এ যেন সত্যি কোনও রূপকথার গল্প। কিন্তু এই গল্পে নেই শুধু রাজপুত্তুর, রাজপ্রাসাদ। এখানে রাজা -রানীর সঙ্গে আছে এক কঠিন বাস্তব। এখানে সৈন্যদের নিয়ে প্রজার জন্য লড়াই নেই। আছে মারণ রোগের সঙ্গে লড়াই... আর অদম্য ইচ্ছে, একরাশ স্বপ্ন এবং শত নেগেটিভিটির মধ্যেও অনেকটা পজিটিভিটির গল্প...
শরীরে থাবা বসিয়েছে মারণ ক্যান্সার (Cancer)। তাও তিনি লড়ে যাচ্ছেন। কথা হচ্ছে জনপ্রিয় ধারাবাহিক 'জিয়ন কাঠি' (Jiyon Kathi) -র জাহ্নবী চ্যাটার্জী ওরফে ঐন্দ্রিলা শর্মাকে (Aindrila Sharma) নিয়ে। তবে এটা কোনও রিল লাইফের গল্প না। একেবারে রিয়েল লাইফের কঠিন বাস্তবের এক গল্প। একাধিকবার ঝুঁকিপূর্ণ সার্জারির পর চলছে কেমোথেরাপি। তবুও কখনও অবসাদে ভোগেননি তিনি। মুখের হাসিও কখনও অমিল হতে দেখেননি কাছের মানুষেরা। উল্টে দাঁতে দাঁত চেপে আরও কঠিন লড়াই করে যাচ্ছেন ঐন্দ্রিলা। আর সঙ্গে রয়েছেন ছায়াসঙ্গী, সব্যসাচী চৌধুরী (Sabyasachi Chowdhury) অর্থাৎ ছোটপর্দায় যাকে বামাক্ষ্যাপা রূপে চেনেন দর্শকেরা।
ইতিমধ্যে অনেকেই জানেন ঐন্দ্রিলার অসুস্থতা ও প্রবল মানসিক জোড়ের কথা। বহু অনুগামী প্রতি নিয়ত প্রার্থনা করেন তাঁর দ্রুত আরোগ্য কামনা করে। মঙ্গলবার তাঁর শারীরিক অবস্থার আপডেট দিয়ে এক আবেগঘন পোস্ট করলেন সব্যসাচী। যেখানে তিনি সকলকে জানিয়েছেন কীভাবে শরীর খারাপ থাকলে মাঝেমধ্যে শিশুর মতন আচরণ করেন ঐন্দ্রিলা। আবার অভিনয় না করতে পারার ছটফটানি একজন অভিনেতার কতখানি,তাও লিখেছেন তিনি। সেই সঙ্গে জানান দিয়েছেন কঠিন সময়ও নিজেদের কীভাবে ভাল রাখেন তাঁরা।
আরও পড়ুন: TRP-র লড়াইয়ে প্রথম হওয়ার দৌড়! ৩ চ্যানেলে একই সময় রিয়্যালিটি শো?
অভিনেতা লিখেছেন, "আরো একটা মাস শেষ হলো। আমরা মাঝেমাঝেই মাস গুনি, একটা মাস শেষ হলেই আবার দিন গুনি পরের মাস শেষ হওয়ার। কখনও ডানায় চোট লাগা পাখি দেখেছো? আমি প্রতিনিয়ত দেখি। টিভিতে যখনই কোনো সিরিয়াল চলে, আমি দেখি ওকে ছটফট করতে। বন্ধ করে দেয়। চেনাশোনা বন্ধুরা চুটিয়ে অভিনয় করছে আর এদিকে ওকে শুয়ে থাকতে হচ্ছে, এটা মন থেকে মেনেই নিতে পারে না। নিজের পুরোনো কাজগুলোই ফের দেখে শুয়ে শুয়ে। তবে হ্যাঁ, আজকাল একটা সিরিয়াল রোজ নিয়ম করে দেখে, সেটা হলো ‘ধূলোকণা’। লালন আর মিমি দিদি হল পছন্দের চরিত্র, মাঝেমধ্যেই শুয়ে শুয়ে মিমি দিদির নকল করে দেখায় আমাকে। আমার অভিনয় অবশ্য খুব কমই দেখে, ওর ধারণা দীর্ঘকাল আমি বামদেবের চরিত্রে অভিনয় করার ফলে বাস্তব জীবনেও ওরকম ক্ষ্যাপা হয়ে উঠতে পারি কখনও।"
সব্যসাচী আরও লেখেন, "আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম সার্জারিটাই আসল, সেটা সামলে উঠলে বাকি ট্রিটমেন্টটুকু খুব একটা সমস্যার হবে না। তবে বিষয়টা একেবারেই উল্টে গেছে। সার্জারির পরে যে কেমোথেরাপি দেওয়া হচ্ছে সেটা অনেকটাই বেশি কষ্টের। কিছু কিছু দিন বড়ই কষ্ট পায়, মাঝেমধ্যেই ব্লাড প্রেসার অস্বাভাবিক ভাবে কমে যায়, বিছানা থেকে মাথাই তুলতে পারে না। রক্তের মধ্যেও বিস্তর গোলযোগ দেখা যায় তখন। ব্রহ্মতালু থেকে শুরু করে পায়ের পাতা অবধি মারাত্মক যন্ত্রনা থাকে, বিস্তর ব্যাথার ওষুধেও যা কমতে চায় না। হাত পা টিপে দিলে বা গরম সেঁক দিলে সাময়িক আরাম পায় ঠিকই কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। হাই ডোজের ঘুমের ওষুধ খাইয়ে কোনোমতে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে হয়। যে কটা দিন ভালো থাকে, সেই দিনগুলো শুয়ে শুয়ে সিনেমা দেখে আর মোমো খায়।"
আরও পড়ুন: ছেলে ঈশানকে নিয়ে বাড়িতে ফিরেই প্রথম ছবি পোস্ট নুসরতের!
তিনি যোগ করেন, "একটু শরীর ভালো থাকলেই বিরিয়ানি খাওয়ার বায়না করে। সারা ঘরে এতো ওষুধপত্র ছড়িয়ে আছে যা দিয়ে ছোটোখাটো একটা ডিসপেনসারি হয়ে যায়।"
ঐন্দ্রিলাকে যত্ন করে ঘুম পাড়ান তাঁর সাপোর্ট সিস্টেম। সব্যসাচী লিখেন, "আসলে অসুখটা এতটাই দীর্ঘায়িত যে শুরুতে যে মানুষগুলি উৎকণ্ঠিত থাকেন তারাও আস্তে আস্তে উপেক্ষা করতে শুরু করেন। আর জগতের নিয়ম অনুযায়ী সেটাই খুব স্বাভাবিক বিষয়, সেটা ও নিজেও বোঝে। শরীরটা খারাপ থাকলে মাঝেমধ্যে শিশুর মতন আচরণ করে। মাঝেমাঝে ঘুমানোর আগে, বই পড়ে ভূতের গল্প শোনাতে হয়। একদিন ওকে ফিনিক্সের গল্প পড়ে শোনালাম, আমি জানি ছয় বছর আগে যেমন ফিরে এসেছিলো, ঠিক সেইভাবেই আবার ফিরবে। সেই জন্যই তো আমরা দিন গুনি।"
প্রথমে সেভাবে প্রকাশ্যে না আনলেও পরে ঐন্দ্রিলা - সব্যসাচী, দু'জনের কেউই লুকোছাপা করেননি নিজেদের সম্পর্ক নিয়ে। বরং নেটাগরিকরা সাক্ষী থেকেছেন তাঁদের বিভিন্ন মিষ্টি মুহূর্তের। কাছের মানুষটিকে সাহস যোগাতে ঐন্দ্রিলা হাসপাতালে থাকাকালীন সব্যসাচীও গিয়েছিলেন দিল্লিতে। এরপর যে কোনও উৎসব হোক, কিংবা কারও পাশে দাঁড়ানো, মুখে হাসি নিয়ে নিজেদের সাধ্য মতো ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা গেছে এই জুটিকে। বর্তমানে রয়েছেন ঐন্দ্রিলার ছায়াসঙ্গী হয়ে।
আরও পড়ুন: গুনগুনের 'ন্যাকামো'-তে বিরক্ত দর্শক! মিষ্টি ফিরে পাবে তাঁর সন্তানকে?
গত ফেব্রুয়ারিতে ঐন্দ্রিলা ভর্তি হয়েছিলেন দিল্লির এক প্রাইভেট হাসপাতালে। প্রথম কেমো নেওয়ার পরই ফের নারী দিবসের দিনই কাজে যোগ দিয়েছেন তিনি। কয়েকদিনের অন্তরে দ্বিতীয় ও তারপর তৃতীয় কেমো! প্রথমে লম্বা চুল কেটে একেবারে ছোট করেছিলেন, ফের একেবারে সেটুকুও রাখেননি। ইন্সটাতে সেই ছবি পোস্ট করে অভিনেত্রী লিখেছিলেন, "চুলেই নারীর সৌন্দর্য , আর নয়।" সত্যিই সৌন্দর্যের যেন এক নতুন সংজ্ঞা। মুখের অমলিন হাসি এবং আত্মবিশ্বাস!
এর আগেও প্রায় ৬ বছর আগে ২০১৫ শালে শিরদাঁড়ার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিলেন ঐন্দ্রিলা। প্রায় দেড় বছর কঠিন লড়াইয়ের পর সুস্থ হয়েছিলেন তিনি। আবার সেই দুঃস্বপ্নের দিনগুলি ফিরে এসেছে তাঁর জীবনে। এইবার কাঁধে সাংঘাতিক ব্যথা হওয়ার পর একের পর এক টেস্ট করতে হয় তাঁকে। ফের উড়ে যান দিল্লিতে। রাজধানীর হাসপাতালে তাঁর ডান দিকের ফুসফুসে টিউমার ধরা পড়ে। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে একটি ভিডিয়ো পোস্ট করে সেকথা জানিয়েছেন অভিনেত্রী নিজেই।
আরও পড়ুন: মরুভূমিতে ১৭ বছর পর জলের সন্ধান! Cactus-র জন্মদিনে নতুন গানে একসঙ্গে সিধু-পটা
সরস্বতী পুজোর ঠিক আগের দিন কাঁধের ব্যথা শুরু হওয়ার পরই ঐন্দ্রিলার পরিবার আর দেরি করেননি। তড়িঘড়ি তাঁকে দিল্লি নিয়ে যাওয়ার পর ক্যান্সার ধরা পড়ে। প্রথম কেমো নিয়েই শহরে ফিরে আসেন তাঁরা। কিছুদিনের বিশ্রামের পরই ফের চেনা ও কাছের শ্যুটিং ফ্লোরে ঐন্দ্রিলা। সেখান থেকে মেকআপ করার ছবিও শেয়ার করেন তিনি। আর সেই পোস্টেই তাঁকে শুভেচ্ছা বার্তায় ভরিয়ে দিয়েছিলেন সকলে। কিন্তু ধীরে ধীরে শারীরিক অবস্থা ও কোভিড পরিস্থিতির জন্য অভিনয় আপাতত বন্ধ রেখেছেন তিনি।
আরও পড়ুন: "একটা নুসরত তো শুধু সমাজের প্রতিফলন হতে পারে না..." Exclusive তসলিমা!
ঐন্দ্রিলা যে কত মানুষের মনে লড়ে যাওয়ার সাহস যোগাচ্ছেন, তা তিনি হয়তো নিজেও জানেন না। ঐন্দ্রিলা যাতে খুব তাড়াতাড়ি একেবারে সুস্থ হয়ে ওঠেন এখন সেটাই তাঁর সকল পরিবার-পরিজন, অনুগামীদের প্রার্থনা।