সুভাষচন্দ্র বসু, বাঙালির এক চিরকালীন আবেগ। তাঁকে নিয়ে নানা গল্পকথা সময়ের সঙ্গে কার্যত মিথে পরিণত হয়েছে। আর সে সবের তলায় চাপা পড়ে গেছে নেতাজির রোমাঞ্চকর জীবনের কিছু আশ্চর্য তথ্য। নেতাজি তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন দেশের জন্য। ভারতের ইতিহাসে নেতাজির অবদান কোনদিন ভুলবার নয়। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নামটি ভারতে উচ্চারিত হয় পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে। কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত জীবন কেমন ছিল? কেবল কি গাম্ভীর্যে ভরা? চলুন জেনে নেওয়া যাক প্রেম ও বিয়ে নিয়ে নেতাজির জীবনের এক অজানা গল্প।
ইউরোপে যে স্ত্রী ও এক শিশুকন্যা রেখে গিয়েছেন তিনি, একথা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার বছরখানেক পরেও তাঁর পরিবারের কেউ জানতেন না, বাইরের দুনিয়ার কেউ তো নয়ই। আজও অনেকেই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, নেতাজি কোনদিন বিয়েই করেননি, সন্তানের জন্ম দেওয়া তো দূরের কথা। 'দ্য বোস ব্রাদার্স অ্যান্ড ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেনস, অ্যান ইনসাইডারস অ্যাকাউন্ট' শীর্ষক বইতে লেখিকা মাধুরী বসু সবিস্তারে লিখেছেন, কীভাবে নেতাজির স্ত্রী এমিলি শেঙ্কেল, যিনি জন্মসূত্রে অস্ট্রীয় হলেও জার্মানির নাগরিক ছিলেন, ১৯৪৬ সালে নেতাজির দাদা শরৎচন্দ্র বসুকে চিঠি লিখে জানান, জার্মানিতে বিদেশি নাগরিককে বিয়ে করার ঝঞ্ঝাট এড়াতে কেন হিন্দুমতে বিয়ে করেছিলেন তিনি ও সুভাষ। কীভাবে তাঁর কন্যার নাম 'অমিতা ব্রিজিট' না রেখে 'অনিতা ব্রিজিট' রেখেছিলেন, যাতে জার্মান কর্তাদের সন্দেহ না হয়। চিঠিতে এমিলি স্পষ্ট করে দেন, কোনোরকম অর্থিক সাহায্য চান না তিনি, স্রেফ অনিতার সম্পর্কে সুভাষের পরিবারকে অবগত করতে চান, যাতে তাঁর কিছু হলে মেয়ের দেখাশোনায় কোনও বিঘ্ন না ঘটে।
জার্মানিতে হিন্দু মতে বিয়ে নেতাজির
নেতাজি ও এমিলি দুজনেই জানতেন এই সম্পর্ক আর পাঁচটা সম্পর্কের মতো সহজ হবে না। অন্যদের থেকে এই সম্পর্ক যে আলাদা তা সুভাষচন্দ্র বসু ও এমিলি শেঙ্কল দুজনেই বুঝে গিয়েছিলেন একেবারে শুরুতেই। বিয়ে নিয়ে চূড়ান্ত গোপনীয়তা ছিল। তা গোপনও করা হয়েছিল। বিয়ের খুঁটিনাটিও এমনকী আত্মীয়দের জানানো হয়নি বিশেষ। এভাবেই ১৯৩৭ সালের ২৬ ডিসেম্বর নেতাজি বিয়ে করেন এমিলিকে। অস্ট্রিয়ার একটি রিসর্টে দুজনের বিয়ে হয়। এবং জানা গিয়েছে, বিয়ের সময় বাঙালিদের মতোই মাথায় সিঁদুর পরেছিলেন এমিলি। ১৯৩৪ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত একযুগ সংসার করলেও দুজনে কখনও সবমিলিয়ে তিন বছরের বেশি একসঙ্গে ছিলেন না। এরই মাঝে ১৯৪২ সালের নভেম্বর মাসে তাঁদের কন্যা অনিতার জন্ম হয়।
৩৭ বছরের নেতাজির সঙ্গে ২৩ বছরের এমিলির প্রেম
তবে এসবের আগেও তাদের দেখা ও প্রেম হয়েছিল। ১৯৩২ সালের শেষে সুভাষ ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি চিকিৎসার জন্য অস্ট্রিয়া যান। সেখানে কিছুদিন থাকার পরে ১৯৩৪ সালে বই লেখার কাজে হাত দিলে তাঁর প্রয়োজন ছিল এক সহকারীর। এবং দুজনের মধ্যে থেকে সুভাষ বেছে নেন এমিলিকেই। এমিলির তখন ২৩ বছর বয়স। সুভাষের ৩৭। এরপরই দুজনের সম্পর্ক গভীরতা পায়। সুভাষই এগিয়ে আসেন। তাতে সাড়া দেন এমিলিও। এভাবেই সম্পর্ক পরিণতি পায়। স্বাধীনতা আন্দোলনের কাজে, সুভাষ নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। তবে এমিলির কথা কখনও ভুলে থাকতেন না তিনি। দীর্ঘ একদশকের সম্পর্কে চিঠির মাধ্যমেই একে অপরের মনের কথা জেনেছেন তাঁরা। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত লড়াইয়ের সময় নিজের জীবন নিয়ে অনিশ্চিত ছিলেন সুভাষ। এমিলিকে লিখেছিলেন, প্রাণে বেঁচে নাও থাকতে পারি, তোমাকে আর নাও দেখা দিতে পারি, ফাঁসি অথবা গুলি খেতে পারি। তবুও জানবে তুমি আমার হৃদয়ে রয়েছো। এই জন্মে না হলেও পরের জন্মে আমরা একসঙ্গে থাকব। সেই চিঠি বুকে আগলে এমিলি ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। সুভাষের প্রেমকে মনে করেই জীবনের শেষ বছরগুলি কাটিয়েছেন এমিলি।
দেশে থাকতে এসেছিল বিয়ের প্রস্তাব
দেশ ছেড়ে যাওয়ার পর অজ্ঞাতবাসের দিনগুলিতেই বিয়ে করেছিলেন নেতাজি। তবে অল্পবয়স থেকেই বিয়েতে অনীহা ছিল সুভাষের, এমন দাবি করেছেন তাঁর কোনও কোনও জীবনীকার। বিয়ে প্রসঙ্গে সুভাষের মতামত কেমন ছিল, তা জানা যায় ত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রী বাসন্তী দেবীর বক্তব্য থেকেও। বাসন্তী দেবীকে ‘মা’ বলে ডাকতেন সুভাষ। সেই বাসন্তী দেবীই গল্প বলেছিলেন, সুভাষ তখন সুদর্শন তরুণ। দুর্দান্ত বাগ্মী। কংগ্রেসের তেজি নেতা। দেশবন্ধুর ডান হাত। দেশবন্ধু কলকাতার প্রথম মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পরেই ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের চিফ এগজিকিউটিভ অফিসার হয়েছেন সুভাষ। এই পরিস্থিতিতে এলিজিবল ব্যাচেলর, অর্থাৎ যোগ্য পাত্রদের তালিকার প্রথম দিকেই যে তাঁর নাম থাকবে, সে কি আর বলার অপেক্ষা রাখে! তাঁর সঙ্গে মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে দাশ দম্পতির দরবারে হাজির হতেন অনেকেই। একবার তেমনই এসেছিলেন একজন। কংগ্রেসের তিলক তহবিলে এক লক্ষ টাকা দান করবেন তিনি, তবে শর্ত একটাই। সুভাষকে জামাই হিসেবে পেতে চান তিনি। চিত্তরঞ্জন দাশ তখন কংগ্রেসের অন্যতম শীর্ষ নেতা। কিন্তু শিষ্যের সঙ্গে মশকরা করার এমন সুবর্ণ সুযোগ ছাড়েননি তিনিও। বাড়িতে জরুরি তলব করেন নেতাজিকে। হন্তদন্ত হয়ে সুভাষ এসে হাজির। তাঁকে অনুদানের খবর জানান দেশবন্ধু। দেশের কাজে তখন নিয়মিতই টাকার দরকার। ফলে সুভাষ যথারীতি উচ্ছ্বসিত। এরপরই আসল কথাটি ভাঙেন চিত্তরঞ্জন। বলেন, টাকা পাওয়ার আগে ছোট্ট একটা সমস্যা আছে। সুভাষ বিয়ে করলেই সেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আকাশ থেকে পড়েন সুভাষ। সারাদিনের পরিশ্রমের পর ব্যতিব্যস্ত হয়ে এসে এমন ঠাট্টা যে তাঁর মোটেই পছন্দ হয়নি, সে কথা বুঝিয়ে দিতেও কসুর করেননি তিনি। অবশ্য এই সময়ে রেগে গেলেও বাসন্তী দেবীর প্রশ্নের উত্তরে স্পষ্ট উত্তর দিয়েছিলেন সুভাষ। বিয়ের ব্যাপারে তাঁর কী মত, এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি নাকি জানিয়েছিলেন, বিয়ে না করার মতো কোনও সিদ্ধান্ত নেই তাঁর। পরবর্তীকালে এমিলি শেঙ্কলের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া বোধহয় সেই কথারই সাক্ষ্য দিয়েছিল।