সেই জানুয়ারি থেকেই। প্রায় পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও দেশের মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ মানুষকেও টিকা দেওয়া যায়নি। এমনই তথ্য উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার (International Monetary Fund বা IMF)-এর রিপোর্টে।
ওই রিপোর্ট অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গের ১০ কোটি জনসংখ্যার মাত্র ৯.৭১ শতাংশকেই এখনও পর্যন্ত প্রতিষেধকের সুরক্ষার আওতায় আনা গিয়েছে। মোট টিকাকরণের হিসাবে উত্তরপ্রদেশের আরও বেহাল দশা! ওই রাজ্যের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৫.৭৪ শতাংশকেই এখনও পর্যন্ত করোনার টিকা দেওয়া গিয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের মতো একাধিক রাজ্যের অভিযোগ, পর্যাপ্ত টিকা মিলছে না। জবাবে কেন্দ্র জানিয়েছে, দেশজুড়ে টিকার জোগানে কোনও ঘাটতি নেই। কেন্দ্র পাল্টা রাজ্যগুলিকে টিকাকরণে পরিকাঠামোগত উন্নয়নে জোর দিতে বললেও অধিকাংশ রাজ্যই নিজেদের ব্যবস্থাপনাকে ‘ফুল মার্কস’ দিচ্ছেন।
এ বিষয়ে উত্তর ২৪ পরগনার মধ্যমগ্রামের বাসিন্দা, তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী প্রসেনজিৎ দেবরায় অভিযোগের সুরে বলেন, “একদিকে নিয়ম করে বাজার, দোকান, ট্রেন ও অন্যান্য পরিবহণ বন্ধ করে করোনার সংক্রমণ রোখার চেষ্টা হচ্ছে, অন্যদিকে টিকাকেন্দ্রের বাইরে সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা টিকার কুপন সংগ্রহের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। ব্যপারটা হাস্যকর নয় কি?” প্রশ্ন তোলেন তিনি।
ইতিমধ্যেই রাজ্যের কিছু এলাকায় টিকাকরণের কুপন নেওয়ার লাইনে দালাল চক্রের সক্রিয় হয়ে ওঠার অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। টাকার বিনিময়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা টিকাকরণের কুপন সংগ্রহের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকছে এই দালালরা। তারপর কুপন দেওয়ার ঠিক আগেই ‘মক্কেল’কে জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে তারা।
এই কুপন ব্যবস্থা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডাঃ অরিন্দম পাণ্ডে বলেন, “লকডাউন মেনে সারাদিনে ঘরবন্দি হয়ে কাটালেও যদি আপনাকে টিকার কুপন নিতে কেন্দ্রের বাইরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, তাহলে সে ক্ষেত্রে সংক্রমণের ঝুঁকি নেহাত কম নয়। রাজ্যজুড়ে করোনার টিকাকরণ যখন সম্পূর্ণ সরকারি উদ্যোগে হচ্ছে, তখন সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে প্রশাসনই পারে এই কুপনগুলিকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে। ঠিক যেমন ভাবে ভোটের স্লিপ পৌঁছে দেওয়া হয়।”
লাইন দিয়ে টিকাকেন্দ্র থেকে কুপন সংগ্রহের ব্যবস্থা প্রসঙ্গে ওয়েস্ট বেঙ্গল একাডেমি অফ পেডিয়াট্রিক্স-এর প্রেসিডেন্ট ডাঃ সুব্রত চক্রবর্তী বলেন, “টিকার কুপন সংগ্রহ করতে গিয়ে সুস্থ মানুষও ভাইরাসে সংক্রমিত হতে পারেন। মনে রাখতে হবে, যাঁরা টিকাকেন্দ্রের বাইরে লাইন দিচ্ছেন, তাঁরা টিকা পাননি বলেই লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। অর্থাৎ, যাঁদের করোনায় সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বেশি, তাঁদেরই ভিড়ের মধ্যে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। সুরক্ষার খাতিরে বাড়ি বসে টিকার রেজিস্ট্রেশন বা বাড়িতে কুপন পৌঁছে দেওয়ার কথা ভাবতে হবে প্রশাসনকে। ভোটার স্লিপ বাড়ি বাড়ি দেওয়া গেলে, টিকার কুপন দেওয়া যাবে না কেন!”
করোনা টিকার কুপন সংগ্রহের ব্যবস্থা প্রসঙ্গে এসএসকেএম হাসপাতালের জেনারেল সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডাঃ সুনন্দ দে বলেন, “এই ব্যবস্থাটাই অবৈজ্ঞানিক, অপরিকল্পিত। এই ব্যবস্থায় কুপন সংগ্রহ করতে গিয়ে মানুষের সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে যে সরকার দুয়ারে রেশন পৌঁছে দিতে পারে, সঠিক পরিকল্পনায় সেই প্রশাসন টিকার কুপনও বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিতে পারবে হয়তো! সংক্রমণ ঠেকাতে এই উদ্যোগ অত্যন্ত জরুরি।”
ব্যাঙ্ককর্মীদের টিকার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার মিললেও তাঁদের পরিবারের বাকি সদস্যদের লাইনে দাঁড়িয়েই কুপন সংগ্রহ করতে হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া অফিসার্স এসোসিয়েশনের (SBIOA) সাধারণ সম্পাদক তথা অল ইন্ডিয়া ব্যাংক অফিসার্স’ কনফেডারেশনের (AIBOC) পশ্চিমবঙ্গ শাখার সভাপতি শুভজ্যোতি চট্টপাধ্যায় ব্যাঙ্কের শাখার মাধ্যমে টিকার কুপন বিলি করার পরামর্শ দেন। তাঁর মতে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে কুপন পৌঁছানোর মতো পরিকাঠামো, লোকবল এই মুহূর্তে হয়তো কোনও রাজ্যেরই নেই।
সর্বপরি, করোনার চোখ রাঙানি উপেক্ষা করেও ভোটের স্বার্থে যদি বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটের স্লিপ পৌঁছে দেওয়া যায়, তাহলে রাজ্যবাসিকে সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচাতে টিকার কুপন ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া যাবে না কেন? প্রশাসনের কাছে এলাকা ভিত্তিক নামের তালিকাও রয়েছে। তাহলে টিকার কুপন দুয়ারে পৌঁছেবে না কেন? প্রশ্ন রাজ্যের চিকিৎসক থেকে সাধারণ মানুষের।