সময় হাতে গুনে আর ৬ মাসও বাকি নেই। জোর টক্কর দিতে ময়দানে নেমে পড়েছে গেরুয়া শিবির। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ২৯৪টি আসনের মধ্যে ২০০টি আসনকে টার্গেট করেছেন অমিত শাহ। আর শাহের বেঁধে দেওয়া নম্বর পেতে তাই জোর হোমওয়ার্ক চলছে গেরুয়া শিবিরে। এই আবহে তৃণমূলনেত্রী কী করবেন সেই দিকেই এখন নজর রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের। দলের মধ্যে বিদ্রোহের হাওয়া উঠেছে। নিজের হাতে সাজিয়ে তোলা তৃণমূলের বাগানেই এখন ভাঙনের মুখে। এই অবস্থায় তৃণমূল নেত্রীর বল-ভরসার অনেকটাই জায়গা জুড়ে রয়েছেন এক বিহারি ভদ্রলোক। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলেন, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যে ভরাডুবির পর যাঁর পরামর্শ মেনেই সাবধানী পা ফেলেছেন তৃণমূলনেত্রী। কিন্তু বঙ্গ রাজনীতিতে ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে নির্বাচনী কৌশলবিদ প্রশান্ত কিশোর মমতার দুর্গ বাঁচাতে পারবেন কিনা সেই প্রশ্নই এখন উঁকি-ঝুঁকি মারতে শুরু করেছে এরাজ্যের রাজনৈতিক অলিন্দে।
বলা হয় ২০১৪ সালে প্রথম মোদী সরকারের কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পেছনে প্রধান কারিগর ছিলেন নির্বাচনী কৌশলী প্রশান্ত কিশোর। সেই প্রশান্তই ২০১৫ সালের বিহার নির্বাচনে খেলা ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। শিবির পাল্টানোয় গোবলয়ের রাজ্যটিতে মুখ থুবড়ে পড়েছিল গেরুয়া শিবিরের বিজয় রথ। ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে ৩৪ থেকে তৃণমূলের সাংসদ সংখ্যা নেমে এসেছিল ২২। দিকবিদিক শূন্য তৃণমূলনেত্রীর হাত ধরেই এর পর রাজ্যে আগমন রাজনৈতিক কুশলী প্রশান্ত কিশোরের। এরপর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে একের পর এক কর্মসূচি রূপায়ণ করেছে তৃণমূল। বলাই বাহুল্য ‘দিদিকে বলো’ বা ‘বাংলার গর্ব মমতা’ সবকটি কর্মসূচির পেছনেই রয়েছে পিকের পাকা মাথার কারিকুরি। এর পাশাপাশি দল ভারী করতে একেবারে তৃণমূল–স্তরে কাজ করে চলেছে পিকে-র টিম। ‘ইউথ ইন পলিটিক্স’ কর্মসূচি করে গত আগস্টেই ৪ লক্ষের বেশি যুবক-যুবতীকে তৃণমূলের পতাকা ধরিয়েছেন। এই বিষয়ে প্রশান্ত কিশোরের সবচেয়ে বেশি নজর রয়েছে উত্তরবঙ্গের ওপরে, যেখানে গত লোকসভা নির্বাচনে প্রায় ধুয়ে-মুছে সাফ হয়ে গিয়েছে ঘাসফুল শিবির।
গত একুশ জুলাইয়ের মঞ্চে ভুল করে দল ছাড়া নেতা-নেত্রীদের পুনরায় তৃণমূলে আহ্বান জানিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শোনা যায় নেত্রীকে দেওয়া দলীয় কর্মীদের এই ঘরওয়াপসির মাস্টারস্ট্রোকও নাকি ছিল ভোট কৌশলী প্রশান্তর। ভোট গুরু সোশ্যাল মিডিয়াকে হাতিয়ার করেছেন সংগঠনের শক্তিবৃদ্ধিতে ও নিষ্ক্রিয় কর্মীদের ফের সক্রিয় করে তুলতে। তার জন্যই জনসংযোগ কর্মসূচিতে সরকারি কাজের খতিয়ান তুলে ধরা হচ্ছে। আর পিকের এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতেই শেষপর্যন্ত বিজেপি তাদের আইটি সেলের প্রধান অমিত মালব্যকে বাংলার ময়দানে নামাতে বাধ্য হয়েছে বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
একসময় নীতীশ কুমারের জেডিইউ-এর সদস্য ছিলেন প্রশান্ত কিশোর। কিন্তু এনআরসি নিয়ে নীতীশের অবস্থান মেনে নিতে না পেরে দল ছেড়েছিলেন প্রশান্ত। তখন এমনও শোনা গিয়েছিল তৃণমূলে যোগ দিতে পারেন ভোট কৌশলী। এমনকি ঘাসফুল শিবিরে এলে তাঁকে দলের রাজ্যসভার সাংসদও করা হতে পারে। সেই সময় তৃণমূলের পরিসংখ্যান বলছিল, প্রশান্ত কিশোর দায়িত্ব নেওয়ার পর ভালো ফল করেছে তৃণমূল। লোকসভা নির্বাচনে ভরাডুবির পর ঘুরে দাঁড়ান গেছে অনেকটাই। এমনকি তিন বিধানসভা উপনির্বাচনেও গেরুয়া শিবিরকে ধরাশায়ী করে জয় পেয়েছে দল। ' পিকে টনিকে' কাজে দেওয়ায় স্বস্তি পাচ্ছিলেন তৃণমূল নেত্রীও। কিন্তু বিধানসভা ভোটের মাস কয়েক আগেই ফের অশনিসঙ্কেত। বহিরাগত প্রশান্ত কিশোরের দলীয় সংগঠনে নাক গলানো মেনে নিতে পারছেন না তৃণমূল কংগ্রেসের বহু নেতা-কর্মীই। পিকে-র ছড়ি ঘোরানো নিয়ে তাই প্রকাশ্যে সরব হতে দেখা যাচ্ছে অনেক নেতাকেই। ফলে ভোট কৌশলী প্রশান্ত কিশোর এবং তাঁর টিম আই-প্যাকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে ভাঙনের ডঙ্কা বাজাচ্ছেন ঘাসফুল শিবিরের অনেক নেতাই। সম্প্রতি প্রশান্ত কিশোরের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন তৃণমূলের একাধিক বিধায়কও। দিনে দিনে সেই তালিকা দীর্ঘতর হচ্ছে।
ভারতের একাধিক রাজ্যে ভোটপর্বে কামাল দেখালেও বাংলায় প্রশান্ত কিশোর কৌশল তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছেন। বরং তৃণমূল নেত্রীর নিজের হাতে সাজানো দলকে দায়িত্ব নিয়ে তিনি খাদের কিনারায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। বর্তমান এমনই একের পর এক অভিযোগ আসছে পিকে-র বিরুদ্ধে। এরসঙ্গেই বিজেপির আক্রমণ তো আছেই। যে বহিরাগত আওয়াজ তৃণমল বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতাদের দিকে তুলেছে তার পাল্টা হিসাবেই প্রশান্ত কিশোরের পরিচয় নিয়ে সুর চড়াচ্ছে গেরুয়া শিবির। কিন্তু ২০২১ বৈতরণী পার হতে তিনি ছাড়া যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপায়ও নেই সেটাও ভালমতই বুঝতে পারছেন তৃণমূলনেত্রী। শুভেন্দু অধিকারী দলে থাকবেন কিনা তা ভবিষ্যত বলবে, কিন্তু মঙ্গলবার তৃণমূলের দুই সেনাপতির মুখোমুখি বৈঠকে বরফ গলানোর কাজটা কিন্তু করেছিলেন পিকেই। দুই মেরুতে দাঁড়িয়ে থাকা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ও শুভেন্দু অধিকারীর মধ্যে যে ২ ঘণ্টা বৈঠক হয়েছে তার কৃতীত্ব একমাত্র প্রশান্ত কিশোরেরই প্রাপ্য।