স্কুল খুলুক আর না খুলুক আজ পড়া হবে। সরকারি নির্দেশে কবে স্কুল খুলবে দেবা না জানন্তি। তাহলে কী হবে? শিশুদের পড়াশোনা সব শিকেয়। সচেতন শহুরে নাগরিকরা তবু যা হোক অনলাইন ক্লাস মেনে নিয়েছে বাধ্য হয়ে। কিন্তু যাদের স্কুলই ভরসা তাদের কী হবে ?
কিছু তো একটা হবেই। আর যখন ইউনিক ফাউন্ডেশনের একঝাঁক তরুণ-তরুণী রয়েছেন, তাঁরা যখন চিন্তাভাবনা করছেন, তাহলে কিছু তো হতেই হবে। স্কুলে কি হচ্ছে তা জানানোর আগে একবার ইউনিক ফাউন্ডেশনের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে একটু জেনে নেওয়া যাক।
সম্পূর্ণ চেয়েচিন্তে চলা একটি সংগঠন। স্বেচ্ছাসেবী বললে ঠিকমতো বর্ণনা করা হয় না। বরং অনেকটা ঠিক গেছোদাদার মতো। এই আছে আর এই নেই। ইউনিকের কোনও সদস্যের কারেন্ট লোকেশন খানিকটা এরকমই।
তবে বিপদে পড়ে তাদের হেল্পলাইন কিংবা কোনও সদস্যের ফোনে ফোন করে দেখুন, মুহূর্তের মধ্যে হাজির হবেন কয়েকজন মূর্তিমান। অক্সিজেন সিলিন্ডার প্রয়োজন কিংবা কন্টেনমেন্টে খাবার। কিংবা বাড়িতে লোক নেই, বাজার করে দেওয়া, ইউনিকের সদস্যরা হাজির। আবার অসুস্থ হলে অ্যাম্বুল্য়ান্সে চড়িয়ে হাসপাতালে নিয়ে যাওয় থেকে ফের সুস্থ করে বাড়ি ফেরানো পর্যন্ত তাঁরা সঙ্গে থাকবেন।
বাড়ি ফিরে ওদের মনে না রাখলেও ক্ষতি নেই। কারণ ওদের থামবার সময় নেই। ওরা তখন কাঁধে চাপিয়ে নিয়েছে অন্য় কোনও দায়িত্ব। কখনও বিনি পয়সা বাজার বসিয়ে কিংবা কিংবা কখনও দুঃস্থ খেলোয়াড়দের হাতে রেশন তুলে দিয়ে ওরা কর্তব্য করে চলেছে। কিসের কর্তব্য ? ওঁদের নিজেদের কাছে নিজেদের শপথ পালনের কর্তব্য আর কিছু নয়।
যে স্কুলের কথা বলছি। তাকে স্কুল বলাও যায় আবার স্কুল নয় বলাও যায়। অনেকটা পাঠশালা, অনেকটা টোল গোত্রের আবার কোনওটাই নয়। খানিকটা প্রাইভেট টিউশনের মতো আবার খানিকটা নয়। এক কথায় একে প্রকাশ করাটাই ঝক্কির।
যাঁদের উদ্যোগ তাঁদের দেওয়া নাম 'বিদ্য়াছায়া'। ছায়াই বটে। উদ্দেশ্য স্কুলের অভ্য়েস নষ্ট হয়ে যাওয়া একদল কচিকাঁচার মনে স্কুলের পরিবেশ বজায় রাখা। যেমন স্কুলের হোমওয়ার্ক করার মতো করে আলাদা পাঠ রয়েছে, তেমনই রয়েছে হাতে কলমে কিছু শিখিয়ে দেওয়া।
তাতে যেমন রয়েছে অ-এ অজগর আসছে তেড়ে, তেমনই রয়েছে সুদকষা কিংবা আকবরের শাসন থেকে ব্যাঙের পৌষ্টিকতন্ত্র। একেবারে গুটি থেকে পোক্ত সব ধরণের ছাত্রছাত্রীই রয়েছে।
শুধু পড়া হলেও না হয় মানা যেত, এরা আবার স্কুলের মতোই শরীরচর্চাকেও অগ্রাধিকার দিচ্ছে। ফলে চলছে সে চর্চাও। ঘন্টা দুই ক্লাসে ক্লান্তি আসে যদি, তাহলে ক্ষমা নয়, তাঁরা এগিয়ে দিচ্ছেন পুষ্টির ডালি। দুধ, পাঁউরুটি থেকে মরশুমি ফল। ফলে সুষম বিকাশের দিকে নজর। বিনিময়ে একটি পয়সাও খরচ করতে হচ্ছে না ছাত্রছাত্রীদের।
শিলিগুড়ি লাগোয়া শহরতলির পোড়াঝাড়ে এমন দুটি পাঠশালা কিংবা না-পাঠশালা (অনেকটা না-কবিতার মতো) চলছে দিব্য়ি রমরমিয়ে। আরও দুটি খোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। একটি ফাঁপড়ি বা আমবাড়ির দিকে অন্য়টি হাতিঘিষা কিংবা খড়িবাড়ির দিকে। শিলিগুড়ির দুই পেশাগত শিক্ষক বিশ্বজিৎ রায় ও দূর্বা মৈত্র স্কুল যেতে না হওয়ার অবসর এভাবেই কাটাচ্ছেন প্রান্তিক শিশুদের সঙ্গে।
সংগঠনের তরফে অর্পিতা সিংহরায় জানালেন, পড়া তো বটেই, পড়ার বাইরের পড়া, স্কুলের বাইরের স্কুলকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে এই উদ্যোগে। শিশুদের মন তো মজেছেই, অভিভাবকরাও খুশি এই উদ্য়োগে। বিশেষ করে স্বাস্থ্য বিধি মেনে একটু পড়াশোনা করলে নিজেরাও একটু হালকা হতে পারছেন অভিভাবকরা। তবে চিন্তা প্রথাগত স্কুল খুলে গেলে বাচ্চাদের নিয়ে আসা যাবে কি না।
তবে আপাতত কোনও বাধাই বাধা মনে হচ্ছে না। তবে এই যে শিক্ষক-শিক্ষিকারা পড়াতে আসছেন, তাতে কি লাভ ! শিলিগুড়ি তো বটেই রাজ্য জুড়েই বেতন নিয়ে বাড়িতে বসে থাকছেন বলে কম ট্রল হতে হচ্ছে না শিক্ষকমহলকে। এই ছবিগুলি দেখার পর কিছুটা হলেও সেই সব সমালোচকদের আত্মসমালোচনা করা উচিৎ।
ফাউন্ডেশনের তরফ থেকে শক্তি পাল জানালেন, আমাদের সঙ্গে অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকা আরও যোগাযেগ করেছেন। তাঁরা বাড়িতে বসে আছেন, পড়াতে সুযোগ দেওয়ার অনুরোধ করে। কোনও পয়সা পাবেন না জেনেও এগিয়ে আসছেন তাঁরা। এটাই আমাদের সাফল্য। তবে এটা সবে শুরু। আরও এগিয়ে চলতে হলে লাগাতার এই উদ্যম বজায় রাখতে হবে।
কাজ সহজ নয় জানেন। তবে কঠিন কাজগুলিই তো তাঁরা বেছে নিয়েছেন। ফলে এসব তাঁদের কাছে এখন আর চ্য়ালেঞ্জ নয়, তাঁদের কাছে এ কাজ বরং অনেক সহজ। বিদ্য়াছায়া দেখে আরও কয়েক জায়গায় পড়াতে এগিয়ে এসেছেন কেউ কেউ। হোক না অন্য সংগঠন। অন্য ব্য়ানার। অনুপ্রাণিত করতে পারাটাও তো সহজ নয়।
তাই তাঁরা এখন শহরের বাইরের নতুন জায়গায় অনুমতি নিতে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের কাছে ঘুরছেন। উদ্দেশ্য একটাই হঠাৎ স্কুল খুললে এই সব শিশুরা যেন আকাশ থেকে না পড়ে।
কারণ এরা প্রত্যেকেই খুব ছোট। কেউ স্কুলে পা রাখবে, কেউ রেখেছে কিন্তু স্কুলে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। কারও হয়েছে কিন্তু তা দেড় বছরে এখন আবছা স্মৃতিতে পরিণত হয়েছে। তাই তাদের মূলস্রোতে ধরে রাখাটাই চ্যালেঞ্জ, আর কিছু নয়।