কত বছর তাদের নিজেদেরও মনে নেই। শেষ কবে তারা নিজের ইচ্ছেমতো প্রার্থীকে ভোট দিতে পেরেছিলেন স্মৃতি হাতড়েও মনে করতে পারেন না আজকের মাঝবয়সি সুমতি লামা, বিনয় ছেত্রী, অনিল ইয়ংজনরা। প্রত্যেকেই পঞ্চাশ পেরিয়েছেন। তবু তাদের মনে হচ্ছে যেন এই প্রথম। কোন হুইপ জারি নেই। কোথাও কোনও গোলমাল কিংবা গা জোয়ারি নেই ।
পাহাড়ের তিনটি বিধানসভা দখলের চেষ্টায় আর পাঁচটা জায়গার মতো অবশ্য প্রচার ছিল, একাধিক দলের মিটিং-মিছিল তাও হয়েছে স্বমহিমায়। একদা দোর্দণ্ডপ্রতাপ বিমল গুরুং এর দলের প্রার্থীরা যেমন তৃণমূলের সাহায্য নিয়ে ভোটে লড়েছেন, তেমনই তাদের একসময়ের সহযোগী বর্তমানে বিনয় তামাং গোষ্ঠীও প্রার্থী দিয়েছেন নিজের পছন্দমত। আবার এ রাজ্যে নিজেদের জমি খুঁজে ফেরা বিজেপি এবং সহযোগী জিএনএলএফ, তারাও তো ভাগ্য অন্বেষণে নেমেছেন পাহাড়ে। ফলে পাহাড়ের আগের ঘটনাবলী ও পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে আশঙ্কা করা হচ্ছিল পাহাড়ে নির্বাচনে বোধহয় হিংসা ছড়াতে পারে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের বোকা প্রমাণ করে সবচেয়ে গণতান্ত্রিক ভাবে ভোট প্রক্রিয়া সেরে ফেলে গোটা রাজ্যের মধ্যে নজির করেছেন বিমল-বিনয়-নীরজ জিম্বারা। এমনকী শান্তি এবং সদ্ভাব এর জায়গা বলে পরিচিত শিলিগুড়িতেও বিক্ষিপ্ত হাতাহাতির ঘটনা ঘটলেও পাহাড়ে তেমন কিছু হয়নি। যা রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ মহলকে নতুন করে ভাবাতে শুরু করেছে।
ফলে দীর্ঘ তিন দশকেরও বেশি সময় পরে পাহাড়ে ফের গণতান্ত্রিক আবহাওয়া। অন্যান্য যারা আগেও এভাবে ভোট দিয়েছেন, তাদের সঙ্গে সিংহভাগ ভোটার, যারা প্রথমবার একদলীয় চোখ রাঙানির বাইরে ভোটের লাইনে দাঁড়িয়েছেন, প্রত্যেকের মুখেই যুদ্ধ জয়ের হাসি। প্রতিটি কেন্দ্রে হয়তো একজন প্রার্থী জিতবে, কিন্তু পাহাড়ের মানুষের কাছে সে সব এখন পিছনের সারিতে। তাদের জয় যে সম্পূর্ণ হয়েছে। ষাটের দশকে জিএনএলএফ সুপ্রিমো সুভাষ ঘিসিংয়ের অঙ্গুলিহেলনে পাহাড়ের মানুষ জীবনযাপন করেছেন। তার নির্দেশেই হয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে মানুষের দৈনন্দিন রোজনামচা। আর সেই ক্ষমতা ধরে রাখতে হলে স্বাভাবিকভাবেই নির্বাচন প্রক্রিয়া প্রভাবিত করার পরিকল্পনা দরকার। যা দীর্ঘদিন ধরে সফলভাবে চালিয়ে গিয়েছেন সুভাষবাবু। তাঁরই শেখানো গুরুমারা শিক্ষায় তাকে পাহাড়ছাড়া করে যখন ক্ষমতায় এলেন বিমল গুরুং, খুললেন নতুন দল গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা,ভাবা গিয়েছিল পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে। কিন্তু গোটা দেশ তাকিয়ে দেখল সুভাষ ঘিসিংয়ের পথেই পাহাড়কে দখলে রাখতে মরিয়া ছিল বিমল। পরবর্তীতে ভুল পদক্ষেপ এবং সরাসরি রাজ্যের সঙ্গে সংঘাতে গিয়ে নিজের রাজ্যপাট হারালেন তিনি। সেই সঙ্গে নিজের দল থেকেও তিনি বিতাড়িত হন। তাঁর জায়গায় সভাপতি হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করলেন বিনয় তামাং। যদিও বিমলের দাবি তাঁর দল তাঁরই রয়েছে। বিনয়রা যতই দাবি করুন না কেন, তিনিই প্রকৃত মোর্চা। সে বিতর্ক থাক। কিন্তু সেই সুযোগে পাহাড়ের নিজেদের শক্তি বাড়িয়েছে জিএনএলএএফ। সঙ্গে দোসর বিজেপি। ফলে এবারের নির্বাচনে প্রার্থী একাধিক হলেও মূল লড়াই হয়েছে ত্রিমুখী। আপাতত তিন গোষ্ঠীই আশাবাদী জয়ের ব্যাপারে। তবে যেই জিতুক পাহাড়ে শান্তিপূর্ণ ভোটের নয়া নজির গড়ে বিশেষজ্ঞদের ভুল প্রমাণ করে এখন পাহাড়ের সব রাজনৈতিক দলই হিরোর মর্যাদা পাচ্ছে।