scorecardresearch
 

ভোট ময়দানে এবার 'ঘরের মেয়ে' কে?, 'দিদি'-কে হারাতে সেই আবেগের রাজনীতিই ভরসা BJP-র

সরকারি তথ্য অনুসারে, রাজ্যের ৭.৩২ কোটি ভোটারের মধ্যে ৪৯ শতাংশই মহিলা। বিগত দুটি বিধানসভা নির্বাচনে, ভোটদানের দিনে নারীদের ভোটদানের হার পুরুষদের তুলনায় বেশি ছিল। বিজেপি ও তৃণমূল দুই দলের মিটিং, মিছিলে তাই বারবার ঘুরে ফিরে আসছে সেই ‘মহিলা’ প্রসঙ্গ। বিজেপি যেমন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনপ্রিয়তায় রাশ টানতে একাধিক পন্থা অবলম্বন করছে, তেমনই তৃণমূল সুপ্রিমো নিজেকে ‘বাংলার মেয়ে’ প্রতিষ্ঠিত করেই সেই জনপ্রিয়তায় কুর্সি দখলের পরিকল্পনা জারি রাখছেন। তবে সেই লড়াইয়েও এবার তাঁর সামনে দলের মহিলা বাহিনীকেই দাঁড় করাচ্ছে গেরুয়া শিবির। নারী স্বাধীনতার যুগে তবে কি মহিলা ভোট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে চলেছে এবারের নির্বাচনে?

Advertisement
Mamata Banerjee Mamata Banerjee
হাইলাইটস
  • একা এক মহিলাকে ভয় পাচ্ছে বিজেপি
  • এমন দাবি কের থাকেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
  • একুশের রণনীতিতে কিন্তু অন্যতম ভূমিকা নিতে চলেছে ‘মহিলারাই’

একুশের ভোটে তৃণমূল নেমেছে এক অন্য অভিযানে। যেখানে এককালের অগ্নিকন্যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়  ‘দিদি’ থেকে ‘দুহিতা’ হয়ে উঠেছেন। তৃতীয়বার বাংলার মসনদে বসতে 'বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়' এই স্লোগানে ভরসা রাখতে চাইছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যা। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে দলীয় জনসভা ছয়লাপ হয়েছে ঘাসফুলের এই স্লোগানে। সুচারু ভাবে বিজেপির বিহারগত তকমাকে এভাবে আরও শিলমোহর দিতে চাইছেন তৃণমূলনেত্রী। বাংলার নির্বাচনের আগে বাঙালি আবেগকে হাতিয়ার করতে চাইছে তৃণমূল। তাঁদের প্রচারের বড় অংশ জুড়ে রয়েছে বাংলা বনাম বহিরাগত তত্ত্ব। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতাদের ‘বহিরাগত’ বলে আক্রমণ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘ঘরের মেয়ে’ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছে রাজ্যের শাসকদল। এবারের ভোটের রাজনীতিতে তিনি যে একা মহিলা হয়ে লড়াই করছেন এই আবেগ বারবার উস্কে দিতে চাইছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার আট দফায় ভোট ঘোষণার পরেই, তৃণমূলনেত্রীর প্রতিক্রিয়া ছিল,  'বিজেপি একা এক মহিলাকে এত ভয় পাচ্ছে কেন?' এদিকে তৃণমূলনেত্রীর ভোট ময়দানে এই একাকী মহিলার ছবিটাকেই এবার পাল্টে দিতে চাইছে গেরুয়া শিবির। তাই তারাও ভরসা রাখছে সেই নারী শক্তির উপরেই। এবারের বঙ্গভোটে জাতপাত, ধর্মীয় ইস্যুর মত এই মহিলা আবেগ উস্কেও ভোট বৈতরণী পেরোতে চাইছে দুই শিবিরই।

‘দিদি’ থেকে ‘ঘরের মেয়ে’ হয়েছেন মমতা
‘দিদিকে বলো’, ‘বাংলার গর্ব মমতা’ আগেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে এমন ধরণের স্লোগান তৈরি হয়েছে তৃণমূলে। তবে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে  মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জয়ের লক্ষ্যে এবার 'বাংলার মেয়ে' হয়ে উঠতে চাইছেন। বিরোধী নেত্রী হিসেবে তিনি ছিলেন 'অগ্নিকন্যা'। মহিলা নেত্রী হিসাবে দাঁত কামড়ে পড়ে থেকেছেন রাজনীতির ময়দানে। আর বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হয়ে ওঠার পর 'বাংলার দিদি', 'বাংলার মা', 'বাংলার গর্ব' অনেক কিছুই হয়েছেন। এবার তিনি হতে চাইছেন 'বাংলার ঘরের মেয়ে'।

Advertisement

কেন মমতা চাইছেন ‘ঘরের মেয়ে’ হতে?
কিন্তু কেন ‘বাংলার গর্ব মমতা' হঠাৎ করেই ‘বাংলার ঘরের মেয়ে' হয়ে উঠতে চাইলেন? বাংলার প্রশাসনিক প্রধান হিসাবে ‘দিদি’কে তুলে ধরা হয়েছে সব সমস্যা সমাধানের উপায় হিসাবে। ‘দিদিকে বলো’-র বার্তাটি ছিল, তাঁর কাছে গেলে সব সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু ভোটের আগে তৃণমূলনেত্রী ভোটপ্রার্থী। যে কারণেই তিনি হলেন ‘বাংলার নিজের মেয়ে’। একুশের কুরুক্ষেত্র জেতার জন্য ভোটমুখী বাংলায় তাই স্লোগান তুলেছে তৃণমূল- এবার ‘বাংলা নিজের ঘরের মেয়েকেই চায়'। 

 

অগ্নিকন্যা আর নন এবার তিনি ঘরের মেয়ে
অগ্নিকন্যা আর নন এবার তিনি ঘরের মেয়ে

এই স্লোগানের মাহাত্ম্যটা ঠিক কী?
 বুঝেশুনেই শব্দ বাছাই করেছেন তৃণমূলনেত্রী। এবারের ভোটে বিজেপিরে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে বহিরাগত ইস্যুতে বারবার আক্রমণ করছেন মমতা। আর এবারের স্লোগানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তথা ঘরের মেয়ের কোনও বিকল্প নেই , এই বার্তাই দেওয়া হচ্ছে। বার্তাটি অনেকটা এরকম যে, বাংলা মমতার হাতেই সুরক্ষিত, বাংলার কৃষ্টি-সংস্কৃতি ঘরের মেয়েই ধরে রাখবে। বাংলার মেয়ে তাই বাংলাকে চেনেন মমতা, এই বার্তার পাশাপাশি মেয়ে এই শব্দটাতেও জোর দিতে চাইছে তৃণমূল। বাংলা তার মেয়েকেই চায় স্লোগানের মধ্যেই লুকিয়ে আছে তাঁকে কেন চায় এবং কাকে চায় না, সেই বার্তাও।

বিজেপিরও ভরসা ‘‌বাংলার মেয়ে’‌ 
মমতার মেয়ে হয়ে ওঠার এই আবেগের খেলায়  কৌশলগত চাল চেলেছে বিজেপিও। হ্যাঁ, 'বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়'। তৃণমূলের সুরে 'সুর মিলিয়ে' বলছে এবার ভারতীয় জনতা পার্টিও! 'বাংলা তার মেয়েকেই চায়, পিসিকে নয়!‌’‌ ভোটমুখী বাংলায় তৃণমূলকে জবাব দিতে পাল্টা স্লোগান নিয়ে এসেছে রাজ্য বিজেপি। গোটা রাজ্য যখন তৃণমূলের ‘‌বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়’‌ হোর্ডিংয়ে ভরে গেছে। তখনই বিজেপিও সেই আবেগকেই পুঁজি করতে চাইছে।  ৯ জন বাংলার মেয়ের ছবি সহ বিজেপির হোর্ডিং এসছে। যে হোর্ডিংয়ে থাকছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দেবশ্রী চৌধুরী, সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায়, রূপা গঙ্গোপাধ্যায়, ভারতী ঘোষ, মেহফুজা খাতুন, শ্রীরূপা মিত্র চৌধুরী, তনুজা চক্রবর্তী, ফাল্গুনি পাত্র, অগ্নিমিত্রা পালদের ছবি।  ভোটের উত্তাপ শুধু নয়, স্লোগানেও তপ্ত হচ্ছে ভোটমুখী বাংলা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বার বার চ্যালেঞ্জ করছেন, 'বিজেপি একা এক মহিলাকে এত ভয় পাচ্ছে কেন?' মমতার বিরুদ্ধে তাই সেই নারী শক্তিকেই এগিয়ে দিচ্ছে গেরুয়া শিবির।

 

বিজেপির প্রচার হাতিয়ার
বিজেপির প্রচার হাতিয়ার

এবার ময়দানে 'ইনি কি বাংলার মেয়ে নন?' 
উত্তর দমদম পুরসভার ৬ নং ওয়ার্ডে বিজেপি কর্মীর বাড়িতে ঢুকে তাঁর অশীতিপর বৃদ্ধা মাকে বেপরোয়া মারধরের অভিযোগ উঠেছে  তৃণমূল কর্মীদের বিরুদ্ধে। ৮৫ বছরের  বৃদ্ধাকে মারধরের এই ঘটনা রাজ্য রাজনীতিতে ঝড় তুলেছে।  ট্যুইটারে তৃণমূলের ভোট প্রচারের স্লোগান 'বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়'কে সামনে রেখে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এই নিয়ে নিশানা করেছেন বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী। শুভেন্দুর কটাক্ষ, 'নিজেকে বাংলার মেয়ে বলে দাবি করেন মুখ্যমন্ত্রী, আর তার শাসনেই বাংলার মায়েরা আজ অসুরক্ষিত।তাই বাংলার মা-বোনেদের সম্মান ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন আসল পরিবর্তন।'দলীয় কর্মীর বৃদ্ধা মায়ের উপর এই হামলাকে এবার ভোটের প্রচারেও সুচারু ভাবে কাজে লাগাতে চাইছে গেরুয়া শিবির। রাতারাতি বিজেপি কর্মী গোপাল মজুমদারের মা হয়ে উঠেছেন বিজেপির প্রচারের মুখ। অসহায় নিগৃহীতা বৃদ্ধার পোস্টারে ছেয়ে গিয়েছে শহর কলকাতা। তৃণমূলনেত্রী তাঁর সরকারকে 'মা মাটি মানুষের' সরকারের বলে থাকেন। সেই 'মা'-আবেগকেই এবার উস্কে দিল বিজেপি।

 

শহর জুড়ে এখন এই পোস্টার চোখে পড়ছে
শহর জুড়ে এখন এই পোস্টার চোখে পড়ছে

ভারতে যেকজন জাদরেল মহিলা রাজনীতিক রয়েছেন তাঁদের মধ্যে এখনও সক্রিয় রয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই। জয়ললিতা প্রয়াত হয়েছেন। মায়াবতীর হাতে ক্ষমতা নেই। সনিয়া গান্ধী কংগ্রেসের কার্যনির্বাহী সভাপতি থাকলেও তিনি যথেষ্টই অসুস্থ। একমাত্র তৃণমূললনেত্রীই এখনও পরাক্রমের সঙ্গে নিজের রাজ্যপাট চালাচ্ছেন। একুশের ভোটে তিনি ক্ষমতায় ফিরবেন কিনা তার জবাব পেতে আর দু'মাস অপেক্ষা করতে হবে। বিরোধী আসনে যখন ছিলেন মমতা তখন অগ্নিকন্যা হিসাবেই নিজের আলাদা ইমেজ তৈরি করেছিলেন। গত ১০ বছর হল তিনি প্রশাসন চালাচ্ছেন। ভূমিকা পাল্টেছে। তাই একসময় কথায় কথায় বনধ ডাকা মমতা আজ সরে এসেছেন বনধের রাজনীতি থেকে।  মুখ্যমন্ত্রীপদে যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এলেন, মহিলা হিসেবে জনপ্রিয়তা তখনও তুঙ্গে ছিল, এখনও রয়েছে। যদিও এই বিষয়টিকে এর আগে কখনও গুরুত্ব দিয়ে দেখা না হলেও একুশের রণনীতিতে কিন্তু অন্যতম ভূমিকা নিতে চলেছে ‘মহিলারাই’। 

Advertisement

সরকারি তথ্য অনুসারে, রাজ্যের ৭.৩২ কোটি ভোটারের মধ্যে ৪৯ শতাংশই মহিলা। বিগত দুটি বিধানসভা নির্বাচনে, ভোটদানের দিনে নারীদের ভোটদানের হার পুরুষদের তুলনায় বেশি ছিল। বিজেপি ও তৃণমূল দুই দলের মিটিং, মিছিলে তাই বারবার ঘুরে ফিরে আসছে সেই ‘মহিলা’ প্রসঙ্গ। বিজেপি যেমন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনপ্রিয়তায় রাশ টানতে একাধিক পন্থা অবলম্বন করছে, তেমনই তৃণমূল সুপ্রিমো নিজেকে ‘বাংলার মেয়ে’ প্রতিষ্ঠিত করেই সেই জনপ্রিয়তায় কুর্সি দখলের পরিকল্পনা জারি রাখছেন। তবে সেই  লড়াইয়েও এবার তাঁর সামনে দলের মহিলা বাহিনীকেই দাঁড় করাচ্ছে গেরুয়া শিবির। নারী স্বাধীনতার যুগে  তবে কি মহিলা ভোট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে চলেছে এবারের  নির্বাচনে? তৃণমূল-বিজেপির ঘরের মেয়েকে নিয়ে লড়াইয়ে সেই প্রশ্ন কিন অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন। 

 

Advertisement