সঙ্গীত শিল্পী লতা মঙ্গেশকরের প্রয়াণ ঘটেছে। তবে বয়স বাড়লেও তাঁর গলায় ছিল অদ্ভুত এক জাদু, যা মোহিত করে রাখত শ্রোতাদের। ঠিক কী কারণে এতটা সুরেলা ছিল তাঁর কণ্ঠ? আসলে সঙ্গীত শিল্পীরা সাধারণ মানুষের মতোই হন। তাঁদের ফুসফুস, গলা ও মুক্র মাংসপেশী এবং গ্রন্থিও একই ধরনের হয়। তাহলে কীভাবে কেউ ভাল গান করতে পারেন তো কেউ আবার একটুও গাইতে পারেন না? এককথায় বলতে গেলে, সঙ্গীত শিল্পীদের শারীরিক গঠন যখন অন্যান্য মানুষের মতোই হয় তাহলে তাঁরা কেমন করে এত ভাল গান করেন?
the world.org-এ প্রকাশিত একটি খবর অনুযায়ী, ম্যাসাচুসেটস হাসপাতালের ভয়েস সেন্টারের পরিচালক স্টিভেন গিটেলস জানান, সুন্দর গান বা সুমধুর কণ্ঠের নেপথ্যে রয়েছে ভোকাল মাসল (Vocal Muscle)। এটি মুখের পিছন দিকে থাকা এক ধরনের বিশেষ মাংসপেশী, যা মানুষকে কথা বলতে ও গাইতে সাহায্য করে। এগুলি সাধারণত ল্যারিঙ্কস-এ থাকে।
আরও পড়ুন - Valentine's Day-কে স্পেশাল করে তুলতে চান? ট্রাই করুন এই আইডিয়াগুলি
ল্যারিঙ্কসকে (Larynx) ভোকাল ফোল্ডও বলা হয়। এটি সাধারণত সাদা রঙের লিগামেন্ট দিয়ে তৈরি। এটি ইংরেজির ২টি 'V' অক্ষরের মতো দেখতে। সেটি একটি পাতলা ঝিল্লি বা মেমব্রেন দিয়ে ঢাকা থাকে। আমরা যখন কথা বলি বা গান করি তখন এই সাদা রঙের লিগামেন্ট কাঁপতে শুরু করে, অর্থাৎ ভাইব্রেট হয়। যে শিল্পী যত বেশি সময় ধরে এই লিগামেন্ট ভাইব্রেট করতে পারেন তিনি তত ভাল গাইতে পারেন।
এই ভোকাল ফোল্ড বা সাদা লিগামেন্টকে আলাদা আলাদাভাবে কাঁপানোর জন্য প্রয়োজন মজবুত ফুসফুস। কারণ যখন ফুসফুস থেকে বায়ু ভোকাল ফোল্ডে পৌঁছায় তখন এই সাদা লিগামেন্ট প্রয়োজন মতো সেটিকে মডিউলেট করে নেয়। বায়ু মডিউলেশনের পর লিগামেন্ট থেকে আওয়াজ বের হয় সেটি সুরেলা শুনতে লাগে।
ভাল গানের জন্য নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন?
কথা বলা, চলাফেরা, গান গাওয়া, সবেতেই প্রয়োজন নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া। এর মধ্যে কথা বলা ও গান গাওয়ার সময় এটির সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয়। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণের রাখার জন্য রীতিমতো অভ্যাস করতে হয় শিল্পীকে। এই কাজে ডায়াফ্রাম, পেটের পেশী, পিঠের পেশী এবং পাঁজরের মধ্যবর্তী পেশী সবেচেয়ে বেশি সাহায্য করে। এইগুলি একসঙ্গে কাজ করলে তবেই বের হয় শব্দ, গান করতে পারেন শিল্পী। এককথায় বলতে গেলে শ্বাসবায়ু নিয়ন্ত্রণ করতে এই পেশীগুলি খুবই কার্যকরী।
শ্বাসের থেকেই শব্দের জন্ম
লন্ডন সিঙ্গিং ইনস্টিটিউট জানাচ্ছেন, ফুসফুস থেকে বের হওয়া বায়ু ভোকাল কর্ডকে সক্রিয় করে। ভোকাল কর্ডে থাকে ছোট ছোট মাংসপেশী, যাকে ভোকাল ফোল্ড বলা হয়। সেগুলি থাকে ল্যারিঙ্কসের মধ্যে। ল্যারিঙ্কসকে বলা হয় ভয়েস বক্স। এটি গলার ভিতরে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে, যা শব্দ সৃষ্টি করে। সেটিতে শ্বাসবায়ু যায় এবং সাদা লিগামেন্ট কম্পিত হয়। যার ফলে বের হয় ধ্বনি তরঙ্গ। এরপর সেটিই মুখ দিয়ে বাইরে আসে ও কান সেটিকে শব্দ বলে চিহ্নিত করে।
আরও পড়ুন - ভেন্টিলেশনে শেষের দিনগুলিতে কার গান শুনতেন Lata Mangeshkar?
সঙ্গীত শিল্পীদের হামেশাই দেখা যায় যে তাঁরা নিজেদের গলার শব্দ কখনও খুব উঁচুতে ও নিচুতে নিয়ে যাচ্ছেন। বিষয়টি হল, এমনটা যে কেউ করতে পারেন। তবে আওয়ান নিয়ন্ত্রণ রাখতে সঙ্গীত শিল্পীরা আগে থেকেই নিজেদের বেশকিছু অঙ্গের কার্যকরিতায় ভারসাম্য বজায় রাখেন। আর তার জন্য বছরের পর বছর অভ্যাস করতে হয়, যাকে বলা হয় রেওয়াজ বা প্র্যাকটিস। মুখ কতটা খুলতে হবে, জিভ কতটা নাড়াতে হবে, বা ফুসফুসের বায়ু কতটা গলায় নিয়ে যেতে হবে, এগুলির অভ্যাসই গায়কের গানকে সুন্দর করে তোলে।
গান হল এক ধরনের ব্যায়াম
রোজ গান গাওয়া হল খুবই ভাল এক ধরনের ব্যায়াম। ধরা যাক কোনও ৬৮ কেজি ওজনের ব্যক্তি যদি রোজ ১ ঘণ্টা গান করেন তবে তিনি ১৪০ ক্যালোরি বার্ন করছেন। তাছাড়া এর সঙ্গে যাঁরা অন্যান্য ব্যায়াম করেন তাঁরা আরও উপকার পান। যদি কেউ অ্যারোবিক করেন তাহলে তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্ষমতা আরও বেড়ে যায়, যা মাংসপেশীর পক্ষে ভাল। এছাড়া গানের সময়ও শরীরের বেশকিছু মাংসপেশী কাজ করে। তাই গানের ফলে শরীরে উপকার হয়।
মস্তিষ্কে গানের প্রভাব কী?
যখন আমরা কথা বলি তখন আমাদের মস্তিষ্কের বামদিকটি সক্রিয় হয়। কারণ এই অংশটিই বাক্য গঠনে সাহায্য করে। কিন্তু যখন আমরা গান গাই বা শুনি তখন ডানদিকটি সক্রিয় হয়। এই অংশটি লয় ও সুরের জন্য পরিচিত।
সঙ্গীত আমাদের মস্তিষ্কের জ্ঞানীয় এবং যৌক্তিক শক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে, শান্তি দেয়। তাছাড়া নিয়মিত সঙ্গীত চর্চায় কথা আটকে যাওয়ার সমস্যাও কমে যায়।