আফগানিস্তান দখল করে নিল তালিবান। গোটা দুনিয়া স্রেফ হতবাক হয়ে দেখল। ১৫ অগাস্ট যখন গোটা ভারত স্বাধীনতা দিবসের আনন্দে মসগুল, তখন কাবুল দখল করে নাগরিকদের স্বাধীনতার উপরে কব্জা করল। গত ৩ মাস ধরে চলা টানা লড়াইয়ে কন্দহর, জালালাবাদ, গজনি সহ একের পর এক আফগান প্রদেশ দখল করলেও এত দ্রুত ও সহজে তালিবানরা কাবুল দখল করবে, স্বপ্নেও ভাবেনি বিশ্ব। রবিবার সকালে তালিবান জঙ্গিরা হঠাত্ কাবুলে প্রবেশ করে এবং তালিবান সরকার ও সেনা আত্মসমর্পণ করে। আমেরিকা সহ বিশ্বের প্রায় সব কটি দেশ তাদের কূটনাতিকদের হেলিকপ্টারে তড়িঘড়ি দেশে ফেরাচ্ছে, এ দৃশ্য দেখল গোটা দুনিয়া।
আরও পড়ুন: তালিবান কব্জায় আফগানিস্তান! ভারতের দুশ্চিন্তা কেন বাড়ছে?
মেশিনগান, রকেট লঞ্চার নিয়ে কাবুল দখল করল তালিবান। বগরম বিমানঘাঁটি, বগরম জেল, সব এখন তালিবানদের দখলে। কাবুল শহরের প্রবেশদ্বার, সব সরকারি ভবন দখলের পরে তালিবানদের ভয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন আফগান রাষ্ট্রপতি অশরফ গনি। তালিবান মুখপাত্র ঘোষণা করেছে, তালিবান যোদ্ধারা আইনশৃঙ্খলা ও পুলিশকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনছে। একই তিনি বলেন, তালিবানদের ভয় নেই। দেশের সাধারণ মানুষের সুরক্ষা তাঁরা নিশ্চিত করবেন। যদিও নাগরিকরা ভয়েই রয়েছেন। যার নির্যাস, কাবুল থেকে বেরনোর সব রাস্তায় ব্যাপক ট্র্যাফিক জ্যাম চোখে পড়ে দিনভর। সবাই কাবুল ছেড়ে পালাচ্ছেন।
আরও পড়ুন: Shocking VIDEO: প্লেনের চাকায় ঝুলে কাবুল থেকে পালানোর চেষ্টা! আকাশ থেকে পড়ে মৃত ২
ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য মোল্লা আব্দুল গনি বেরাদর কাবুলে
আফগান সরকার ও সেনাকে আত্মসমর্পণ করতে দেখেই আব্দুল গনি বেরাদর দোহা থেকে সোজা কাবুলে পৌঁছে গিয়েছেন। আফগান প্রেসিডেন্ট আশরফ গনির সঙ্গে কথা হয়েছে তাঁর। তারপরেই আশরফ গনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। প্রথমে তাজিকিস্তানের উদ্দেশে রওনা হন। তাজিকিস্তানে আশরফের বিমান নামতে দেওয়া হয়নি। তারপর ওমান চলে যান। সূত্রের খবর, আশরফ চেষ্টা করছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পালানোর। ঠিক ২০ বছর আগে আফগানিস্তান তালিবানদের দখলে ছিল। সেই সময়ের ভয়াবহতা দেখেছে দেশটির নাগরিক। তাই এ বারও রীতিমতো আতঙ্কে গোটা আফগানিস্তান।
কাবুল ছেড়ে পালানোর হিড়িক
প্রেসিডেন্ট আশরফ গনি ইতিমধ্যেই পালিয়েছেন। এবার কাবুল সহ গোটা আফগানিস্তান প্রাণ বাঁচিয়ে পালানোর চেষ্টা করছে। কাবুল বিমানবন্দরে কাতারে কাতারে ভিড়। কাবুল থেকে ছাড়া একটি প্লেনের চাকায় বসে পালানোর চেষ্টা করছিলেন দুজন। প্লেন আকাশে উড়তেই তাঁরা পড়ে যান, দুজনেরই মৃত্যু হয়েছে। আফগানিস্তান বায়ুসেনার পাইলট মেজর রহমন রহমানি বলছেন, এখন তালিবানরা বলছে, সবাই শান্তিতেই থাকবে দেশে। কিন্তু মাস খানেক বাদেই তারা দাঁত-নখ বের করবে। মানুষ মারবে। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেবে।
কী ভাবে শুরু হল আফগানিস্তানের এই সঙ্কট?
ইতিহাসের পরিহাস বললে অত্যুক্তি হয় না! একসময় রাশিয়ার সমর্থনে জহির শাহ আধুনিকতার পথে এগিয়ে চলা আফগানিস্তান ১৯৯০-এর দশকে তালিবানি মধ্যযুগীয় শাসন দেখেছে। এরপর ৯/১১ হামলার পরে আমেরিকার ন্যাটো বাহিনী আফগানিস্তান থেকে তালিবান শাসনকে খতম করে। ২০২১ সালের এপ্রিলে আমেরিকার ঘোষণা করে, আফগানিস্তান থেকে তাদের সেনা সম্পূর্ণ ভাবে সরিয়ে দেওয়া হবে। এরপর থেকেই তালিবানরা ফের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। যার নির্যাস, আজকের অবস্থা। তালিবানরা জানিয়ে দিয়েছে, গোটা আফগানিস্তানে শরিয়ত আইন লাগু হবে।
তালিবান কারা? কতটা শক্তিশালী?
আফগানিস্তান থেকে রাশিয়ার সেনা ফিরে যাওয়ার পরে ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে উত্তর পাকিস্তানে তালিবানরা মাথাচাড়া দেয়। পাস্তু ভাষায় তালিবানের মানে হল, সেই ছাত্র, যারা কট্টর ইসলামিক শিক্ষায় শিক্ষিত। বলা হয়, সুন্নি ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত বিশিষ্ট ব্যক্তিরা পাকিস্তানে তালিবানি চিন্তাধারার প্রবর্তন করেছিল। তালিবানের উপরে দেওবন্দি বিচারধারার প্রভাব ব্যাপক। শুরুর দিকে তালিবানরা ঘোষণা করেছিল, ইসলামি এলাকায় বিদেশি শাসন শেষ করতে হবে। সেখানে শরিয়ত আইন লাগু দরকার। সেটাই তাদের লক্ষ্য। এবং ইসলামিক রাজ্য। শুরুর দিকে আফগানিস্তানে সামন্ত অত্যাচার, আধিকারিকদের দুর্নীতি দেখে তালিবানদের ঈশ্বরের দূত ভেবেছিলেন অনেকেই। কিন্তু তালিবানরা যে কী ভয়াবহ, তা যখন আফগানিস্তানের মানুষ বুঝতে পারলেন, তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। তালিবানরা তখন ব্যাপক শক্তি বাড়িয়ে নিয়েছে।
আমেরিকা-রাশিয়ার ঠান্ডা যুদ্ধ
শুরুর দিকে আফগানিস্তানে রাশিয়ার প্রভাব শেষ করার জন্য তালিবানদের পিছনে মার্কিন সমর্থন ছিল বলে মনে করা হয়। কিন্তু 9/11 হামলার পরে আমেরিকা বুঝতে পারে, বড় ভুল করেছে। তালিবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু কাবুল, কন্দহরের মতো কয়েকটি বড় শহর ছাড়া আফগানিস্তানকে তালিবান মুক্ত করতে ২০ বছরেও পারেনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র শক্তিরা। বিশেষ করে পাক-আফগান সীমান্তে দুর্গম অঞ্চলে তালিবানদের সমর্থন যোগাতে থাকে পাকিস্তান। আজ যখন ন্যাটো তাদের সেনা সরিয়ে ফেলল, তালিবানরা আবার আফগানিস্তান দখল করল।
২০ বছর পরে হঠাত্ এতটা শক্তিশালী কী করে হয়ে উঠল তালিবানরা?
২০০১ সালে ন্যাটো বাহিনীর জেরে তালিবানরা আফগান-পাকিস্তান সীমান্তে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় সীমাবদ্ধ ছিল। ২০১২ সালে ন্যাটো ঘাঁটিতে হামলার পরে তালিবানরা ফের শক্তি সঞ্চয় করতে শুরু করে। ২০১৫ সালে আফগানিস্তানে সামরিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ কুন্দুজ দখলে নিয়ে প্রত্যাবর্তনের সঙ্কেত দেয় তালিবান। এমন একটি সময়, যখন আমেরিকার সেনা ফেরানোর দাবি জোরাল হচ্ছে। আফগানিস্তান নিয়ে আমেরিকা ঢিলে মনোভাব দেখাতে শুরু করে, এদিকে বাড়তে থাকে তালিবানরা। তালিবামদের পাশে দাঁড়ায় পাকিস্তান, আইএসআই ও একাধিক জঙ্গি সংগঠন।
২০২০ সালে আমেরিকা আফগানিস্তান থেকে সেনা ফেরানোর কথা ঘোষণা করে। তার প্রক্রিয়াও শুরু করে দেয়। ২০২১ সালের এপ্রিলে আমেরিকার সেনা ফেরানোর পরে, ৯০ হাজার তালিবান জঙ্গি ৩ লক্ষের বেশি আফগান সেনাকে আত্মসমর্পণ করাতে বাধ্য করা হয়। প্রেসিডেন্ট আশরফ গনিকে তাজিকিস্তান ও ইরানের শরণাপন্ন হতে হয়।