‘লা সো লাদাখ’ কথাটির অর্থ হ্রদ ও গিরিবর্তের দেশ। সমগ্র ভারতের মধ্যে লাদাখ সবথেকে বৈচিত্র্যময়। এখানে আট হাজার আটশো ফুটের নীচে কোনও জায়গা নেই। সুউচ্চ পর্বতশ্রেণি, মরুভূমি, অসংখ্য হ্রদ এবং কিংবদন্তিসম প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার জনক সিন্ধু নদ। হিমালয়ের বৃষ্টিচ্ছায় ঢালে অবস্থিত বলে লাদাখ বৃষ্টিহীন শুকনো।
হিমালয় সীমার মধ্যে অবস্থিত লাদাখ ২০১৯ সালে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসাবে একটি নতুন পরিচয় পেয়েছে। প্রায় ২ লক্ষ ৭০ হাজার মানুষের বাল লাদাখে তিব্বতি সংস্কৃতি দেখা যায়। জানুয়ারি মাসে এখানে গড় তাপমাত্রা মাইনাস ১২ ডিগ্রিতে নেমে যায়। যখন ভারী তুষারপাত হয়, তখন তাপমাত্রা মাইনাস ৩৫-এ নেমে যায়।
দীর্ঘ এক বছর বন্ধ থাকার পর অবশেষে পর্যটকদের জন্য ভারতের লাদাখের বিখ্যাত প্যাংগং লেক উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। গত ১০ জানুয়ারি থেকে এটি চালু করা হয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৪ হাজার ফুট (৪ হাজার ২৭০ মিটার) উপরে অবস্থিত লেকটি বিশ্বের সর্বোচ্চ নোনতা পানির হ্রদ। মহামারি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব এবং সীমান্তে চীন-ভারত উত্তেজনার কারণে এতদিন ধরে এটি বন্ধ ছিল। এখন পুনরায় চালু করায় স্থানীয়দের মাঝে ব্যাপক আশার সঞ্চার হয়েছে। কারণ অঞ্চলটির অধিকাংশ মানুষ পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল।
লাদাখের ৬০ শতাংশ মানুষই পর্যটন শিল্পের ওপর নির্ভর করে। আর শীতকালে এখানকার অন্যতম আকর্ষণ হল চাদর ট্রেক।
ডাল লেকের মত জমে গিয়েছে লাদাখের জাংস্কার নদীও। জাংস্কার নদী সিন্ধু নদের উপনদী । এই নদী ডোডা নদী ও সারাপ নদী মিলিত হয়ে তৈরী হয়েছে। পাদুমে পৌঁছে সারাপ নদী ডোডা নদীর সাথে মিশে সিন্ধু নদের উপনদী জাংস্কার নদী তৈরী করেছে। এরপর এই নদী জাংস্কার গর্জের মধ্যে দিয়ে উত্তর পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে নিম্মুতে সিন্ধু নদের সাথে মিলিত হয়েছে।
শীতকালে জাংস্কার নদীর ওপর জমে যাওয়া বরফের স্তর। আর তাতেই চলে ট্রেক। চাদর ট্রেক ভারতের একটি দুঃসাহসিক ট্রেকিং পথ। স্থানীয় ভাষায় "চাদর" মানে বরফের আস্তরণ, বরফে ঢাকা জাংস্কার নদীর ওপর পথ চলাকেই মূলত চাদর ট্রেক বলা হয়। তবে গরমের সময় এই নদীতে উৎসাহী পর্যটকরা রাফটিং করেন।
জান্সকার লাদাখের একটি শীতকালীন-পথ। এই পথের দুই ধারের প্রাচীরগুলি প্রায় ৬০০ মিটার উচ্চ উল্লম্ব খাড়া পাহাড় এবং কোথাও কোথাও জাংস্কার নদী মাত্র ৫ মিটার প্রশস্ত। শীতকালে জাংস্কার উপত্যকায় পৌছবার একমাত্র পথ জমে যাওয়া জাংস্কার নদীতে ট্রেকিং। স্থানীয়রা এবং পর্যটকরা শীতকালে এই জমে যাওয়া বরফের রাস্তাটি ব্যবহার করেন, যেটি চাদর ট্রেক নামে বিখ্যাত। স্থানীয় অধিবাসী মানুষ শতাব্দী ধরে এই পথে যাতায়াত করে বাণিজ্য করেছেন।
অনেক বছর ধরে চাদর ট্রেক সারা বিশ্ব থেকে পর্যটকদের আকৃষ্ট করেছে। এটা সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ এবং দুঃসাহসিক ট্রেকিং যার মোট দূরত্ব প্রায় ১০৫কিমি (পায়ে হেঁটে), গড়ে প্রতিটি দিন ১৫-১৭ কিমি দূরত্ব বরফের ওপর, কখনো পাহাড়ের ধার ধরে ট্রেক করতে হয়। চাদর ট্রেকের উপযুক্ত সময়, জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি,যখন তাপমাত্রা, কখনও কখনও মাইনাস ৩০ থেকে মাইনাস ৩৫ ডিগ্রিতে নামে , তখন জাংস্কার নদীকে মনোরম ক্রীস্টাল হ্রদের মত দেখায়।
জাংস্কার নদীর গর্জ বরাবর গ্রীষ্মকালে চিলিং থেকে নিম্মু পর্যন্ত ভ্রমণপিপাসুদের ভিড় লেগে থাকে। শীতকালে জাংস্কার যাওয়ার রাস্তা তুষারপাতের জন্য বন্ধ হয়ে গেলে, বরফ জমা জাংস্কার নদীর ওপর দিয়ে ট্রেকাররা চিলিং, তিলত সামদো, টিব, নেরাক হয়ে পাদুম পর্যন্ত কয়েকদিনে হেঁটে যেতে পারে। এই ট্রেক চাদর ট্রেক নামে বিখ্যাত। শীতকালে নেরাক গ্রামে অবস্থিত জমে যাওয়া জলপ্রপাত ট্রেকারদের নিকট একটি আকর্ষণীয় স্থান।
লেহ এবং জাংস্কারের মধ্যে সারাবছর যোগাযোগ রাখার জন্য বর্তমানে, একটি রাস্তা নির্মাণের কাজ চলছে। আশা করা হচ্ছে সম্পূর্ণ কাজটি শেষ হতে কয়েক বছর লাগবে। দীর্ঘকাল ধরে এই রাস্তাটি স্থানীয়দের দাবি ছিল এবং রাস্তাটি হলে তাদের জীবন অনেক সহজ হবে, বিশেষভাবে শীতকালে চিকিৎসা ইত্যাদী জরুরী প্রয়োজনে। তবে রাস্তা নির্মাণ হলে স্থানীয় বন্যপ্রাণী, মূলত তুষার চিতাবাঘের জীবন বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বিশ্বের ছাদ হিসেবে পরিচিত লাদাখ। হাজার বছরের বেশি সময় ধরে সেখানে হিমালয়ের সৌন্দর্য্য ও প্রাচীন বৌদ্ধ সংস্কৃতি মিলে মিশে রয়েছে। পর্যটকদের স্বর্গভূমি লাদাখ, মানুষকে আকর্ষণ করে মূলত তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য, গ্রাম্য সরলতা এবং আধ্যাত্মিকতার মিশ্রনের কারণে।