাছে সে খবর আর গিয়ে পৌঁছয় না। তাই তাদের অবস্থার আরো অবনতির দিকে। পাওয়ারলুম এসে যে খুব একটা সুরাহা হয়েছে তাও নয়, বেশী শাড়ি উৎপন্ন হলেও চাহিদার তুলনায় জোগান বেশী হয়ে যাওয়ায় সেই শাড়ি নেওয়ার মতো মহাজন পাওয়া যায় না।
তাঁতশিল্পী পরিবার থেকে নতুন জেনারেশনকে আর তাঁতশিল্পের সাথে যুক্ত করানো যাচ্ছে না। মজুরি কমে যাওয়ায় খুব স্বাভাবিক ভাবেই নতুন করে আর কেউ তাঁতে বসতে চাইছে না। যা শাড়ির মজুরি আগে ২৮০ টাকা ছিল। কমতে কমতে সেই মজুরি আজ ১৫০ বা ১০০ টাকায় এসে ঠেকেছে। তাই তাঁত বুনে সংসার প্রতিপালন করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে তাঁতীদের কাছে। এছাড়াও কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর কারণে শান্তিপুরের তাঁতের গুণগত মানেরও পরিবর্তন ঘটেছে।
তাই সবকিছু মিলিয়ে হারিয়ে যেতে বসেছে তাঁতশিল্প। তাঁতিদের সকলের হতাশার সুর ফুটে উঠছে। তবে কি শান্তিপুরের তাঁতের শাড়ি আস্তে আস্তে বিলুপ্তির পথে?