নরম তুলতুলে নয়। কড়া। উপরটা যতটা শক্ত, ভেতরটা ততটা নয়। চামচ দিয়ে কেটে অনেকটা কবিরাজির মতো ভেঙে দুখান করে ফেলতে হবে। তাহলেই ভিতর থেকে বেরিয়ে আসবে রসালো মাংসল অংশ। কথা হচ্ছে বেলাকোবার চমচম নিয়ে।
সম্প্রতি জিআই ট্যাগ পেয়েছে সরভাজা। আগেই ট্যাগ পেয়েছিল রসগোল্লা। দীর্ঘদিন ধরে চমচম তৈরি করেও এখনও জিআই ট্যাগ মেলেনি তাঁদের। তাই এখন তাঁরা সরভাজার রাস্তা ধরেই আশাবাদী, ট্যাগ মিলবে তাঁদেরও।
উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গ কিংবা দেশের যে কোনও স্থানে বেলাকোবার চমচম পাওয়া যায়। সবই যায় এখান থেকেই। এই চমচমের রেসিপি এখনও পর্যন্ত বাইরে কোথাও কেউ জানে না। ফলে জিআই তকমা পাওয়ার ষোলআনা দাবিদার তাঁরাই।
আর হবে নাই বা কেন। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায় থেকে জ্যোতি বসু, বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে অভিনেতা সাংসদ তাপস পাল, সাংসদ অভিনেতা দেব সহ বহু বিখ্যাত ব্যক্তি, এই এলাকায় এলে বেলাকোবার চমচম খাওয়া চাই। ফলে দাবির স্বপক্ষে যুক্তিও রয়েছে।
বেলাকোবার চমচম বাঙালিদের মধ্যে এক অত্যন্ত পছন্দের এবং ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি। বিশেষ করে যাঁরা কড়া মিষ্টি পছন্দ করেন, তাঁদের কাছে এর কদর আলাদা। জলপাইগুড়ি জেলার বেলাকোবা নামক ছোট্ট জনপদের পরিচয় শুধু এই চমচম দিয়েই। ছানা, দুধ, ময়দা এবং চিনির মিশ্রণে তৈরি হয় এই চমচম।
বেলাকোবার চমচমের একটা ইতিহাস আছে। সেই ইতিহাস স্বাধীনতা পূর্বের ইতিহাস। উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে অবিভক্ত ভারতের ময়মনসিংহ জেলার টাঙ্গাইল মহাকুমার ধলেশ্বরী নদীর পারে পোড়াবাড়ি এলাকায় চমচমের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। স্বাধীনতার আগে এই মিষ্টি পোড়াবাড়ির চমচম নামে খ্যাত হয় সারা বাংলায়।
৪৭ সালে দেশ ভাগ হয়ে গেলে পোড়াবাড়ির বেশ কিছু মিষ্টির কারিগর ভারতে বসবাসের জন্য চলে আসেন। তার মধ্যে জলপাইগুড়ি জেলার এই জঙ্গলাকীর্ণ বেলাকোবায় এসে ঠাঁই নেন, ধীরেন সরকার ও কালিদাস দত্ত। এই দুই মিষ্টান্ন শিল্পীর হাত ধরে বেলাকোবা চমচমের পথচলা শুরু হয়। টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম এর রহস্য ময় রেসিপি এই দুই টাঙ্গাইলবাসীর হাত ধরে বেলাকোবা পাড়ি দেয় এবং পুরনো খোলনলচে কিছুটা বদলে বেলাকোবার চমচম নামে ক্রমশ বিখ্যাত হতে শুরু করে।
মূল রেসিপি থেকে সামান্য পরিবর্তন আনা হয়েছিল এই চমচমে। আগে এক থাকলেও বর্তমানে রেল লাইনের ধারে দুই প্রবাদপ্রতিম চমচমচম শিল্পীর দুটি আলাদা চমচমের দোকান রয়েছে এই দুটি দোকান ছাড়াও বেলাকোবায় আরও বেশকিছু চমচমের দোকান থাকলেও। মূল দোকান এই দুটিই।পোড়াবাড়ির চমচম এর ঘরানার সাথে বেলাকোবার চমচমের ঘরাণার কতগুলি মৌলিক পার্থক্য আছে। কড়াপাকের সঙ্গে ক্ষীরের মিশ্রণ বেলাকোবার চমচমে বেশি। গোলাপি চমচমে বরফের কুচির মতো ছড়িয়ে দেওয়া হয় ক্ষীর।
দেশ-বিদেশে জনপ্রিয় এই চমচম এতটাই জনপ্রিয়, যে অনেকেই বিভিন্ন চমচম তৈরি করে তা বেলাকোবার চমচম বলে বিক্রি করে দেওয়ার চেষ্টা করেন। তবে স্বাদে এবং ঘরানায় তারা কোনওটাই বেলাকোবা চমচমের ধারে কাছে নন।
এই চমচমকের প্রবল জনপ্রিয়তা রয়েছে। বিশেষ করে যারা দেবী চৌধুরানীর মন্দির কিংবা ভ্রামরী দেবীর মন্দির দর্শন করতে আসেন, পর্যটকরা বেলাকোবা চমচমের খোঁজ করেন। ভারতের বাইরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুক্তরাজ্য এবং সিঙ্গাপুরের সহ বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয় বেলাকোবার চমচম।
২০১৭ সালের রসগোল্লা জিআই স্বীকৃতি পাওয়ার পর, বেলাকোবার চমচমের সঙ্গে জড়িত মিষ্টান্ন ব্যবসায়ীর কারিগররা বেলাকোবার চমচমের জিআই স্বীকৃতি ব্যাপারে আশাবাদী হন। তারপর পশ্চিমবঙ্গ খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ দপ্তর ও জলপাইগুড়ি জেলা শিল্পকেন্দ্রকে চিঠি দিয়ে জিআই স্বীকৃতি ব্যাপারে উদ্যোগী হতে দাবি জানানো হয়।
জিআই-এর দাবিতে নাগরিক কনভেনশনে ডাকা হয়েছিল। জিআই স্বীকৃতির দাবি তোলার ব্যাপারে ঐক্যমত্যের জন্য সাড়া পড়ে যায়। তারপর বিভিন্ন কারণে তা পিছিয়ে যায়। সরভাজা জিআই তকমা পাওয়ার পর ফের নতুন করে আশাবাদী ব্যবসায়ীরা।