বিহারে ভোটপর্ব মিটতেই প্রতিটি বড় বড় মিডিয়া হাউসের এক্সিট পোলে একটাই খবর উঠে আসছিল। বিদায় ঘণ্টা বাজতে চলেছে নীতীশ কুমারের। টানা ১৫ বছরের মুখ্যমন্ত্রীত্বে এবার ইতি পড়তে চলেছে নীতীশ কুমারের। তৃতীয় পর্বের প্রচারে নীতীশের ভাষণ সেই জল্পনাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। বিহারের মসনদে আসতে চলেছে মহাজোট এমনটাই ধারণ করা হচ্ছিল। কিন্তু সব হিসেব উল্টে গেল মঙ্গলবার। সকালে ভোট গণনা শুরু হতেই মহাজোটের জয়-জয়কার শুরু হয়। কিন্তু বেলা গড়াতে দেখা যায় এগিয়ে রয়েছে এনডিএ শিবির।
'১৫ বনাম ১৫'-র টক্কর। অর্থাৎ লালু-রাবরির ১৫ বছর বনাম নীতীশ কুমারের ১৫ বছর। বিহার নির্বাচনের আগে এটাই স্লোগান ছিল বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের। নীতীশ কুমার তথা জেডিই এবং তাঁদের জোটসঙ্গী বিজেপি চেয়েছিল লালুপ্রসাদের আমলের সঙ্গে নীতীশের তুলনা করে ফায়দা লুটতে।
১৯৯০ সাল থেকে ২০০৫ বিহারে লালুপ্রসাদ যাদবের রাজত্ব ছিল। শেষ টার্মে লালু-জায়া রাবরি দেবী হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। এই ১৫ বছর সময়কে জঙ্গলের রাজের সঙ্গে তুলনা করে থাকেন বিরোধীরা। বিজেপি ২০২০-র নির্বাচন জিততে লালুপ্রসাদের ১৫ বছরকেই টার্গেট করেছিল।
বিহারের লালুপ্রসাদের ১৫ বছরকে যেমন অনুন্নয়ন, হিংসা আর দুর্নীতির বলে ধরা হয়, তেমন নীতীশের ১৫ বছরকে বিজেপি শিবির ব্যাখা করেছে আশা, সমতা, সম্মান ও উন্নয়নের বলে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ভোট প্রচারে এসে সেকথা বলেছেন।
এনডিএ শিবির প্রচার করে, ২০০৫ সালের আগে রাজ্যে কোনও সুশান তো দূরের কথা, প্রশাসনই ছিল না। তবে সেই জঙ্গলরাজ থেকে রাজ্যকে মুক্তি দিয়েছিল নীতীশ কুমারের নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের সরকার।
তবে নীতীশের আমলে বিহারের আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থার যে উন্নতি হয়েছে তা মানতে বাধ্য তার কট্টরি বিরোধীরাও। কিন্তু টানা ১৫ বছরের রাজত্বে বিহারে কিন্তু প্রতিষ্ঠান বিরোধীতার হাওয়া উঠেছিল। তার প্রমাণ মিলছিল লালুপুত্র তেজস্বীর জনসভাগুলিতে ভিড় দেখে। তাই অনেকেই মনে করেছিলেন এবা প্রতিষ্ঠান বিরোধীতার হাওয়ায় বোধহয় কুর্সি হারাতে হবে নীতীশকে।
এবারের বিহার ভোটে জাতপাত নয় বরং উন্নয়ন ও কর্মংস্থান মূল চালিকাশক্তি হয়েছিল। হারের যুব সমাজের কাছে নতুন আশার আলো হয়ে উঠেছিলেন তেজস্বী যাদব। এই যুব সমাজের ভোটই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল নীতীশ কুমারের কাছে।
দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪৬.৬ শতাংশ বেকারত্বের হার বিহারে। এরই মাঝে করোনা আবহে কয়েক লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিহারে ফিরেছেন কাজ হারিয়ে। ভোটের আবহে সেই পরিযায়ী ইস্যু নীতিশ সরকারের সবচেয়ে চিন্তার বিষয় ছিল।
তবে জেডিইউর আশা ছিল , কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদী যেভাবে পরিযায়ীদের নিজেদের রাজ্যে ফেরাতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন এবং পরবর্তীতেও পরিযায়ীদের জন্য জণমুখী প্রকল্পের ঘোষণা করেছেন, তার উপর ভর করেই ভোট বৈতরণী পার হয়ে যাবে এই যাত্রায়।
নীতীশ কুমারের সরকারের করোনা রোধী কার্যকলাপ বিহারের জনগণ মাথায় রাখবেন বলে আশা ব্যক্ত করেছিল দল।
এবারের ভোটের প্রচারের শেষদিন পূর্ণিয়ার একটি জনসভায় অবসরের ইঙ্গিত দিয়েছেন জেডিইউ নেতা নীতীশ কুমার। ভোটারদের মধ্যে সহানুভূতির ঝড় তুলতে এবং চতুর্থবার ক্ষমতায় ফেরার পথ প্রস্তুত করতে আবেগ উস্কে নীতীশ বলেছিলেন, আজ ভোট প্রচারের আজ শেষ দিন। এটাই আমার শেষ ভোট। শেষ ভালো তো সব ভালো।
তবে যাবতীয় জল্পনা পেছনে ফেলে ফের বিহারে এনডিএ রাজ হতে চলেছে। নীতীশ কুমারের নেতৃত্বেই যে ভোটে লড়ছে এনডিএ তা বারবার বলেছে বিজেপি শিবির। কিন্তু এতদিন বিহারে জোটে নীতীশ ছিলেন বড় শরিক। কিন্তু বিহার ভোটের ফল এবার যেদিকে যাচ্ছে, তাতে বিজেপির জয়জয়কার। বরং আসন কমেছে নীতীশের। এই অবস্থায় এনডিএ তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী ঘোষণা করলেও ভোটে জিতে কিন্তু চাপেই থাকলেন জেডিইউ সুপ্রিমো।
নীতীশ কুমারের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে বলতে গেলে , তাঁর রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৭৭ সালে। তাঁর জন্ম ১৯৫১ সালের ১ মার্চ। রাজধানী পাটনা থেকে ৩৫ কিলোমিচার দূরে বখতিয়ারপুরে।
৬৯ বছরের নীতীশ কুমার পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। বিহার কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে বিটেক (ইলেকট্রিকাল) করেছেন। এই ইনস্টিটিউটটি এখন এনআইটি পাটনা নামে পরিচিত। তাঁর স্ত্রী মঞ্জু সিনহা পেশায় একজন স্কুল শিক্ষিকা ছিলেন। ২০০৭ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। নীতীশের প্রিয় খাবার বাটার মসালা।
তবে গত দেড় দশক মু্খ্যমন্ত্রী পদে থাকলেও নীতীশ কুমার কোনওদিনই বিহারে বিধানসভা ভোটে লড়েননি। বরাবরই বিধান পরিষদের সদস্য থেকেছেন তিনি। এ বারেও যথারীতি তিনি বিধানসভা ভোটে দাঁড়াননি। তবে একাধিক বার লোকসভা ভোটে জিতে সাংসদ হয়েছেন জেডিইউ সুপ্রিমো।