মানুষের অবাঞ্ছিত উৎপাত নেই বললেই চলে। গাড়ির শব্দ, বিষাক্ত ধোঁয়া উধাও সবুজের গালিচায়।
নেই ট্রেনের দাপাদাপি। রাজ্য সড়ক, জাতীয় সড়ক, জঙ্গলের পথে ৯০ শতাংশ গাড়ি চলাচল বন্ধ।
উত্তরের জঙ্গলে এখন চারিদিকেই সবুজের সমারোহ। একটানা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক এখন শহর থেকেও শোনা যাচ্ছে।
গভীর জঙ্গল যেন গভীর থেকে গভীরতম হয়ে উঠেছে। তাই শহর-জঙ্গল এক হয়ে গিয়েছে।
টানা লকডাউনের জেরে দূষনমুক্ত জঙ্গলের পরিবেশ এখন যেন বন্যপ্রাণীদের অবাধ বিচরণ ভূমি।
ফি বছর ডুয়ার্সের জঙ্গলে বন্যপ্রাণীর দর্শন পেতে গাঁটের টাকা খরচ করে পর্যটকরা ভিড় জমান ডুয়ার্সের জঙ্গলে।
শুধু মাত্র এক ঝলক বন্যপ্রাণীর দেখা পেতে হাপিত্যেশ করেন কাতারে কাতারে পর্যটক।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বন্যপ্রাণীর দেখা না পেয়ে নিরাশ হয়ে ফিরতে হয় তাদের। তবে লকডাউনের জেরে বন্যপ্রাণীরা ফিরে পেয়েছে তাদের নিজস্ব পরিবেশ।
সে কারণেই ডুয়ার্সের জঙ্গল লাগোয়া পরিবেশে এখন যত্রতত্র দেখা মিলছে বন্যপ্রাণীদের।
আলিপুরদুয়ার জেলার বক্সা টাইগার রিজার্ভের রাজা ভাতখাওয়া, পানবাড়ি, গদাধর, রায়ডাক, জয়ন্তী, পানার জঙ্গলগুলোতে গৃহপালিত পশুর মতো বিচরণ করছে হাতির পাল, বাইসনের দল।
গ্রামাঞ্চলে মাঠে ঘাটে একান্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে হরিণের ঝাঁক। দিনের আলোতেই বনবস্তি, চা বাগান, গ্রামাঞ্চলে প্রায়ই দর্শন পাওয়া যাচ্ছে চিতাবাঘের।লোকালয়ের কাছাকাছি চলে আসছে বুনো শূয়রের দল।
একই চিত্র জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যান সংলগ্ন এলাকায়। ইতিমধ্যেই বক্সার কোর জঙ্গলের বাসিন্দা যার দর্শন পাওয়া অতি সৌভাগ্যের বিষয়, সেই মালায়ান জায়েন্ট স্কুইরালের দেখা মিলেছে রাজাভাতখাওয়ার গাড়ো বস্তির রাজ্য সড়কের ধারে।
হিমালয়ান নেচার আ্যন্ড অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশনের(HNAF) কো-অর্ডিনেটর অনিমেষ বসু বলেন, মানুষ এখন বন্দিদশায়। তাই বন্যপ্রাণীরা মুক্ত।আমরা এখন ওদের বিরক্ত করছি না।
এই লকডাউনে মানুষের ক্ষতি হলেও বন্যপ্রাণীদের ক্ষেত্রে ভালো হয়েছে। বন্যপ্রাণীরা ফিরে পেয়েছে তাদের নিজস্ব পরিবেশ। এতদিন আমরা জঙ্গলে ওদের দেখতে যেতাম। ওদের বিরক্ত করতাম।
অনিমেষ বসু বলেন, আজ আমরা এখন খাঁচায় বন্দী তাই ওরা আমাদের দেখতে আসছে। জঙ্গলে কার সাফারি, হাতি সাফারি, মানুষের অবাধ বিচরণ বন্ধ হয়েছে।তাই মুক্ত পরিবেশে বন্যপ্রানীরা নিশ্চিন্তে অবাধে বিচরণ করছে।
এখন ওদের মিলনের সময় লকডাউনের এই পরিবেশ বন্যপ্রাণীদের স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো।
বক্সা টাইগার রিজার্ভের এফডি(ফিল্ড ডাইরেক্টর) বুদ্ধরাজ শেওয়া বলেন এই লকডাউনে জঙ্গলে মানুষের প্রবেশ বন্ধ তাই বন্যপ্রাণী বাইরে বেড়িয়ে আসছে।
জঙ্গলে টুরিস্ট নেই। গাড়ি, ট্রেন চলাচল বন্ধ। বন্যপ্রাণীদের চলাচলের করিডরগুলোতে মানুষের আনাগোনা নেই সে কারনেই এখন বন্যপ্রাণীদের দেখা মিলছে।
বনের পশুরা কখনও বাড়ির উঠোনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আবার কখনও রাস্তায় উঠে গা ঝাড়া দিচ্ছে।
কারণ রাস্তায় গাড়ি নেই বললেই চলে। সুতরাং কম্পন অনেক কমে গিয়েছে। বনের পশুরাও ধন্দে।
তাঁরাও বুঝতে পারছেন না, হঠাৎ মানুষের হল টা কী! তাই তাঁরাও উৎসুক হয়ে নিজের টেরিটরি ছেড়ে বেড়িয়ে আসছেন বাইরে।
কি চলছে চারিদিকে তা দেখার জন্য। তাই শহর এলাকায় যেখানে মানুষের স্বঘোষিত একচ্ছত্র অধিকার, সেখানেও প্রবেশ করছে তারা।
আলিপুরদুয়ার হোক, কিংবা শিলিগুড়ি। মালবাজার কিংবা চালসা। জনপদের মধ্যেই আজকাল বেশি ঘুরছে বন্যপ্রাণীরা।
পাশাপাশি বাধা না থাকায় চাষের জমিতে ফলে থাকা ধান, ভুট্টা খেতে তারা নেমে আসছে। লোকালয়ে।
কখনও ছাগলটা, কুকুরটা ধরতে ছুটে আসছে চিতাবাঘও। গবেষকদের দাবিতে কুকুরদের সংখ্যাধিক্য লোকালয়ে চিতাবাঘের আনাগোণা বাড়িয়েছে।
এমনকী ভিরু প্রজাতির প্রাণী হরিণও কখনও কখনও পথ ভুলে দলবল নিয়ে ঢুকে পড়ছে শহরাঞ্চলে।
এমনকী কিছু কাঠবিড়ালি দেখা গিয়েছে। যেগুলি সাধারণত গভীর জঙ্গল থেকে বের হয় না। সেগুলিও খোলা মাঠে চলে আসছে।