scorecardresearch
 

আজকের ভারত দেখলে কী বলতেন রামমোহন? জানা নেই

কত মানুষ গোমূত্র এবং গোবর সারা গায়ে লেপে বসে থাকছেন ঠা ঠা রোদে। নির্দ্বিধায় পান করছেন সে সমস্ত রেচন! বিজ্ঞান এবং চিকিৎসা ব্যবস্থাকে চিতায় তুলে সেখানে যুক্তিকে সহমরণে পোড়ানো হচ্ছে প্রতি দিন। বাংলার তথা দেশের নবজাগরণের প্রতীক বেঁচে থাকলে এই নতুন অধ্যায় হয়তো সহ্য করতে পারতেন না।

Advertisement
রাজা রামমোহন রায় রাজা রামমোহন রায়
হাইলাইটস
  • মাত্র সাড়ে তিন দশক আগেও দেশে সতী প্রথার জ্বলন্ত উদাহরণ হিসাবে থেকে গিয়েছেন রূপ কঁওয়র।
  • ১৮২৯ সালে প্রায় সমগ্র হিন্দু সমাজের বিরুদ্ধে লড়ে এই অসামাজিক প্রথাকে রদ করেছিলেন রামমোহন।
  • প্রায় ২০০ বছর তথা কথিত আধুনিক ভারতে ১৮ বছরের তরুণীকে স্বামীর চিতায় সহমরণে জ্বলতে দেখল দেশ।

সূর্য পূর্ব দিকেই ওঠে। আলো ছড়ায় পূব দিক থেকেই। বাংলার নবজাগরণের আলো পূব দিক থেকেই গোটা দেশে আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। অন্তত ইতিহাসবিদরা তেমনটাই বলেন। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, সত্যিই কি আলো ছড়িয়েছিল? সেই আলো দেখে কিছু মানুষ কি চোখ বন্ধ করে থাকেননি? এখনও কি সেই আলোকে কটাক্ষ করার লোকের অভাব রয়েছে? প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বিশেষ কষ্ট করতে হবে না। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি দেখলেই তা সহজে বোঝা যাবে।

মাত্র সাড়ে তিন দশক আগেও দেশে সতী প্রথার জ্বলন্ত উদাহরণ হিসাবে থেকে গিয়েছেন রূপ কঁওয়র। ১৮২৯ সালে প্রায় সমগ্র হিন্দু সমাজের বিরুদ্ধে লড়ে এই অসামাজিক প্রথাকে রদ করেছিলেন রামমোহন। প্রায় ২০০ বছর তথা কথিত আধুনিক ভারতে ১৮ বছরের তরুণীকে স্বামীর চিতায় সহমরণে জ্বলতে দেখল দেশ। করোনা মহামারীর জেরে সারা বিশ্বে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। এ দেশে প্রতি দিন হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন, গঙ্গায় ভাসছে লাশ। শ্মশানে ঠাঁই হচ্ছে না মৃতদেহের। তার মধ্যে কত মানুষ গোমূত্র এবং গোবর সারা গায়ে লেপে বসে থাকছেন ঠা ঠা রোদে। নির্দ্বিধায় পান করছেন সে সমস্ত রেচন! বিজ্ঞান এবং চিকিৎসা ব্যবস্থাকে চিতায় তুলে সেখানে যুক্তিকে সহমরণে পোড়ানো হচ্ছে প্রতি দিন। বাংলার তথা দেশের নবজাগরণের প্রতীক বেঁচে থাকলে এই নতুন অধ্যায় হয়তো সহ্য করতে পারতেন না।

ধর্ম ও সমাজ সংস্কারক রাজা রামমোহন রায়কে বলা হয় ভারতের নবজাগরণের পথিকৃৎ। তিনি জন্মেছিলেন এক সম্ভ্রান্ত রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ পরিবারে। কিন্তু পরে হিন্দু ধর্মীয় প্রথা এবং সামাজিক ব্যবস্থায় সংস্কার সাধনই হয়ে ওঠে তাঁর জীবনের মূল লক্ষ্য। তিনি ছিলেন বাংলা গদ্যেরও জনক। বাংলা গদ্য তখন সবে শুরু হয়েছে। বাংলায়বহু গ্রন্থ রচনা করেছিলেন তিনি। মূলত বিভিন্ন হিন্দু শাস্ত্র তিনি অনুবাদ করেছিলেন বিভিন্ন ভাষায়। যার মধ্যে বাংলা ছিল অন্যতম। তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন দেশাচার বা শাস্ত্রে আছে বলে যে গুলো চালানো হয়, সেগুলো শাস্ত্রে কোথাও লেখা নেই।

Advertisement

হিন্দু ধর্মের আচার ও পৌত্তলিকতা নিয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে বাবা মার সঙ্গে তাঁর তীব্র বিরোধ বাঁধে এবং পিতা তাঁকে ত্যাজ্যপুত্র করে দেন। রামমোহন রায় কলকাতায় পাকাপাকিভাবে চলে আসেন ১৮১৫ সালে। শুরু হয় সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই। হিন্দু ধর্মকে সংস্কার করতে তিনি আজীবন লড়াই করেছেন। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের মত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সহযোগিতায় রামমোহন রায় ১৮২৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ব্রাহ্মসমাজ, যা এক সামাজিক ও ধর্মীয় আন্দোলন এবং বাংলার পুনর্জাগরণের পথ-প্রদর্শক হিসাবে কাজ করেছিল।

আঠারোশ একুশে সংবাদ কৌমুদী নামেও একটি পত্রিকা বের করেন তিনি। এর একবছর পর রামমোহন ফারসি ভাষায়ও একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন যার নাম ছিল -মিরাত-উল-আকবর। সংবাদ কৌমুদী ছিল বাঙালি সম্পাদিত ও বাঙালি পরিচালিত প্রথম সংবাদপত্র। এর আগে "বেঙ্গল গেজেট" নামে একটি সংবাদপত্র প্রকাশিত হত। সংবাদ কৌমুদী প্রকাশিত হয়েছিল দশ বছর। তিনি তার সংবাদপত্রে তুলে ধরতেন কীভাবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিপ্লব মানুষকে মুক্তির সন্ধান দিয়েছে। তিনিই প্রথম ভারতে বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগ থেকে আলাদা করতে চেয়েছিলেন।

ভারতে সমাজ সংস্কারের জন্য সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথা বিলোপের ক্ষেত্রে । তৎকালীন হিন্দু সমাজের প্রথা অনুযায়ী হিন্দু বিধবাদের স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় পুড়িয়ে মারার বিধান ছিল। হিন্দু ধর্মমতে আঘাত লাগতে পারে বলে ইংরেজরা প্রথমে এই আইন প্রণয়ন করতে চায়নি, বলেছেন কৃষ্ণ ধর। তিনি বলেন অবশেষে ১৮২৯ সালে গর্ভনর জেনারেল বেন্টিঙ্কট এই আইন করেন, যার প্রধান কৃতিত্ব রামমোহন রায়ের।

'রাজা' উপাধি নিয়ে ১৮৩০ সালে রামমোহন রায় তৎকালীন দিল্লির বাদশাহ দ্বিতীয় আকবরের দূত হিসাবে ইংল্যাণ্ডে যান। বাদশাহ তাঁকে ভার দেন ইংল্যাণ্ডের সরকারের কাছে বাদশাহের ভাতা বৃদ্ধির সুপারিশ করার জন্য। মেনিনজাইটিস রোগে আক্রান্ত হয়ে ব্রিটেনের মাটিতেই ব্রিস্টলে ১৮৩৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর রামমোহন রায়ের মৃত্যু হয়। উনবিংশ শতাব্দীতে রামমোহন যে মুক্ত চিন্তাচেতনার আলো জ্বেলে দিয়ে গিয়েছিলেন, সেই আলো আজ কেমন যেন স্তিমিত, ম্রিয়মান দেখাচ্ছে।

 

Advertisement