কথায় আছে, প্রকৃতির লীলা বড়ই অদ্ভূত। আর প্রকৃতিকে ঘাঁটালে তিনিও রুদ্ররূপ ধারণ করেন। ঠিক তেমনটাই হয়েছে পাহাড়ে। পশ্চিমবঙ্গের পাহাড়ে বর্তমানে দুর্যোগের কবলে। ধস, হড়পা বান, নাগাড়ে চলা বৃষ্টিতে তছনছ হয়ে গিয়েছে দার্জিলিং, কালিম্পং জেলার বিস্তীর্ণ অংশ। ভেসে গিয়েছে অসংখ্য বাড়িঘর, ভেঙে গিয়েছে রাস্তাঘাট। অসংখ্য মানুষ ঘরছাড়া। আশ্রয় নিয়েছেন ক্যাম্পে। এদিকে, পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে আটকে পড়েছেন একাধিক পর্যটক। হোটেলবন্দি হয়ে থাকতে হচ্ছে তাদের। প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের ঘরে ফেরানোর বন্দোবস্ত করা হচ্ছে
উত্তরবঙ্গের উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দুপুর ৩টের মধ্যে তিনি পৌঁছে যাবেন শিলিগুড়ি। তার আগে কলকাতা বিমানবন্দরে তিনি সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে বললেন, 'সমস্ত পর্যটক নিরাপদে। তাঁদের নিরাপদে উদ্ধার করেছে পুলিশ।' পাশাপাশি জানিয়েছেন, ৪৫টি ভলভো বাসে করে ৫০০ পর্যটককে সোমবারই নীচে নামিয়ে আনা হবে। দার্জিলিঙের ধসে মৃত পরিবারের জন্য চাকরি ও আর্থিক সাহায্যেরও ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী।
মমতা বলেন, 'সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নাগরাকাটা, মিরিক, জোড়বাংলো, কালিম্পং। সেখানে বহু সংখ্যক পর্যটক গিয়েছিলেন। তাদের উদ্ধার করেছি। পুলিশ তাদের নিরাপদে উদ্ধার করেছে। কেবলমাত্র ডায়মন্ড হারবারের একজন নিখোঁজ। তবে ৫০০ জনকে সোমবারই নীচে নামানো হচ্ছে। ৪৫টি ভলভো বাসে নামানো হচ্ছে তাদের। ২৫০ জনকে শিলিগুড়িতে রাখার ব্যবস্থা করেছি।'
মমতা জানিয়ে দিয়েছেন, যারা এখনও নামতে পারেনি, তারা যেন হোটেলেই থাকেন। হোটেল মালিকদেরও নির্দেশ দেন, কোনও ভাবেই যাতে তাদের থেকে অতিরিক্ত ভাড়া না চাওয়া হয়। ভাড়া দেবে সরকার। মমতা বলেন, 'আটকে পড়া পর্যটকদের ফিরিয়ে আনার খরচ আমাদের। হোটেলের ভাড়া সরকার দেবে। তাদের নিয়ে আসার দায়িত্ব আমাদের। জলে টাকা পয়সা কাগজ পত্র নষ্ট হয়ে গিয়েছে তাদের। মানবিকতার খাতিরে আমরা তো দেখবই।'
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পাহাড়ে বিপর্যয়ের ফলে মৃতদের পরিবার পিছু ৫ লক্ষ টাকা করে আর্থিক সাহায্যের কথা ঘোষণা করেছেন। এছাড়া প্রতি পরিবারের একজনকে স্পেশাল হোমগার্ডের চাকরি দেওয়া হবে বলেও ঘোষণা করেন।
উত্তরবঙ্গের পরিস্থিতির জন্য ফের ভুটান থেকে ছাড়া জলকে দায়ী করেছেন তিনি। মাইথন, পাঞ্চেত থেকে জল ছাড়ায় এক হাত নিয়েছেন ডিভিসিকেও। উত্তরবঙ্গের পরিস্থিতিকে তিনি ‘ম্যান মেড বন্যা’ বলে উল্লেখ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
শনিবার রাত থেকে টানা বৃষ্টিতে দার্জিলিঙে বিপর্যয় ঘটে গিয়েছে। বহু রাস্তায় ধস নেমেছে। জলস্তর বেড়ে বিপদসীমা ছাপিয়ে গিয়েছে তিস্তা, তোর্সা, জলঢাকার মতো নদী। ১০ নম্বর জাতীয় সড়ক বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তিস্তার জলের কারণে।
এক রাতের বৃষ্টিতে প্রকৃতির তাণ্ডবের পর দার্জিলিঙে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে। এখনও বহু জায়গায় উদ্ধারকাজ চলছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, সরকারের কাছে এখনও পর্যন্ত ২৩ জনের মৃত্যুর হিসেব পাওয়া গিয়েছে। তবে মৃতের সংখ্যা ২৪ ছাড়িয়ে গিয়েছে বলেই বেসরকারি সূত্রের দাবি। তাঁদের মধ্যে অন্তত পাঁচ জন নেপালের বাসিন্দা। সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মিরিক এলাকা।
দার্জিলিং থেকে শিলিগুড়িগামী প্রধান রাস্তা বন্ধ ছিল দীর্ঘ সময় পর্যন্ত। ফলে পর্যটকদের সহায় বিকল্প দু’টি রাস্তা। তিনধারিয়া রোড আপাতত খোলা আছে। অনেকে ফেরার জন্য সেই রাস্তা ধরছেন। অনেকে বেছে নিচ্ছেন পুরনো দার্জিলিঙের দুর্গম পাঙ্খাবাড়ি রোড। এই রাস্তা দার্জিলিঙের অন্যতম দুর্গম রাস্তা হিসাবে পরিচিত। কার্যত নিরুপায় হয়েই পর্যটকেরা ফেরার জন্য এই রাস্তা বেছে নিচ্ছেন।
মিরিকের রাস্তা এবং পাহাড়ে ওঠার রোহিণী রোড রবিবার থেকে বন্ধ। যে সমস্ত পর্যটক নেমে আসার চেষ্টা করছেন, তাঁদের কারও ট্রেন হয়তো সন্ধ্যায়, কারও রাতে। কিন্তু কেউ আর ঝুঁকি নিতে রাজি নন। প্রকৃতি যত ক্ষণ শান্ত রয়েছে, তার মধ্যেই তাঁরা পাহাড় থেকে নিরাপদে নামার জন্য মরিয়া।
অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যান। লাগাতার ভারী বৃষ্টির জেরে পাহাড়ের পাশাপাশি বন্যা পরিস্থিতি ডুয়ার্সেও। জলঢাকা, তোর্সা নদী উপচে জল ঢুকছে পার্শ্ববর্তী এলাকায়। দীর্ঘদিন পর তোর্সার জল উপচে প্লাবিত হয়ে পড়েছে জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানের বিস্তীর্ণ বনভূূমিতে। তৃণভূমি জলের তলায়। ফলে প্রাণ বাঁচাতে লড়ছে বন্যপ্রাণীরাও।
একাধিক ভিডিওতে দেখা দিয়েছে জলদাপাড়া অভয়ারণ্য থেকে গণ্ডার, হরিণ, সম্বর সব ভেসে যাচ্ছে। গণ্ডার-হরিণের মৃত্যুর ছবিও সামনে আসছে। সোমবারও জল নামেনি। আবার শনিবার রাত থেকে চলা বৃষ্টি পুরোপুরি থামেনি রবিবারও। ফলে কিছুটা জল নামলেও এখনও সম্পূর্ণ বিপন্মুক্ত হয়নি পরিস্থিতি। কোনও রকম ঝুঁকি নিতে নারাজ বন দফতর। এই সময় ডুয়ার্সে প্রচুর পর্যটক থাকে। যার অন্যতম আকর্ষণ জলদাপাড়ার একশৃঙ্গ গণ্ডার। এদিকে বন্যপ্রাণীগুলো নিজেরাও জলে ভেসে ডাঙা খুঁজে বেড়াচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে আপাতত সমস্ত রকম সাফারি ও জঙ্গলে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হল। পরবর্তী নির্দেশ না আসা পর্যন্ত এটি বলবৎ থাকবে।
দার্জিলিং থেকে শিলিগুড়ি যোগাযোগের জন্য মোটামুটি ব্যবহৃত হয় হিলকার্ট রোড এবং রোহিণী রোড। আর এই দুটি রোডেই রবিবার ধস নামে। যার ফলে যান চলাচল ছিল বন্ধ। তবে সোমবার পরিস্থিতির অনেকটাই বদলে গিয়েছে। খুলে দেওয়া হয়েছে হিলকার্ট রোড এবং রোহিণী রোড। পর্যটকেরা এই রাস্তা ধরেই আপাতত শিলিগুড়ি পৌঁছাচ্ছেন।
ধসের জেরে বন্ধ হয়েছিল জোরেবাংলো থেকে ঘুম যাওয়ার রাস্তা। তবে সেই রাস্তাতেও মেরামতির কাজ চলে। যার ফলে এখন খুলে দেওয়া হয়েছে সেই রাস্তা। এছাড়া ওল্ড NH55-ও খুলে দেওয়া হয়েছে। যার ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা মোটের উপর স্বাভাবিক হয়েছে।
পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে বন্ধ রাখা হয়েছে দার্জিলিঙের একাধিক ট্যুরিস্ট স্পট। সেই তালিকায় রক গার্ডেন থেকে শুরু করে টাইগার হিল, চিড়িয়াখানা রয়েছে। প্রশাসনের তরফে পর্যটকদের সাবধানে থাকার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। কোনও সমস্যা হলে যোগাযোগ করতে বলা হচ্ছে হেল্পলাইনে।
নবান্নের হেল্পলাইন নম্বর
নবান্নের পক্ষ থেকে খোলা হয়েছে হেল্পলাইন। সেখানে যোগাযোগের ফোন নম্বরগুলি হল- ০০৯১-২২১৪-৩৫২৬/০০৯১- ২২৫৩-৫১৮৫, টোল ফ্রি নম্বর -৯১-৮৬৯৭৯-৮১০৭০।
উত্তরবঙ্গে দুর্গতদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য প্রস্তুত রাজভবন। লাগাতার বৃষ্টিতে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় ধস নেমেছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। উত্তরবঙ্গের দুর্গতদের জন্য ব়্যাপিড অ্যাকশন সেল খোলা হয়েছে রাজভবনে। ২৪ ঘণ্টা সেখানে যোগাযোগ করা যাবে। এর জন্য রাজভবনের তরফে একটি নম্বর ও ইমেইল আইডি দেওয়া হয়েছে। রবিবার রাজভবনের তরফে এক বার্তায় জানানো হয়েছে, ব়্যাপিড অ্য়াকশন সেলের সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকছেন অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি সন্দীপ সিং রাজপুত। ফোন নম্বর ০৩৩-২২০০১৬৪১। এছাড়া ব়্যাপিড অ্যাকশন সেলের মেইল আইডি হল peaceroomrajbhavan@gmail.com। উত্তরবঙ্গে দুর্যোগে মৃতদের পরিজনদের সমবেদনা জানিয়েছেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস।
এর মধ্যেই জলদাপাড়া ট্যুরিজম লজের মধ্যে আটকে থাকা পর্যটকদের উদ্ধার করা হয়েছে। সেই উদ্ধারের অভিনব চিত্র দেখা গিয়েছে। রবিবার প্রায় ২৫ জন পর্যটক আটকে পড়েছিলেন লজে। সোমবার স্থানীয় প্রশাসনের সাহায্যে লজ কর্তৃপক্ষ আর্থ মুভারের সাহায্যে লজ থেকে আটকে পড়া পর্যটকদের নদী পার করে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।
বিপর্যস্ত রেল চলাচলও। উত্তর-পূর্ব রেলের বেতগাড়া স্টেশনে ধস নামার কারণে আলিপুরদুয়ার থেকে শিয়ালদহগামী কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসের রুট বদল হয়েছে। এছাড়াও, নয়াদিল্লিগামী ক্যাপিটাল এক্সপ্রেস, আনন্দবিহার এক্সপ্রেস এবং উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেসেরও রুট বদল হয়েছে। আলিপুরদুয়ার ও কোচবিহারের বেশ কিছু প্যাসেঞ্জার ট্রেন আপাতত বাতিল করা হয়েছে।
দার্জিলিং থেকে মংপু হয়ে শিলিগুড়ি যাওয়ার পথ খোলা রয়েছে। শিলিগুড়ি থেকে ৭১৭ (এ) জাতীয় সড়ক হয়ে সরাসরি কালিম্পং ও সিকিম যাওয়ার পথ খোলা আছে। এ ছাড়াও কালিঝোরা থেকে পানবু হয়ে কালিম্পংয়ে যাওয়ার রাস্তাও চালু। রাস্তায় ধস সরানোর পরে গোরুবাথান-লাভার রাস্তা খুলে দেওয়া হয়েছে।
দুধিয়া ব্রিজ ভেঙে পড়ায় বিচ্ছিন্ন শিলিগুড়ি ও মিরিক। পুটং-লোহাগড় রাস্তায় মিরিক থেকে পর্যটকদের শিলিগুড়িতে নিয়ে আসা হচ্ছে।
উত্তরবঙ্গের দুর্যোগে এখনও অবধি বাংলার ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানালেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর দাবি, এই প্লাবন পরিকল্পিত, ‘ম্যান মেড’। সিকিম, ভুটান থেকে জল এসেছে। সেই জলে ভেসেছে উত্তরবঙ্গ।