পাকা ব্যবসায়ী থেকে রাজনীতিক বনে যাওয়া, এরপর যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি তথা প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। কিন্তু প্রেসিডেন্ট হিসাবে মেয়াদের একেবারে শেষলগ্নে পৌঁছে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর আসনে বসেও এখন নিঃসঙ্গ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। গত চার বছরে নানা কারণে আলোচনার কেন্দ্রে ছিলেন ট্রাম্প। তবে ক্ষমতার একেবারে শেষ লগ্নে এসে এমন অভাবনীয় দুঃসহ পরিস্থিতির মুখে পড়তে হবে এটা হয়তো তিনি কল্পনাও করেননি। বর্তমান সময়ে সংবাদ মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ যতো খবরাখবর প্রচারিত হচ্ছে তার একটা বড় অংশ যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়েই। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকরা যেভাবে মার্কিন গণতন্ত্রের প্রতীক ক্যাপিটল হিলের ভেতরে তাণ্ডবে চালিয়েছে তার জেরেই প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বিদায় লগ্নে ইমপিচের মুখে পড়তে হয়েছে। আমেরিকার ইতিহাস বলছে ডোনাল্ড ট্রাম্প তৃতীয় প্রেসিডেন্ট যাঁকে ইমপিচ করা হল। এর আগে যে দুই প্রেসিডেন্টকে হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভস ইমপিচ করেছিল, তাঁরা ছিলেন বিল ক্লিনটন ও অ্যান্ড্রু জনসন। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের রেকর্ড আরেক জায়গায়। প্রথম এবং একমাত্র মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় বার ইমপিচড হয়েছেন ট্রাম্প। এদিকে ১৯ তারিখ স্থগিত হয়ে যাচ্ছে মার্কিন সেনেট। এর পর দিন আমেরিকার ৪৬ তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেবেন জো বাইডেন। তাই এই অল্প সময়ের মধ্যে ট্রাম্পকে দোষী সাব্যস্ত করা অসম্ভব। ফলে ট্রাম্পকে এখনই হোয়াইট হাউস ছাড়তে হচ্ছে না। তবে পরে ওই ট্রায়ালে ট্রাম্প দোষী সাব্যস্ত হলে তিনি আর ২০২৪-এর মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। এখন দেখে নেওয়া যাক মার্কিন মুলুকে বহু আলোচিত এই ইমপিচমেন্ট বিষয়টি আসলে কী।
ইমপিচমেন্ট কী?
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ইমপিচমেন্টের ঘটনা খুবই বিরল। এর মাধ্যমে মার্কিন মুলুকে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতায় ভারসাম্য রক্ষা করা হয়। ভারতে যেমন রয়েছে সংসদ তেমনি যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে কংগ্রেস, এখানেই আইন তৈরি করা হয়, কংগ্রেসের সদস্যরা দেশটির প্রেসিডেন্টসহ শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের বিচারের মুখোমুখি করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে বলা আছে, বেশ কিছু অপরাধের জন্য প্রেসিডেন্টকেও তাঁর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া অর্থাৎ তাঁকে ইমপিচ করা যেতে পারে। এসব অপরাধের মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রদ্রোহিতা, ঘুষ নেওয়া অথবা অন্য কোনো বড় ধরনের অথবা লঘু অপরাধের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলা।
ইমপিচ কিভাবে করা হয়?
ইমপিচমেন্টের প্রক্রিয়া শুরু হতে হয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদ বা হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস থেকে। যাকে বলা হয় মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ। এই প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য সেখানে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রয়োজন। আর সেটা পাস হলে পরের ধাপে বিচার অনুষ্ঠিত হবে সেনেটে, যেটা কংগ্রেসের দ্বিতীয় অংশ। এটা অনেকটা আদালতকক্ষের মতো, যেখানে সেনেটররা বিচারক বা জুরি হিসেবে কাজ করবেন। তাঁরাই সিদ্ধান্ত নেবেন প্রেসিডেন্ট দোষী, নাকি নির্দোষ। প্রেসিডেন্টকে তাঁর পদ থেকে সরিয়ে দিতে হলে এই সিনেটে দুই-তৃতীয়াংশ সিনেটরকে ইমপিচমেন্টের পক্ষে ভোট দিতে হবে।
এ রকম কী আগে হয়েছে?
ট্রাম্পের আগে মার্কিন মুলুকে যে প্রেসিডেন্টকে ইমপিচ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল তিনি বিল ক্লিনটন। সেটা ১৯৯৮ সালের ঘটনা। ক্লিনটনের বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্টের প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য ভোট পড়েছিল হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস । এর আগে একই রকমের ঘটনা ঘটেছিল ১৮৬৮ সালে। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জনসনের বিরুদ্ধেও ইমপিচমেন্টের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। কিন্তু ক্লিনটন ও জনসন কাউকেই সিনেটে দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি। সুতরাং ইমপিচমেন্টের অর্থ এটা নয় যে এর প্রক্রিয়া শুরু হলেই প্রেসিডেন্টকে তাঁর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে।
এটা ঠিক যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এখনো পর্যন্ত কোনো প্রেসিডেন্টকে ইমপিচমেন্টের কারণে প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়নি। তবে একজন প্রেসিডেন্টকে তাঁর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার উপক্রম হয়েছিল। তিনি রিচার্ড নিক্সন। ১৯৭৪ সালে তাঁর বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্টের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগেই নিক্সন পদত্যাগ করেন। ধারণা করা হয়, প্রক্রিয়াটি শুরু হলে তাঁকে হয়তো প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরে যেতে বাধ্য করা হতো।
ট্রাম্পের ভবিষ্যত কী?
২০১৯ সালে প্রথমবার ট্রাম্পের ইমপিচমেন্ট হয়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তৎকালীন প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেনের বিরুদ্ধে কাদা ছোঁড়ার জন্য ট্রাম্প ইউক্রেনের নেতাকে চাপ দিচ্ছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে। এ জন্য ডেমোক্র্যাট নিয়ন্ত্রিত মার্কিন কংগ্রেস তাঁর ইমপিচমেন্ট করে। যদিও রিপাবলিকান সংখ্যাগরিষ্ঠ সেনেট ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ট্রাম্পকে অভিযোগ থেকে মুক্তি দেয়। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি অনেকটাই আলাদা। বিদায় লগ্নে ইমপিচমেন্টের মুখোমুখি পড়তে হয়েছে ট্রাম্পকে। মার্কিন আইন প্রণেতাদের অভিযোগ, অল্পদিন আগে ক্যাপিটল বিল্ডিংয়ে ট্রাম্প সমর্থকদের যে তাণ্ডব হয়, যাতে ৫ জন মারা গিয়েছেন, তার পিছনে ট্রাম্পের উস্কানি রয়েছে। হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস ট্রাম্পের ইমপিচমেন্ট প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ৬ জানুয়ারির ঘটনায় ট্রাম্প একাধিকবার প্ররোচনামূলক মন্তব্য করেছেন, তিনিই সমর্থকদের উস্কানি দিয়েছিলেন ইউএস ক্যাপিটলে হামলা চালাতে। ওই হামলার ফলে ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের গণনা কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ হয়ে যায়, পুলিশ-জনতা সংঘর্ষে মারা যান ৫ জন, এঁদের মধ্যে ইউএস ক্যাপিটল পুলিশের এক অফিসারও রয়েছেন।
আমেরিকান কংগ্রেসের হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস-এ ইমপিচমেন্ট প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। সেখানে ডেমোক্র্যাটরা তো বটেই, রিপাবলিকানদের ১০ জনও ট্রাম্পের বিপক্ষে অর্থাৎ ইমপিচমেন্টের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। ট্রাম্পের ইমপিচমেন্টের প্রস্তাব মার্কিন কংগ্রেসে পাশ হয়েছে ২৩২-১৯৭ ভোটে। এদিকে নিজের দল রিপাবলিকানে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ভোট প্রদান করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন তারা হলেন- ওয়োমিং রাজ্যের লিজ চেনেই, ওহিও রাজ্যের এন্থ্যনি গঞ্জালেজ, ওয়াশিংটনের জেমেই হেরেরা বাটলার, নিউইয়র্কের জন কাটকু, ইলিনিয়স রাজ্যের এডাম কিনজিংগার, মিশিগানের পিটার মেইজার, ওয়াশিংটনের আরেক রিপাবলিকান ডেন নিউহাউস, দক্ষিণ ক্যারোলিনা রাজ্যের টম রাইস, মিশিগানের ফ্রেড উপটন এবং ক্যালিফোর্নিয়ার ডেভিড ভালাডাও। যে ৪ জন ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিনী কংগ্রেসে রয়েছেন, তাঁরাও ভোট দিয়েছেন ইমপিচমেন্টের পক্ষে। এই ৪ জন হলেন অ্যামি বেরা, আর ও খান্না, রাজা কৃষ্ণমূর্তি ও প্রমীলা জয়পাল। হাউস স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি প্রকাশ্যে বলেছেন, দেশের পক্ষে ট্রাম্প সুস্পষ্টভাবে বিপজ্জনক। এবার স্পিকার ঠিক করবেন, কত তাড়াতাড়ি ইমপিচমেন্ট আর্টিকল সেনেটে ট্রায়ালের জন্য পাঠানো হবে। ডেমোক্র্যাট নেতা চাক শুমার এ ব্যাপারে সেনেটে এমার্জেন্সি সেশনের ডাক দিয়েছিলেন, যাতে ২০ জানুয়ারি ট্রাম্প প্রেসিডেন্টের অফিস ছাড়ার আগেই তাঁর বিচার শুরুহয়। কিন্তু সেনেটের জিওপি নেতা মিচ ম্যাককোনেল তা খারিজ করে দিয়েছেন।
ট্রাম্পের ইমপিচমেন্টের প্রস্তাব এবারে সেনেটে যাবে। কিন্তু মার্কিন কংগ্রেসের উচ্চকক্ষে সেই প্রক্রিয়া দীর্ঘ সময়ের । ইমপিচ করতে সেনেটে উপস্থিত দুই তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন লাগবেই। সেনেটের মোট সদস্যসংখ্যা ১০০। নিম্নকক্ষে রিপাবিলিকানদের ১০ প্রতিনিধি ট্রাম্পের বিরুদ্ধে বা ইমপিচমেন্টের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। কিন্তু দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থন পেতে গেলে ডেমোক্র্যাটদের জোগাড় করতে হবে অন্তত আরও ১৯ জন সেনেটরকে। সেই সম্ভাবনা এখন ক্ষীণ। সেনেটের অধিবেশন ১৯ জানুয়ারির আগে বসবে না। ২০ জানুয়ারি দুপুরে প্রেসিডেন্ট পদ ছাড়বেন ট্রাম্প। তাই তিনি ক্ষমতায় থাকতে এই প্রস্তাব পাস হওয়া প্রায় অসম্ভব। এর অর্থ, যখন সেনেটে ইমপিচমেন্ট নিয়ে ট্রায়াল চলবে, তখন সেখানে ডেমোক্র্যাটরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে। কিন্তু একটি সমস্যাও রয়েছে। এই ট্রায়াল চলার সময় সেনেটের অন্য কাজ বন্ধ রাখতে হবে। সদস্য মনোনয়নের কাজও আটকে যাবে।
ট্রাম্পের কী শাস্তি হবে?
এই বিষয়ে এখনও স্পষ্ট ধারণা নেই। তবে প্রেসিডেন্ট পদ ছাড়ার পরেও তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে সেনেটের দুই–তৃতীয়াংশর সমর্থন দরকার। ডেমোক্র্যাটদের সেই সংখ্যা নেই। ১৭ জন রিপাবলিকান সদস্য এক্ষেত্রে সমর্থন করলে তবেই ট্রাম্পের কনভিকশন হবে। তিন জন রিপাবলিকান নেতা এক্ষেত্রে আগ্রাহ দেখিয়েছেন, যা যথেষ্ট নয়। এখন প্রশ্ন, প্রাক্তন প্রেসিডেন্টকে কি ইমপিচ করা যেতে পারে? কারণ আমেরিকায় পদ থেকে সরার পর কোনও প্রেসিডেনন্টকে ইমপিচ করা হয়নি এর আগে। যদিও মার্কিন সংবিধান বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন ‘লেট ইমপিচমেন্ট’ করাই যায় । কারণ, ইমপিচমেন্টের লক্ষ শুধু বর্তমান কোনও পদাধিকারীকে পদ থেকে সরানো নয়, ভবিষ্যতে যাতে তিনি সেই পদে ফের প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করতে পারেন, সে দিকটা নিশ্চিত করা। আর ট্রায়ালে ট্রাম্প দোষী সাব্যস্ত হলে তিনি আর ২০২৪-এর মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না।
ইমপিচমেন্টের বিকল্প পথ
ট্রাম্প নিজে ইস্তফা দিয়ে ইমপিচমেন্ট এড়াতে পাড়তেন। যদিও তিনি সেই পথে হাঁটেননি। ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স এবং ক্যাবিনেটের অর্ধেক সদস্য সংবিধানের ২৫তম সংশোধনী প্রয়োগ করেও তাঁকে সরাতে পারতেন। কিন্তু পেন্স তাতে রাজি ছিলেন না। হিংসায় ট্রাম্পের ভূমিকার সমালোচনা করে ক্যাবিনেটের অনেক সদস্যই ইস্তফা দিয়েছেন। আদতে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ এড়িয়ে গিয়েছেন তাঁরা। মার্কিন সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে, ১৪তম সংশোধনী মেনে ট্রাম্পকে ফের রাষ্ট্রপতি হওয়া থেকেও আটকাতে পারে কংগ্রেস। তবে এতেও সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট দরকার। আর এই পদক্ষেপকে আবার আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যায়। তাই ট্রাম্পের ভাগ্যে কী রয়েছে সেটি জানতে আরও কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে।