অধীর রঞ্জন চৌধুরী। যিনি রাজ্য রাজনীতিতে রবিনহুড ইমেজ গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর নিজের গড় মুর্শিদাবাদেই একটিও আসন পেল না কংগ্রেস। কংগ্রেস ও বামেদের জোটকে হেলায় হারিয়ে জেলায় ১৮টি আসন দখল করল তৃণমূল কংগ্রেস। অধীরের দলের এই ফল কার্যত নজিরবিহীন বলেই মনে করছে জেলার রাজনৈতিক মহল। তাঁদের প্রশ্ন অধীর কি আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন? নিজের গড় থেকে একটাও আসন না পাওয়া অধীর কতখানি প্রাসঙ্গিক থাকবেন দিল্লির রাজনীতিতে?
মুর্শিদাবাদের ফলাফল
সামসেরগঞ্জ ও জঙ্গিপুর আসনের ২ প্রার্থীর মৃত্যুর ফলে জেলায় ২০ আসনে ভোট হয়। ফলাফলে দেখা যায়, ১৮টি আসন দখল করেছে ঘাসফুল শিবির। মুর্শিদাবাদ ও বহরমপুর আসনে জিতেছে বিজেপি। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত জেলায় এই প্রথম বিধানসভা আসন পেল গেরুয়া শিবির।
যদিও ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল কংগ্রেসের পক্ষেই ছিল। সেবার কংগ্রেস পেয়েছিল ১৪টি আসন। বাম ও তৃণমূল ৪টি করে আসন দখল করেছিল।
আরও পড়ুন : হেভিওয়েট মোদী-শাহর প্রচার সত্ত্বেও কেন 'মমতাময়' বাংলা?
এবার কেন মুর্শিদাবাদে ভরাডুবি কংগ্রেসের?
২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস ১৪টি আসন পেলেও একের পর এক বিধায়ক দলত্যাগ করে তৃণমূলে যোগ দেন। ফলে রক্তক্ষরণ শুরু হয় কংগ্রেসে। তার প্রতিফলন দেখা যায়, ২০১৯ লোকসভা ভোটে। ৩টি আসনের মধ্যে কেবল বহরমপুর লোকসভা আসনটি ধরে রাখতে সক্ষম হন অধীর। বাকি ২টি আসনই দখল করে নেয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল। রাজনৈতিক মহলের একাংশের মতে, তখন থেকেই জেলায় কংগ্রেসের পতন শুরু।
কংগ্রেসের এত খারাপ ফলাফলের কারণ?
রাজনৈতিক মহলের একাংশের মতে, নেতাদের অতি আত্মবিশ্বাসের জন্যই ভরাডুবি হয়েছে। শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে সাধারণ কর্মী-সমর্থকদের দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। দলে স্তাবকদের গুরুত্ব বাড়ছিল। তারই খেসারত কংগ্রেসকে দিতে হয়েছে। কংগ্রেসের নিচুতলার কর্মী-সমর্থকদের একাংশ এই ভরাডুবির জন্য দায়ি করছেন অধীরকেই। তাঁদের মতে, দিল্লির রাজনীতি নিয়ে অধীর চৌধুরী ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। জেলায় তৃণমূল প্রভাব বাড়াচ্ছিল। কিন্তু, তিনি সে ব্যাপারে তেমন নজর দেননি। তাই এই ফল।
মমতার হাত
মুর্শিদাবাদে কংগ্রেসকে 'খতম' করার নেপথ্য কারিগর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এমনটাই মত জেলার রাজনৈতিক মহলের একাংশের। তাঁদের বক্তব্য, ভোটের ফলাফল থেকেই পরিষ্কার সংখ্যালঘু ভোট একচেটিয়াভাবে নিজেদের ভোট বাক্সে নিয়ে গিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই মতো জেলায় প্রচার চালিয়েছেন। ২০১৬ বিধানসভাতেও এই ভোট কংগ্রেসের কাছেই ছিল। কিন্তু, মুর্শিদাবাদকে পাখির চোখ করে এগিয়েছেন মমতা। সংখ্যালঘুদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন, তিনিই তাঁদের কাছের লোক। তার সুফলও পেয়েছেন।
আরও পড়ুন : করোনা আটকাতে কেন্দ্র ও রাজ্যগুলিকে লকডাউনের পরামর্শ SC-র
ধুলিস্যাৎ অধীর মিথ ?
দেশজুড়ে বিজেপির উত্থানপর্বে জাতীয় রাজনীতিতে ক্রমশ প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে কংগ্রেস। দলের বাঘা বাঘা নেতা পরাজিত হয়েছিলেন গেরুয়া শিবিরের প্রার্থীদের কাছে। কিন্তু, অধীর চৌধুরী তাঁর গড় মুর্শিদাবাদকে অটুট রাখতে পেরেছিলেন। আর তাকেই হাতিয়ার করে জাতীয় রাজনীতিতে তিনি কংগ্রেসের একেবারে প্রথম সারির নেতা হয়ে ওঠেন। ২০১৯-এর ভোটের পর তাঁকে লোকসভার দলনেতাও করেন সোনিয়া গান্ধি। রাজনৈতিক মহলের একাংশের বক্তব্য, অধীর নিজের গড় অক্ষত রেখে দিল্লির রাজনীতিতে নিজেকে মেলে ধরতে পেরেছিলেন। তবে এবারের ফলাফল তাঁর ইমেজে আঘাত হানবেই।
তৃণমূলের বক্তব্য
কংগ্রেসের এই ফলাফলের পিছনে অধীর চৌধুরীকেই দায়ি করছে তৃণমূল কংগ্রেস। কংগ্রেসের একাধিক প্রাক্তন নেতা আজ তৃণমূলের সাংসদ, বিধায়ক। তাঁদের মধ্যে অন্যতম আবু তাহের খান। যিনি আবার মুর্শিদাবাদ জেলা তৃণমূলের সভাপতিও। তিনি বলেন, 'অধীরকে আমরাই জঙ্গল থেকে তুলে এনে রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছিলাম। আর উনি নিজের স্বার্থ দেখে গেলেন। কখনও দলের কথা ভাবেননি। নিজের হাতেই নিজের ধ্বংস ডেকে আনলেন। গত লোকসভাতেই হেরে যেত। কোনওরকমে বহরমপুর আসনটা ধরে রাখতে পেরেছিলেন। সামনে বার তাও পারবেন না।'
আরও পড়ুন : Corona Live : অক্সিজেনের অভাবে কর্ণাটকে ২৪ রোগীর মৃত্যু
অধীরের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ
মুর্শিদাবাদ জেলার রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, এবারের বিধানসভার ফলাফলে অধীরের ভয়ের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এর প্রভাব আগামী লোকসভা ভোটেও পড়তে পারে। যদিও কংগ্রেস নেতৃত্বের দাবি, তারা হারের কারণ পর্যালোচনা করে সংগঠনকে মজবুত করার কাজ শুরু করবেন।
তৃণমূলের দাবি, জেলায় আর সংগঠন মজবুত করতে পারবেন না অধীর। আবু তাহের খান বলেন, 'অধীর চৌধুরী আর ঘুরে ,দাঁড়াতে পারবেন না। তার প্রমাণ লোকসভাতেই পাবেন। তবে উনি বিজেপিতে যোগ দিতে পারেন। বহরমপুর বিধানসভা আসনে বিজেপি জিতেছে। বিজেপির সঙ্গে তলায় তলায় আঁতাত রয়েছে অধীরের।'