ভারত-চিন সীমান্ত বিবাদ- লাদাখ সীমান্তে একাধিক বার সংঘর্ষে জড়িয়েছে ভারত চিন। চিনের দখলদারি মনোভাবের জেরে সীমান্তে অশান্তি ছড়িয়েছে। ফলে চলতি বছরে সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে দুই দেশের সম্পর্ক। দুই দেশের সেনা বাহিনী ও কূটনীতিকরা একাধিকবা বৈঠকে বসলেও যার সমাধান অধরাই রয়েছে। এই ঘটনার রেশ ধরে ভারত-চিন কূটনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্কে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে।
তলানিতে আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক- চিনা সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে অনৈতিক ভাবে ব্যবসা করার অভিযোগ অনেক দিন ধরেই করে আসছেন ট্রাম্প। দফায় দফায় সে জন্য তাদের পণ্যের উপর করের বোঝাও চাপিয়েছেন। কিন্তু এ বছর তিক্ততার মাত্রা বেড়েছে আরও খানিকটা। যার একটা প্রধান কারণ হিসেবে করোনা অতিমারিকে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। ট্রাম্পের দাবি, উহান থেকেই ছড়ানো হয়েছে এই ভাইরাস। আর চিন ইচ্ছে করেই বহু দিন পর্যন্ত তা চেপে গিয়েছিল বাকি বিশ্বের কাছে। বেজিং সময়মতো ব্যবস্থা নিলে অতিমারি আজ এই চেহারা নিত না বলেও দাবি তাঁর। চলতি বছরে চিনের উপর একের পর এক বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছে আমেরিকা। প্রশ্নও তুলেছেন অনেকে। তবে জো বাইডেন হোয়াইট হাউসে এলে আমেরিকা-চিন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বরফ অনেকটাই গলবে বলে দাবি বিশেষজ্ঞদের একাংশের।
নেপাল ও ভুটানেও আধিপত্য- বেজিংয়ের আগ্রাসী নীতি চাক্ষুস করছে গোটা বিশ্বই। একের পর এক প্রতিবেশীর জমিতে দাবি জানিয়েই চলেছে ড্রাগনের দেশ। ভুটানের সাকটেঙ্গ অভয়ারণ্যকে নিজেদের বলে দাবি করে আন্তর্জাতিক মঞ্চে সরব হয়েছে বেজিং। যদিও সেই দাবি পুরোপুরি উড়িয়ে দিয়েছে ভুটান। এদিকে নেপালের বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে চিনের দখলে। অন্তত সাতটি জায়গায় তারা নেপালের জমি দখল করছে, নেপালি প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি সবকিছু জেনেও নিজের স্বার্থে কিছুই বলছেন না। চুপ করে রয়েছে তাঁর প্রশাসনও।
পাকিস্তানকে নাগপাশে জড়াচ্ছে চিন- সৌদি আরবের ঋণ মেটাতে এবার চিনের থেকে ভারতীয় মূল্যে সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি ধার নিয়েছে পাকিস্তান। পাশাপাশি চিন-পাকিস্তান ইকনমিক করিডর তৈরি হচ্ছে। পরিস্থিতি দেখে বিশেষজ্ঞরা কটাক্ষ করে বলছেন, ইসলামাবাদকে চিন যেভাবে চারিদিক থেকে নাগপাশে আবদ্ধ করছে। তাতে কোনওদিন না পুরো পাকিস্তানটাকেই তারা দখল করে নেয়।
দক্ষিণ চিন সাগরে আধিপত্য- দক্ষিণ চীন সাগরের ৯০ ভাগই দীর্ঘদিন ধরে নিজেদের দাবি করে আসছে চীন। সেখানে একটি কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করছে বেজিং, এমন দাবি করে আসছে যুক্তরাষ্ট্রসহ তাইওয়ান, ফিলিপিন্স, ব্রুনাই ও মালয়েশিয়াসহ ভিয়েতনামও। দক্ষিণ চিন সাগরকে বরাবরই নিজের কব্জায় রাখতে চাইছে চিন। তাই দক্ষিণ চিন সাগরের অনেক দ্বীপকেই নিজের বলে দাবি করছে চিন। দক্ষিণ চিন সাগর বিশ্বের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ জলপথগুলির মধ্যে একটি। বিশ্বে, জাহাজের মাধ্যমে রফতানির মোট পরিমাণের এক-তৃতীয়াংশই হয় এই পথে। তাই ওই অঞ্চলে অধিকার বিস্তার করতে দীর্ঘ দ্বন্দ্বে জড়িয়ে চিন, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া।
চিনের বিরুদ্ধে জোট গঠনের আহ্বান তাইওয়ানের- বরাবরই তাইওয়ানকে নিজেদের অংশ হিসেবে দাবি করে এসেছে চিন। তবে বেজিংয়ে তার রাশ শি জিনপিংয়ের হাতে আসার পর থেকেই আরও আগ্রাসী হয়ে উঠেছে কমিউনিস্ট দেশটি। একাধিকবার জোর করে তাইওয়ান দখলের কথাও বলেছেন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। তারপর থেকেই আরও সতর্ক হয়ে গিয়েছে দেশটি। লালফৌজের হামলা ঠেকাতে সামরিক বাহিনীকে অত্যাধুনিক হাতিয়ারে সাজিয়ে তুলছে তাইওয়ান। আগ্রাসী চিনকে রুখে দিতে নয়া সাবমেরিন বাহিনী তৈরি করছে তাইওয়ান। পাশাপাশি চিনের সম্প্রসারণবাদ রুখতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে তাইওয়ান।
হংকংবাসীর স্বাধীনতাতেও হস্তক্ষেপ চিনের- ব্রিটেনের কাছ থেকে ১৯৯৭ সালে হংকং এর ক্ষমতা পায় চিন। কথা ছিল চিন কমপক্ষে ৫০ বছরের জন্য হংকংয়ের স্বাধীনতা রক্ষা করবে। কিন্তু চলতি বছরেই হংকং এর জন্য নতুন জাতীয় নিরাপত্তা আইন নিয়ে আসে চিন। যেখানে বলা হয় বিচ্ছিনতাবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও বিদেশের সঙ্গে সংঘবদ্ধ হয়ে অপরাধ করলে সর্বনিম্ন ৩ বছরের কারাদণ্ড ও সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন জেল হতে পারে। নতুন আইনে এও বলা হয় প্রতিবাদীদের দ্বারা যদি জনপরিবহণ ক্ষতিগ্রস্থ হয়, তাহলে তা সন্ত্রাসবাদ হিসেবে বিবেচিত হবে। গত বছর চিনা বিরোধী আন্দোলনে উত্তাল হয়েছিল হংকং। হংকংকে সাহায্য জুগিয়েছিল আমেরিকা, ব্রিটেনের মতো ক্ষমতাশালী দেশ। তাই নতুন আইন এনে কার্যত প্রতিবাদের কোমর ভেঙে দেয় চিন। এরপরেই বিক্ষোভ, বিদ্রোহে নতুন করে উত্তাল হয়ে ওঠে হংকং। চিনের নিরাপত্তা আইনে কার্যত প্রশ্নের মুখে হংকংয়ের স্বাধীনতা।
চিন-অস্ট্রেলিয়া বিরোধ- এ বছরের শুরুর দিকে অস্ট্রেলিয়ার পক্ষ থেকে করোনাভাইরাসের উৎস নিয়ে তদন্তের আহ্বান জানানো হলে অস্ট্রেলিয়া ও চিনের সম্পর্কে চিড় ধরে। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গেও ড্রাগনের দেশের সম্পর্ক ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। বেশ কিছু সময় ধরেই আর্থিক ভাবে চিনের প্রতি বেশ খানিকটা নির্ভর হয়ে পরেছিল অস্ট্রেলিয়া। আর সেই সুযোগ নিয়েই ক্রমশ অস্ট্রেলিয়ার আভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাতে থাকে চিন। আর তা নিয়েই এবার ‘উষ্মা’ প্রকাশ করেছে অস্ট্রেলিয়া।
জাপানও দূরত্ব বাড়াচ্ছে চিনের সঙ্গে- চিনের সঙ্গে ক্রমেই দূরত্ব বাড়াচ্ছে উন্নত বিশ্বের দেশগুলি। এই আবহে বাণিজ্যিক যুদ্ধে চিনকে ধারাসায়ী করতে পরিকল্পনা ছকেছে জাপানও। তাই চিন থেকে জাপানি সংস্থাগুলি যাতে তাদের ব্যবসা আসিয়ান ভুক্ত দেশে সরিয়ে নিয়ে যায় তা চাইছে টোকিও, আর তাইজন্য ওই সংস্থাগুলির জন্য বিশেষ ভর্তুকি নির্ধারণ করেছে জাপান। এমনকি এই বছর চিনা প্রেসিডেন্টের জাপান সফরও বাতিল করে দেয় টোকিও। দক্ষিণ এশিয়ায় চিনের নানা পদক্ষেপে যত উত্তেজনা বাড়ছে, তত কাছাকাছি আসছে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সব দেশ। রফতানি ক্ষেত্রে চিনা আধিপত্য কমাতে শক্তিশালী সাপ্লাই চেন খুলতে চলেছে ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া।
আফ্রিকার সম্পদের দিকেও নজর- দেখা গিয়েছে, দুনিয়ার যে প্রান্তেই অর্থসঙ্কট আর বিনিয়োগসঙ্কট দেখা দেয়, সেখানেই কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার নিয়ে ত্রাতার বেশে হাজির হয় চিন। এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা— সবখানেই বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের বন্যা বইয়ে দিচ্ছে একালের অর্থনৈতিক পরাশক্তি শি জিনপিংয়ের দেশ। গোটা আফ্রিকা মহাদেশে চিন সূচনা করেছে এক ‘নতুন অর্থনৈতিক রেনেসাঁ’র। কিন্তু এর পেছনেও রয়েছে চিনের নিজস্ব স্বার্থ। আফ্রিকার উপর নিজের কর্তৃত্ব বজায় রাখা।
তাই জিনপিংয়ের চিন এখন কার্যত বিশ্বের নয়া সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে পরিণত হয়েছে। শুধু ভারত নয়, রাশিয়া, জাপান-সহ আরও ২০টি দেশের বিভিন্ন অংশকে নিজেদের বলে দাবি করে চিন. কোথাও সমুদ্র, কোথাও নদী, কোথাও বা জমি নিজেদের বলে জোর খাটাতে চায় লালফৌজ। চল্লিশের দশকে প্রতিবেশী পূর্ব তুর্কিস্তান দখল করে শিনজিয়াং প্রদেশ বানিয়েছিল চিন। ১৯৫০ সালে দখল করেছিল তিব্বত।