টানা বৃষ্টি ও দুর্যোগে বিপর্যস্ত সিকিম। উত্তর সিকিমে প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে এখনও। পর্যটনেরর মরশুমে হঠাৎ বৃষ্টিতে সমস্যায় শৈলরাজ্য। কোথাও রাস্তার উপর দিয়ে নদীর স্রোতের মতো জল বইছে, কোথাও আবার বড় পাথরের চাঁই পড়ে রাস্তা আটকে রয়েছে। কোথাও আবার জলের তোড়ে রাস্তার উপর পলি জমে যাতায়াতের অযোগ্য হয়ে রয়েছে। সিকিমের মধ্য দিয়ে যাওয়া তিনটি জাতীয় সড়কে এখন প্রায় দুর্গম হয়ে গিয়েছে।
পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে পর্যটকদের উত্তর সিকিম থেকে নামিয়ে আনা হয়েছে। পূর্ব সিকিমের পরিস্থিতির উপরও নজর রাখা হচ্ছে। সিকিমের অন্যান্য জায়গায় পর্যটন খোলা থাকলেও মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ও ভয় জাঁকিয়ে বসেছে। ফলে অনেকেই সিকিমের বুকিং বাতিল করে, দার্জিলিং, কালিম্পং কিংবা ডুয়ার্সের দিকে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে। ফলে বিপাকে পড়েছে এই এলাকার বিস্তীর্ণ পর্যটন।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত পাহাড়ি এই এলাকাগুলিতে পর্যটন ভাল হয়। তারপর থেকেই ঠান্ডায় মার্চ পর্যন্ত তেমন পর্যটক থাকে না। ফের মার্চের পর থেকে পর্যটক আসা শুরু করে। ফলে পুজোর এই উৎসবের মরশুমে এই এলাকায় একের পর এক বুকিং বাতিলের মুষড়ে পড়েছে বিভিন্ন পর্যটন সংস্থাগুলি ও স্থানীয় পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত লক্ষাধিক মানুষ। পরিস্থিতির সমাধান চেয়ে কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহণমন্ত্রী নীতিন গডকরির কাছেও চিঠি পাঠানো হয়েছে।
উত্তরবঙ্গ-সিকিম রিজিয়নের পর্যটন সংগঠন হিমালয়ান হসপিটালিটি অ্যান্ড ট্রাভেল ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্কের তরফে দাবি শুধু এই মরশুমের টানা বৃষ্টি নয়, এই এলাকায় বৃষ্টিপাত হলেই সারা বছর ধস নামতে থাকে। ফলে এর স্থায়ী সমাধান প্রয়োজন বলে দাবি করেছেন তাঁরা। হিমালয়ান হসপিটালিটি অ্যান্ড ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্কের সাধারণ সম্পাদক সম্রাট সান্যাল জানিয়েছেন এই রাজ্য দিয়ে ১০ নম্বর জাতীয় সড়ক যেটি শিলিগুড়ি থেকে সরাসরি সিকিম যায়, সেটি ছাড়াও ৩১০ এবং ৩১০ এর এ জাতীয় সড়ক গিয়েছে। এই সড়ক পথগুলির গুরুত্ব অপরিসীম।
পাশাপাশি সড়কপথে নাথুলা সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছানোর এটি একমাত্র রাস্তা। ফলে জাতীয় নিরাপত্তা ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে এটির গুরুত্ব অপরিসীম। সম্রাটবাবুর দাবি, বর্ষার সময় প্রবল বৃষ্টি হয় গোটা দেশের অন্যান্য পাহাড়ি রাজ্যেও। কিন্তু জাতীয় সড়কের এমন বেহাল দশা কোথাও দেখা যায় না। কিন্তু এখানে বৃষ্টি হলেই সারা বছর এই পরিস্থিতি তৈরি হয়। তাই স্থায়ীভাবেই রাস্তাটি এমনভাবে তৈরি করার দাবি জানানো হয়েছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর কাছে। যাতে সমস্যা তৈরি না হয়।
প্রতি বছরই বছরে অন্তত চার পাঁচ বার এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় বলে দাবি স্থানীয় বাসিন্দা ও পর্যটন সার্কিটের। অথচ প্রতিবারই ধস সরিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করে যান চলাচল শুরু হলেই আবার সবাই বিষয়টি নিয়ে চোখ উল্টে দেন বলে অভিযোগ। অভিযোগ, কোথাও ধস থামলে সেখানে ধস সরিয়ে রাস্তা মেরামতি করে যান চলাচল শুরু করতেই নতুন করে অন্য জায়গায় ধস নামে। এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে যতদিন বৃষ্টি চলে ততদিনই। বৃষ্টি থামার পরেও বেশ কিছুদিন আতঙ্কে চলাফেরা করতে হয় মানুষকে।
সিকিমের রংপোতে বাংলা সিকিম সীমান্ত, সেখান থেকে শুরু করে গ্যাংটক পর্যন্ত প্রায় ৪৫ কিলোমিটার রাস্তার বেশিরভাগ জায়গা খুবই খারাপ। যে কোনও দিন বড় দুর্ঘটনায় ঘটতে পারে। দুদিন আগেই মালদহের এক ছাত্র বাইক নিয়ে খাদে পড়ে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে। এছাড়াও সারা বছরই দুর্ঘটনা ঘটে। ৩১০ নম্বর জাতীয় সড়কের একটা অংশ জলের তোড়ে ভেঙে গিয়েছে। পরিস্থিতি এমন কার্যত বিচ্ছিন্ন উত্তর সিকিম। বুধবারও সেখানে পর্যটকদের যাওয়ার জন্য পারমিট দেওয়া শুরু হয়নি।
আপাতত আবহাওয়া দফতর বলছে, বৃহস্পতিবার থেকে সমতলে পরিস্থিতি উন্নতি হবে। বৃষ্টি ধীরে ধীরে কমবে। এখন সেদিকেই নজর রেখে আশায় দিন গুণছেন সিকিমবাসী ও এলাকার পর্যটনের উপর নির্ভরশীল বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ। তবে সিকিমের জন্য এখনও পর্যন্ত তেমন কোনও আশার খবর শোনাতে পারেনি আবহাওয়া দফতর। সমতলে বৃষ্টি কমার ইঙ্গিত মিললেও সিকিমের মঙ্গন, লাচেন, লাচুং, গ্যাংটক সহ বিভিন্ন এলাকায় আরও বৃষ্টি হওয়ার সতর্কতা রয়েছে। সামনেই দীপাবলি। তার আগে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে কি না, তা নিয়ে উদ্বেগে গোটা সিকিম। যদিও এখনও কোনও সদুত্তর মিলছে না।
আবহাওয়া দফতরের তরফে কোনও স্পষ্ট বার্তা না পেয়ে বহু পর্যটক পাহাড় ছেড়ে সমতলে নেমে এসেছেন এবং আপাতত ভয়ে দার্জিলিং বা কালিম্পংয়েও না যাওয়ার জন্য মনস্থির করেছেন। তাঁরা এখন ডুয়ার্সের দিকে বুকিং করছেন। এমনই কয়েকটি পরিবার, যাঁরা কলকাতা, ভুবনেশ্বর এবং মেদিনীপুর থেকে এসেছিলেন, তাঁরা সবাই এখন গরুমারা, জলদাপাড়ায় বুকিং খুঁজছেন বলে জানানো হয়েছে কয়েকটি ট্যুর অপারেটর সংস্থার তরফে।