সিঙ্গুর শুধুমাত্র একটি নিছক জনপদ নয়। সিঙ্গুর শুধু একটি গ্রামের নাম নয়। সিঙ্গুরএকটি আন্দোলনের নাম। সিঙ্গুর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক উত্থানের ইতিহাসের কাহিনি। সিঙ্গুর একটি ব্র্যান্ড রাজনীতির রূপক। সেই সিঙ্গুর, যেখান থেকে কৃষক আন্দোলন শুরু হয়েছিল। নন্দীগ্রামে পুলিশের গুলি চালনার ঘটনায় যা এক ভিন্ন পরিণতি লাভ করেছিল। সেই আন্দোলনে বিপুল জয়ের মাধ্যমে সিপিএম-এর দীর্ঘ রাজনীতির অবসান ঘটিয়ে,মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সগৌরবে মহাকরণে প্রবেশ করেছিলেন।
সেই সিঙ্গুরে আবার একটি নির্বাচন। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে আগামী ১০ এপ্রিল শনিবার,সিঙ্গুরে ভোট হতে চলেছে। সিঙ্গুরের মানুষ এখনও কী একইভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সমর্থন করছেন?
সিপিএম সক্রিয়ভাবে আবার নতুন উত্থানে প্রার্থী দিয়ে জানাতে চাইছে, তোমরা মারাত্মক ভুল করেছিলে, শিল্প হলে আজ সিঙ্গুরের মানুষেরা চাকরি পেত। সেই প্রচার কী তৃণমূল কংগ্রেসকে আঘাত হানবে? বিজেপি বলছে, আমরা শিল্প চাই। নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সিঙ্গুর নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। নরেন্দ্র মোদী বলছেন, সিঙ্গুর থেকে টাটা-কে তাড়িয়ে দেওয়াটা ঠিক হয়নি। দিদি, পশ্চিমবঙ্গে শিল্প প্রয়োজন। ঠিক যেইভাবে একদিন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও বলেছিলেন, কৃষি থেকে আমাদের শিল্পে যেতে হবে। কেননা, কৃষকদের মাধ্যমে অর্থনীতিটা একটা স্যাচ্যুরেশন পয়েন্টে পৌঁছে গেছে। এইবারে কৃষির জায়গায় শিল্প গঠন প্রয়োজন।
সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। তার জবাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কী বলছেন? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর দলের সমস্ত সদস্যরা, প্রতিনিধিরা, মুখপাত্ররা বলছেন, টাটাকে নিয়ে গিয়ে সানন্দে যখন আপনি ন্যানো কারখানা গড়েছিলেন, সেই কারখানা তো সফল হতে পারেনি। তাহলে টাটাকে চলে যেতে হল কেন? ন্যানো কারখানা বন্ধ করতে হল কেন? সেইখানে গুজরাট মডেলের সাফল্যটা কোথায়? এই বিতর্ক কিন্তু জমে উঠেছে। মোদী বনাম মমতা এ একসাংঘাতিক লড়াই! এ এক সাংঘাতিক তু তু ম্যায় ম্যায় –এর রাজনীতি! শুধু সিঙ্গুর নয়, সিঙ্গুরের আশেপাশের বিস্তীর্ণ এলাকায়ও কিন্তু এই প্রচার অব্যাহত রয়েছে।
বিজেপি, নতুন পশ্চিমবঙ্গ এবং স্বপ্নের বাংলা গড়ার জন্যে শিল্পের কথা বলছে, গুজরাট-মডেলের কথা বলছে। এ কথা সত্য যে, জাপানের প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ গোটা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুজরাটে। ভাইব্রেন্ট গুজরাটের অনুষ্ঠানে আমি বারবার দেখেছি, কী বিরাট একটা কর্মযজ্ঞ তৈরি হয়েছে সেখানে! তবে গুজরাটের জমি আর পশ্চিমবঙ্গের জমির মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে। গুজরাটের জমি অনেক ঊষর, সেখানে অনেক স্পেশাল ইকনমিক্স জোন করা যায়। পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীরা এখানে জমি সংস্কার করেছে। তার ফলে জমিগুলো ফ্রাগমেন্টেড হয়ে গেছে। টুকরো টুকরো খন্ডিত জমি, বর্গাদার চাষি এখানে অনেক। তার ফলে জমি খুব উর্বর। তিন ফসল ও চার ফসলের জমি। সেই জমি নেওয়ার জন্যই এই আন্দোলন। সেই জমিতে কেন কারখানা হবে? এটাই ছিল মমতার প্রশ্ন।
মমতা মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় বারবার এটা বোঝাবার চেষ্টা করেছেন যে, তিনি শিল্পায়নের বিরূদ্ধে নন, তিনি জোরপূর্বক কৃষকদের জমি কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে ছিলেন। প্রথমে ঠিক হয়েছিল খড়গপুরে এই কারখানা হবে। কিন্তু টাটারা রাজি হননি। সেই সময় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের শিল্প মন্ত্রী প্রয়াত নিরুপম সেন বলেছিলেন, শিল্পকে ছাড় না দিলে তারা আসবে কেন? সিঙ্গুরটা কলকাতা থেকে কাছে, হুগলি নদীর কাছে। সেই কারণে জায়গাটা পছন্দ হয়েছিল টাটাদের। জায়গাটা তাদেরকে দিতে চেয়েছিলেন বুদ্ধদেব, নিরুপম। কিন্তু সেটা বুমেরাং হয়েছিল রাজনৈতিক ক্ষেত্রে।
আজ এত বছর পরে আবার একটা বড় আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে সেই সিঙ্গুর। বেচারাম মান্না এবং তাঁর স্ত্রী, যাঁরা সিঙ্গুর আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন, তাহলে তো তাঁদের দু’জনকেই মমতা টিকিট দিয়ে সেই সিঙ্গুর আন্দোলনের একটা রিভাইভাল স্মৃতির একটা পুনরুজ্জীবনের চেষ্টা করেছেন। অন্যদিকেএলাকার সৎ মাস্টারমশাই বলে পরিচিত শিক্ষক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য মমতাকে সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু তাঁর অনেক বয়স হয়ে গেছে। তিনি নিজেই বলেছেন, মমতা তাঁকে টিকিট না দেওয়ায় তিনি বিজেপিতে চলে গেছেন। তিনি অভিমান করেছেন। বেচারাম মান্নার সঙ্গে তাঁর দীর্ঘদিনের সমস্যা। সেই রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যই বিজেপির প্রার্থী হয়ে ওখানে কী আঘাত হানতে পারবে? এই প্রশ্নটাও আছে।
২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে লেফ্টফ্রন্ট বিরোধী ভোট ছিল ৪৪.৪৬%।তার মধ্যে তৃণমূল পেয়েছিল ৩৫.৭১%। আদিবাসী সমাজের একটা বড় অংশের ভোট কিন্তু তৃণমূলেরপক্ষে ছিল। হুগলিতে সাঁওতাল এবং মুন্ডাসহ আদিবাসী জনসংখ্যা প্রায় ২.১২লক্ষ (৪.২%)। হুগলিতে মুসলিম জনসংখ্যা ৭.৬৩ লক্ষ, মোট জনসংখ্যা ১৫.১৪%। ২০০৬ সালে সিঙ্গুরে তৃণমূলের ভোট ৪৭.৯২%। ২০০১ সালে ৫৩.৩২% ভোট।
মমতা যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, তাতে তিনি নকশালদের সমর্থন পেয়েছিলেন, বুদ্ধিজীবীদের সমর্থন পেয়েছিলেন। সেই সময় অপর্ণা সেন থেকে শুরু করে বিভিন্ন চলচ্চিত্রের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা মিছিল করে সিঙ্গুরে গেছেন, পথ অবরোধে সামিল হয়েছেন। অবশেষে দীর্ঘদিনের সিপিএম-কে শেষপর্যন্ত চলে যেতে হয়েছিল। আজ সেই সিঙ্গুর একা নয়, চারপাশের যেসব কৃষি জমিতে যে কারখানা হল না,সেখানকার অর্ধেক জমিতে সিমেন্ট লাগিয়ে, সেই জমিটাকে নষ্ট করে দিচ্ছিল টাটা। সেই জমিতে চাষও হল না। এখনও সেখানে মেধা পাটেকর, যোগেন্দ্র যাদবেরা আসছেন। এখনও মমতার স্বপক্ষে যখন কৃষকদের আন্দোলন দিল্লিতে এবং গোটা দেশে হচ্ছে তখন সিঙ্গুরের কৃষকরা তাতে যুক্ত হচ্ছেন। কিন্তু এবারের ভোটের সময় এর পরিণতি কী হবে, সেটাই এখন দেখার!