অনীক দত্ত পরিচালিত 'অপরাজিত' (Aparajito) ছবির ব্যাপারে এখনও অবগত নয়, এরকম খুব কম বাঙালিই রয়েছে। সত্যজিৎ রায় রূপে জিতু কমলের (Jeetu Kamal) লুক সামনে আসতেই শিরোনামে আসে এই ছবি। সাদা- কালো ফ্রেমে 'মানিক দা'..., যেন ফিরে যাওয়া কয়েক যুগ আগে। কিংবদন্তী শিল্পীর 'পথের পাঁচালী' (Pather Panchali) তৈরির কিছুটা নেপথ্য কাহিনি ফুটে উঠবে এই ছবিতে। বীরভূম, কলকাতার শিশির মঞ্চ,নন্দন থেকে শুরু করে আরও বেশ কিছু লোকেশনে শ্যুট করা হয় ছবির।
এবার সামনে এল 'অপরাজিত' ছবির লোগো। সত্যজিৎ রায়ের (Satyajit Ray) ধারা বজায় রেখে, এই ভাবনা খসড়া করেছেন পরিচালক নিজেই। আর সেই লোগোর বিবর্তনের ইতিকথা, লিখলেন অনীক দত্ত (Anik Dutta)।
'কুছ তো লোগ কহেঙ্গে, লোগো কা কাম হ্যায় কেহনা...' একটা জনপ্রিয় হিন্দি গানের দুটি লাইন। এখান থেকে কথার খেলার ছলে যদি লোগো শব্দটিকে ইংরেজি 'Log'o শব্দে রূপান্তরিত করে নিই। তাহলেও 'Logo কা কাম হ্যায় কেহনা' বাক্যবন্ধটির একটা স্বাধীন অথচ গুরুত্বপূর্ণ মানে তৈরি হয়। ঠিকই তো! লোগো-র কাজই তো হল কিছু না কিছু বলা। তা সে কোনও পণ্য হোক বা কোম্পানি...আমাদের ক্ষেত্রে একটা ছবি। অর্থাৎ লোগো প্রাথমিকভাবে একটা প্রতিনিধি এবং তার প্রধান কাজ হল, সে যার প্রতিনিধিত্ব করছে, তার সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি করে দেওয়া।
আমার প্রথম ছবি থেকেই ছবি তৈরির সঙ্গে সঙ্গে এই লোগো বা প্রচার নকশার প্রতি আমার আগ্রহ ও উৎসাহ বজায় থেকেছে। এই কাজটা করে আমি সৃজনশীলতার দিক থেকেও খুব আনন্দ পেয়েছি। আমি যন্ত্র ব্যবহারে খুব পারদর্শী নই বলে, প্রাথমিক ভাবে আমার চিন্তা ভাবনাটাকে পেনসিলে খসড়া করে নিয়ে তারপর গ্রাফিক ডিজাইনারদের সাহায্য নিই কাজটাকে শেষ করার জন্যে। 'অপরাজিত' ছবিটির ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি। তবে এই ছবিতে সৃষ্টির আনন্দ ও উদ্দীপনা দ্বিগুণ হয়ে যায়, কারণ অনেকেই হয়তো জেনে গেছেন যে, আমার 'অপরাজিত' ছবিটি সত্যজিৎ রায়ের জীবনের প্রথম ছবি 'পথের পাঁচালী' তৈরির নেপথ্য কাহিনীর আধারে তৈরি।
সত্যজিৎ বাবু সেই ছবি তৈরির সময় তাঁর অনমনীয় জেদকে সম্বল করে, যে অজস্র প্রতিকূলতা অতিক্রম করে অপরাজিত থেকে তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছেছিলেন, তা এ ছবির মূল প্রতিপাদ্য এবং 'অপরাজিত' নামটি তারই সূচক। আমার বলা বাহুল্য যে, 'পথের পাঁচালী' শুধু বাংলা বা ভারতীয় সিনেমা নয়, বিশ্ব চলচ্চিত্রের এক নতুন দিশারি হয়ে উঠেছিল। আমাদের ছবিতে বাস্তব চরিত্রদের নাম ও ঘটনার বিবরণ আমরা খানিক পালটে নিয়েছি। তাই এখানে মূল চরিত্রের নাম অপরাজিত রায় আর তিনি যে ছবিটি করছেন তার নাম পথের পদাবলী।
সত্যজিৎ রায়ের বহুমুখী প্রতিভার বিচ্ছুরণ অগণিত ক্ষেত্রে দেখা গেছে যার মধ্যে লোগো, পোস্টার বা প্রচার নকশা, ক্যালিগ্রাফি, ইলাস্ট্রেশন অন্যতম। সত্যজিৎ বাবু নিজে তাঁর ডিজাইনিং করতেন (সে বই হোক বা সিনেমা) মূল বিষয়ের সঙ্গে সাজুয্য রেখে, যাতে লোগোটি দেখলেই মূল ভাবনাটার সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা তৈরি হয়। আমরা সত্যজিৎ রায়ের এই ধারাটা বজায় রেখেই একটা নিজেদের মত কিছু করতে চাইছিলাম, যা একার্থে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ কিন্তু অন্ধ অনুকরণ নয়।
অনেক খুঁজে কাপুরুষ-মহাপুরুষ ছবির টাইটেল কার্ড থেকে আমি একটা আদল খুঁজে পেলাম যা আমার ছবির লোগো তৈরির জন্য খুব প্রাসঙ্গিক মনে হল। 'অপরাজিত' নামটা লেখা তো হল; এবার মূল প্রশ্ন এটা এরকম সরলীকৃতই থাকবে নাকি উনি যেমন করে বিভিন্ন উপাদান ব্যবহার করতেন, সেই পথেই আমরা এগোনোর চেষ্টা করব। বছর খানেক আগে এই ছবিটির ঘোষণার সময়ে আমি অত্যন্ত তাড়াহুড়ো করে যেটুকু করতে পেরেছিলাম তাতে, 'জ' এ 'ই' এর যে অর্ধচন্দ্রাকার টান রয়েছে সেখানে ট্রেনের ধোঁয়া ব্যবহার করেছিলাম। কারণ 'পথের পাঁচালী' ছবির স্মরণীয়তম অংশগুলোর অন্যতম হল অপু-দুর্গার ট্রেন দেখতে যাওয়া। এবারে নতুন করে লোগোটা নিয়ে ভাবতে গিয়ে মনে হল, আরও কিছু উপকরণও ব্যবহার করা যায়। আর তা যেন মূল লোগোর সঙ্গে আরেকটু সম্পৃক্ত হয়ে ওঠে।
ধোঁয়া ওড়ানো ট্রেন, ভাই-বোনের কাশবন দিয়ে ছোটা... এছাড়াও আমাদের ছবির একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল একটা ছবির শ্যুটিং অর্থাৎ উপাদান প্রচুর। কিন্তু আমি চাইছিলাম তার ব্যবহার হবে খুব সূক্ষ্ণ ভাবে যাতে প্রক্ষিপ্ত না মনে হয়। এই সময়ের শিল্পী সমীর আইচের ছেলে রাজের সঙ্গে কথা হল, সে নিজেও একজন গ্রাফিক শিল্পী। রাজের সঙ্গে আলোচনা করে আমরা ট্রেনের ধোঁয়াকে 'ই' তো রাখলাম, সঙ্গে ট্রেনের কামরাগুলো হল মাত্রা। ভাই-বোন চলে এল 'অ'-এর অলঙ্করণের অংশ হয়ে। আর শেষকালে মিচেল ক্যামেরা যা দিয়ে 'পথের পাঁচালী' শ্যুট হয়েছিল, সেই ক্যামেরার আভাস এল 'প' এর ফাঁকা জায়গায়। তবে পুরোটাই খুব সম্পৃক্ত ভাবে একেবারেই জোর করে চাপিয়ে দেওয়া বা আলাদা করে নিম্নরেখ করা নয়।
এর সঙ্গে আমাদের ইংরেজি টাইটেল হল 'দ্য আনডিফিটেড'( The Undefeated)। আসল অপরাজিত-র ইংরেজি নাম ছিল 'দ্য আনভ্যানক্যুইসজ' (The Unvanquished)। এই ইংরেজি নামের ক্ষেত্রে আমরা ব্যবহার করলাম 'Ray Roman Font'। যেটাও সত্যজিৎ রায়েরই তৈরি করা এবং এ প্রসঙ্গে, একথা না বলা অপরাধ হবে যে, এ সব কিছুই সম্ভব হয়েছে শ্রী সন্দীপ রায়ের অপরিসীম সহযোগিতা, অনুমতি ও অকৃত্তিম উৎসাহের জন্য। এই হল আমাদের লোগোর বিবর্তনের ইতিকথা।
প্রসঙ্গত, এই ছবিতে সত্যজিৎ জায়া, বিজয়া রায়ের ছায়ায় তৈরি বিমলা রায়ের চরিত্রে দেখা যবে অভিনেত্রী তথা তৃণমূল- কংগ্রেসের সভানেত্রী সায়নী ঘোষকে। ছবিতে দারুণ মেকআপ করেছেন এবিষয় দক্ষ, সোমনাথ কুণ্ডু। ফিরদৌসুল হাসান ও প্রবাল হালদারের নিবেদনে, ফ্রেন্ডস কমিউনিকেশনের ব্যানারে আসছে 'অপরাজিত'। বলাই বাহুল্য দর্শকেরা অপেক্ষায় রয়েছেন বাংলা তথা ভারতীয় চলচ্চিত্রের এই অনবদ্য সৃষ্টির।