দোরগোড়ায় বিধানসভা নির্বাচন। হাতে আর বেশি সময় নেই। জল মাপতে ইতিমধ্যে ময়দানে নেমে পড়েছে যুযুধান দুই পক্ষই। বিজেপি শিবির দুর্নীতি থেকে তোলাবাজি, সিন্ডিকেট সবেতেই নিশানা করে চলেছে ঘাসফুল শিবিরকে। আর এসবের মাঝেই হিন্দুত্বের ট্রাম্প কার্ডেই বাংলা জয়ের স্বপ্ন দেখছে গেরুয়া শিবির। এদিকে ভারতীয় জনতা পার্টিকে মাত দিতে তাই এবার প্রচারে আঞ্চলিকতাকেই জোড় দিতে চাইছে ঘাসফুল শিবির। তাই 'বাংলার গর্ব ' এটাই হতে চলেছে ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের মূল প্রচার অস্ত্র।
ভারতীয় জনতা পার্টির বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কানি দেওয়ার অভিযোগ তুলে থাকে বিরোধীরা। আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে সেই অস্ত্রেই রাজ্যের হিন্দু ভোটকে একত্রিত করতে চাইছে গেরুয়া শিবির। ভোটব্যাঙ্ক বাড়াতে তৃণমূলনেত্রীর বিরুদ্ধে বিশেষ সম্প্রদায়ের ওপর তোষনের রাজনীতি করার বারবার অভিযোগ তুলেছে বিজেপি। আর এই আবহেই তৃণমূল পাল্টা চাল দিতে চাইছে। এবার তাই বাঙালার গর্ব ও ঐতিহ্য-কে হাতিয়ার করেই বঙ্গের আসন্ন ভোটযুদ্ধে নামতে চাইছে মমতা শিবির।
বাম আমলে সরকারের বিরোধীতাই ছিল তৃণমূল শিবির প্রধান কাজ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল গত ৯ বছর হল বাংলায় ক্ষমতায় থাকলেও এই দলের মতাদর্শ নিয়ে বার বার প্রশ্ন তুলেছে বিরোধী শিবির। এই অবস্থায় গেরুয়া শিবিরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আঞ্চলিকতাকেই হাতিয়ার করতে চাইছে ঘাসফুল। তাই ২০২১ সালের ভোটে উন্নয়নের পাশাপাশি এই বাংলার ঐতিহ্য, ভোটারদের সামনে তুলে ধরাই তাঁদের মূল অ্যাজেন্ডা বলে সংবাদ সংস্থা পিটিআই-কে জানিয়েছেন সাংসদ সৌগত রায়।
আঞ্চলিকতা অবশ্য এদেশের রাজনীতিতে নতুন নয়। তামিলনাড়ুর ডিএমকে বা এআইএডিএমকে, অথবা মহারাষ্ট্রের শিবসেনা রাজ্যবাসীকে আঞ্চলিকতার শুড়শুড়ি দিয়েই ভোট ময়দানে বাজিমাত করেছে। সেই রাস্তাই এবার নিতে চাইছে তৃণমূল। তাই বিজেপি কেন্দ্রীয় নেতাদের এরাজ্যে নিয়োগ করতেই খোদ বহিরগত তত্ত্ব দিয়েছেন তৃণমূলনেত্রী।
তবে বিধানসভার ভোটের ময়দানে এই আঞ্চলিকতা কিন্তু বিজেপির জন্যও নতুন নয়। এনডিএর জোটসঙ্গী জেডি(ইউ) বিহার ভোটে প্রচারের অস্ত্র করেছিল 'বিহারী বনাম বাহারী'। এমনকি বিজেপিও ২০০৭ সালে গুজরাত ভোটে এই আঞ্চলিকতার তাস খেলেছিল। মমতার দলের এক সিনিয়র নেতা জানান, “বিভাজনমূলক রাজনীতি এবং ধর্মীয় মেরুকরণ দিয়ে কখনই উন্নয়নের রাজনীতির সাথে লড়াই করা যায় না। তবে উপ-জাতীয়তাবাদ এবং আঞ্চলিকতা এটি করতে পারে। ”
একসময় কংগ্রেস ভেঙে তৃণমূল গড়ে তোলা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্লোগান ছিল 'মা-মাটি-মানুষ'। যেখানে বামপন্থীদের মোকাবিলা করতে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে সুচারু ভাবে স্লোগানের মধ্যে ফুটিয়ো তোলা হয়েছিল। যার ফলও পেয়েছিল তৃণমূল। ২০১১ সালে বাম জমানার অবসান, আর ২০১৬ সালে আরও আসন বাড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গের মসনদে ফিরে আসা। তবে বঙ্গ রাজনীতিতে বিজেপির উত্থান সমাজতন্ত্রের স্লোগান তোলা তৃণমূলকে সেই পথ থেকে এবার সরতে বাধ্য করছে। একদা সংখ্যালঘুদের তোষনের অভিযোগ ওঠা তৃণমূলনেত্রীও তাই নিজের পরিকল্পনা বদলের পথেই হাঁটছেন। ৩০ শতাংশ সংখ্যালঘু মুসলিম অধ্যুষিত বাংলায় বিজেপির সাম্প্রদায়িক নীতির কার্যকারিতা নেই বলে একদা মনে করা হলেও গত লোকসভার ফলাফল সব হিসাব নিকাশ উল্টে দিয়েছে। তাই ২০১৯-এর ভোটে ১৮টি আসন দখলের পাশাপাশি আরও বেশ কয়েকটি আসনে তৃণমূলকে জোড় লড়াই দিয়েছে গেরুয়া শিবির।
গত লোকসভা ভোটের শেষপর্বে প্রচারে সেই আঞ্চলিকতাকেই ব্যবহার করতে চেয়েছিল তৃণমূল। অমিত শাহের উত্তর কলকাতায় জনসভার দিন বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙাকে কেন্দ্র করে তুলকালাম বাঁধে। যার দায় বহিরাগত বিজেপির ওপর চাপিয়েছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্যে ৭০ শতাংশ হিন্দু ও ৩০ শতাংশ মুসলিম ভোটের বদলে তাই ৮৬ শতাংশ বাঙালি ভোটের কথা বলছে তৃণমূল নেতৃত্ব। বাঙালি জাতীয়তাবাদ উস্কেই সেই ভোটব্যাঙ্ক নিজেদের ঘরে তুলতে চাইছে তৃণমূলশিবির। তাই তৃণমূলের ছোট-বড় সব নেতাই বিজেপির বিরুদ্ধে বহিরাগত বলে আক্রমণ শানিয়ে চলেছেন।
বহিরাগত তত্ত্বে বিজেপিকে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করার কৌশল নিয়েছে তৃণমূল। এই ইস্যুতে বিজেপিকে বিঁধেছেন রাজ্যের মন্ত্রী ব্রাত্য বসু। তৃণমূল নেতার কথায়, ত্রিপুরা কংগ্রেসের পর সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে যা করা হয়েছিল তারই কি পুনরাবৃত্তি মমতার সঙ্গে হয়নি? মমতাকে সুভাষের মতো লড়াই করতে হয়েছে। আজাদ হিন্দ ফৌজ তৈরি করতে হয়েছে, তার নাম তৃণমূল কংগ্রেস। তাঁকে নিয়ন্ত্রণ করতে পশ্চিম ও উত্তর ভারত থেকে লোক পাঠাতে হচ্ছে বিজেপিকে। ব্রাত্য প্রশ্ন, আমাদের মাথার উপরে অন্য রাজ্য থেকে কি মুখ্যমন্ত্রী বসানো হবে? অন্য রাজ্য থেকে রাজনৈতিক নেতা বসানো হবে?
অন্যদিকে বহিরাগত ইস্যুতে তৃণমূলকে পাল্টা আক্রমণ করতে ছাড়ছে না গেরুয়া শিবিরও। ময়দানে নেমেছেন বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। দিলীপবাবুর কথায়, দলের প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় নিজেই যেখানে বাঙালি, সেখানে বহিরাগত তত্ত্ব কীভাবে তোলেন তৃণমূলনেত্রী। একই দেশের মধ্যে বসবাস করা মানুষকে এভাবে ভাগাভাগি করা নিয়ে তৃণমূলনেত্রীকে নিশানা করেছেন বিজেপির কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীও। আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ নিয়ে মমতাকে আক্রমণ করেছেন কংগ্রেসের রাজ্য সভাপতি তথা লোকসভার নেতা অধিররঞ্জন চৌধুরীও।
এর আগে ভোট ময়দানে নামতে চলতি বছরের শুরুতেই ‘বাংলার গর্ব মমতা’ কর্মসূচি নিয়েছিল তৃণমূল। কিন্তু ধীরে ধীরে সেখান থেকে এবার কী আঞ্চলিকতাতে নিজেদের কেন্দ্রীভূত করবে ঘাসফুল শিবির? এমন প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিনটি জাতীয় ছুটি করার আর্জি জানিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ইতিমধ্যে নেতাজির ১২৫তম জন্মবার্ষিকী এক বছর ধরে পালনের জন্য বিশেষ কমিটি গঠন করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গোটা কর্মসূচি সরাসরি দেখভাল করতে চান বলে কমিটির চেয়ারপার্সন হয়েছেন নিজেই। যেখানে অমর্ত্য সেন থেকে অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ থেকে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়— একঝাঁক বিশিষ্ট বাঙালিকে সামিল করা হয়েছে কমিটিতে। বহিরাগত তকমা দেওয়া বিজেপির হিন্দুত্বের অস্ত্রের বিপরীতে তিনি যে বাঙালিয়ানাতেই ভরসা রাখতে চাইছেন, তাই যেন ইজ্ঞিত দিচ্ছেন তৃণমূলনেত্রী।