রাজ্য রাজনীতিতে হঠাৎ করেই ফের শিরোণামে কাঁচড়াপাড়ার রায় পরিবার। ঘটনা প্রবাহ যেদিকে এগোচ্ছে তাতে হাল ধরতে ময়দানে নামতে হয়েছে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে। মুকুল রায়ের স্ত্রীর অসুস্থতা আর তাই নিয়ে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সক্রিয়তাই এখন বঙ্গ রাজনীতির আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। আর এই আবহে কালীঘাটের বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার কী করছে সেদিকেও নজর রাখছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। সূত্রের খবর, একদা তৃণমূলের অঘোষিত ‘নাম্বার-টু’কে দলে ফেরাতেও নাকি তেমন আপত্তি নেই তৃণমূলনেত্রীর। সেই বার্তাই নাকি একুশের ভোটের ময়দানে দিয়ে রেখেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর বুধবার অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাইপাস সংলগ্ন হাসপাতালে মুকুল জায়াকে দেখতে যাওয়া সেই জল্পনাকেই আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
ভোট ময়দানেই মুকুলের প্রশংসা মমতার
একুশের ভোটে নন্দীগ্রাম থেকে লড়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যেখানে তাঁর প্রতিপক্ষ ছিলেন একদা সহযোদ্ধা শুভেন্দু অধিকারী। আর ভোটযুদ্ধের মাঝে নন্দীগ্রামে শেষবেলার প্রচারে প্রাক্তন সৈনিক মুকুল রায়ের রীতিমতো প্রশংসা করতে দেখা গিয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে মুকুল রায়ের তুলনা টেনে তৃণমূল সুপ্রিমো বলেছিলেন, 'মুকুল শুভেন্দুর মতো এত খারাপ নয়।' এতেই শেষ নয়, মুকুল রায়কে কৃষ্ণনগর উত্তরে-র টিকিট দেওয়া নিয়েও মুখ খুলেছিলেন মমতা। বলেছিলেন, 'মুকুল বেচারা থাকে কাঁচরাপাড়ায়। ব্যারাকপুর, জগদ্দল, ভাটপাড়া, এসব এলাকায় না দিয়ে ওকে পাঠিয়েছে কৃষ্ণনগরে।'
একদা তৃণমূলের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড
২০১৭ সালের নভেম্বরে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেন মুকুল রায়। সেই সময়ে এই ঘটনা শোরগোল ফেলে দিয়েছিল। তৃণমূলে থাকাকালীন মুকুলকে দলের অঘোষিত 'সেকেন্ড ইন কমান্ড' বলা হত। কিন্তু শেষের দিকে দলে থেকেও তৃণমূল নেত্রীর সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছিল বাংলার চাণক্য হিসেবে পরিচিত মুকুলের। এরমধ্যে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিপত্তি বৃদ্ধিও নাকি একটি কারণ বলে দাবি করা হয়। সে যাই হোক মুকুল শিবির বদল করতেই ঘাসফুলের অনেক নেতাও পদ্মগামী হন। বলা হয় ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির ভাল ফলের ক্ষেত্রে অবদান রয়েছে মুকুল রায়ের। অর্জুন সিং, সৌমিত্র খাঁ, অনুপম হাজরারা মুকুলের হাত ধরেই দলবদল করেছিলেন। বলা হয় তৃণমূলের অভ্যন্তরে বিভাজন রেখা সৃষ্টির মূল কারিগরই নাকি মুকুল। তৃণমূল ভেঙে বিজেপির জয়ের ভিত গড়েছেন তিনিই। দল ছাড়লেও এখনও তৃণমূলের প্রথম সারির অনেক নেতাদের সঙ্গেই তাঁর নাকি ভাল সম্পর্ক রয়েছে।
তৃণমূলে মুকুলের যাত্রা
১৯৯৯ সালের জানুয়ারিতে কংগ্রেস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মমতা যখন নতুন দল গড়েছিলেন, মুকুল রায় সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের মধ্যে ছিলেন। ধীরে ধীরে মুকুল রায় দিল্লিতে তৃণমূলের মুখ হিসাবে উঠে এসেছিলেন। ২০০৬ সালে তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক হন এবং রাজ্যসভার সাংসদ হন। ইউপিএ দ্বিতীয় সরকারে তিনি রেলমন্ত্রী হওয়ার আগে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। মমতা মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর মুকুল রায় রেলমন্ত্রক পান। মুকুল রায়ের কার্যকাল যদিও সংক্ষিপ্ত ছিল। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে তৃণমূল ইউপিএ জোট ছেড়ে বেরিয়ে আসে। এরপর ২০১৩ সালে সারদা কেলেঙ্কারিতে তৃণমূল নেতাদের নাম জড়ায়। সেই তালিকায় ছিল মুকুল রায়ের নামও। নারদ স্টিং অপারেশনেও তাঁর নাম জড়ায়। তারপর থেকেই মুকুল রায় ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে মুকুল রায়কে ছয় বছরের জন্য তৃণমূল থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। নভেম্বরে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বিজেপিতে যোগ দেন।
মুকুলকে নিয়ে মমতার বক্তব্য তাৎপর্যপূর্ণ
ভোট বাংলায় মুকুলকে নিয়ে যেভাবে সরব হলেন মমতা, তা রাজনৈতিক দিক থেকে উল্লেখযোগ্য বলে মনে করা হয়েছিল। সেইসঙ্গে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে-তে যাওয়া শুভেন্দু ও মুকুলের যেভাবে তুলনা টেনে মুকুলকে সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন মমতা, তা রাজনৈতিক দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ। শুভেন্দু অধিকারী ও মুকুল রায়ে দু'জনেই মমতা ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তৃণমূলে থাকাকালীন সম্মানও পেয়েছেন। দল থেকে বেরিয়ে বিজেপির টিকিটে এবার দু'জনেই বিধায়ক হয়েছেন। তবে গেরুয়া শিবির বিরোধী দলনেতা বেছেছে শুভেন্দুকেই। প্রধান বিরোধী দলে আক্রমণের ব্যাটন যে শুভেন্দুর হাতে তা বুঝিয়ে দিয়েছে ভারতীয় জনতা পার্টি। অন্যদিকে শুভেন্দুর প্রতি মমতা যতটা আক্রমণাত্মক মুকুলকে নিয়ে তেমনটা কখনও দেখা যায়নি। এটাও ঠিক শুভেন্দুর মত মুকুল কখনই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ব্যক্তিগত আক্রমণে নামেননি।
ইঙ্গিত কি দিচ্ছেন অভিষেকও?
বাবার মতোই তৃণমূল ছেড়ে ২০১৯ সালে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন মুকুল পুত্র শুভ্রাংশু রায়। তবে এবারের বিধানসভা ভোটে নিজের পুরনো আসন বীজপুর থেকে হেরে গিয়েছেন গতবারের বিধায়ক। তারপরেই ইঙ্গিতপূর্ণ ফেসবুক পোস্টে জল্পনা বাড়িয়েছেন শুভ্রাংশু। পাশাপাশি প্রাক্তন দলের প্রতি বর্তমান দল ও কেন্দ্রীয় সরকারের আচরণও যে বীজপুরের প্রাক্তন বিধায়ক পছন্দ করছেন না তাও স্পষ্ট করে দিয়েছেন নিজের পোস্টে। বিজেপির নাম না করে যে ইঙ্গিত শুভ্রাংশু ফেসবুক পোস্টে দিয়েছেন, তা রাজনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। গত শনিবার রাতে ফেসবুক পোস্টে মুকুল পুত্র বলেছিলেন, জনগণের সমর্থন নিয়ে আসা সরকারের সমালোচনা করার আগে, আত্মসমালোচনা করা বেশি প্রয়োজন। এরপরেই শুভ্রাংশু রায়ের কলার টিউন নিয়ে জল্পনা তৈরি হয়। বীজপুরের প্রাক্তন এই বিধায়ককে ফোন করলেই শোনা যাচ্ছে আচ্ছা চলতা হুঁ, দুয়াঁও মে ইয়াদ রাখনা। ফলে মুকুল রায়ের পুত্র কি বিজেপি ছাড়ছেন সেই জল্পনা আরও তীব্র হয়ে উঠতে শুরু করেছে। এর মাঝে বুধবার মুকুল রায়ের অসুস্থ স্ত্রীকে দেখতে অভিষেকের হাসপাতালে যাওয়া ও সেখানে শুভ্রাংশুর সঙ্গে একান্তে কথা বলা নতুন মাত্রা যোগ করেছে। শুভ্রাংশুর প্রতি যে তিনি স্নেহশীল তা নিজের বক্তব্যে সম্প্রতি বুঝিয়ে দিয়েছেন তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়ও। শুভ্রাংশুর বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তৃণমূলের বর্ষীয়াণ সাংসদ বলেন,‘ও আমাদের স্নেহের পাত্র।কত ছোট। ওর বাবাই তো আমাদের থেকে ছোট।’ সৌগতবাবুর কথা থেকেই স্পষ্ট, শুভ্রাংশুর বিষয়ে বলতে গিয়ে মুকুলের বিষয়টিকেও হালকার ওপর ছুঁয়ে যেতে চেয়েছেন দুঁদে রাজনীতিবিদ।
২১ জুলাই মমতার বার্তা
গত বছর করোনা আবহে ২১ জুলাই পালিত হয়েছিল তৃণমূলের শহিদ দিবস। প্রথমবার শহিদ স্মরণে ভারচুয়াল বক্তব্য রাখেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সময় দল ছেড়ে যাওয়াদের ঘরে ফেরার ডাকও দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একসঙ্গে কাজ করার কথাও বলেছিলেন। সেই আহ্বান ছিল একুশের ভোটের আগে। এবার বিধানসভা ভোট মিটে গিয়েছে। রাজ্যে ফের ক্ষমতায় এসেছে তৃণমূল সরকার। ধুয়ে-মুছে গেছে গেরুয়া শিবির। এই পরিস্থিতিতে সোনালি গুহ, সরলা মুর্মু-সহ একাধিক বিজেপি শিবিরে যাওয়া নেতা-নেত্রী এখন ফের তৃণমূলে ফিরতে চাইছেন। তবে ভোটের আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জোর দিয়ে বলেছিলেন, তৃণমূল বাংলায় ফিরলে দলত্যাগীদের জন্য কোনও জায়গা নেই। তবে রায় পরিবারের ক্ষেত্রে মমতা কী অবস্থান নেবেন সেই ধোঁয়াশা কিন্তু তিনি নিজেই জিইয়ে রেখে দিচ্ছেন।