ভোটবঙ্গ প্রতিদিনই ছড়াচ্ছে রাজনৈতিক উত্তেজনা। এই পক্ষ আরেক পক্ষকে আক্রমনে সুর চড়াচ্ছে। আর এর মাঝেই রবিবার দুপুর থেকে রাজ্য রাজনীতির নজর এখন তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী রুজিরা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকে।
রাজনীতির ময়দানে কখনই দেখা যায়নি রুজিরাকে। এমনিতেও সংবাদ মাধ্যম তাঁর নাগাল পায় না। পিসি শাশুড়ির মত রাজনীতি নয় বরং নিভৃতে ঘর সংসারেই মজে থাকতে ভালবাসেন রুজিরা। কিন্তু বিধানসভা ভোটের আগে তৃণমূলের যুব সভাপতি ও সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এখন বেকায়দায় নিজের স্ত্রীকে নিয়েই।
কয়লা-কাণ্ড নিয়ে কথা বলতে চেয়ে অভিষেকের স্ত্রী রুজিরা বন্দ্যোপাধ্যায় নারুলাকে রবিবার নোটিস দিয়েছিল সিবিআই। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার একটি দল হরিশ মুখার্জি স্ট্রিটে অভিষেকের বাড়ি ‘শান্তিনিকেতন’-এ গিয়েছিল রুজিরাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চায়। সেখানেই তারা ওই নোটিস দিয়ে আসে। এরপরেই রাজ্য রাজনীতিতে শোরগোল পড়েছে। তবে সিবিআইয়ের নোটিসের জবাব সোমবারই দিয়েছেন রুজিরা। মঙ্গলবার সিবিআইয়ের তদন্তকারীদের সঙ্গে দেখা করবেন বলে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাকে জানিয়েছেন তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী। সোমবার সিবিআই-কে ইমেল পাঠিয়ে তিনি এমনই জানিয়েছেন বলে সংস্থা সূত্রের খবর। ওই চিঠিতে রুজিরা লিখেছেন, মঙ্গলবার বেলা ১১টা থেকে বেলা ৩টের মধ্যে সিবিআইয়ের তদন্তকারী দল তাঁর বাড়িতে এসে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে পারে।
তবে লোকসভা ভোটের আগেও কিন্তু খবরের শিরোনামে উঠে এসেছিলেন অভিষেক ঘরণী। ২০১৯ সালের ১৫ মার্চ দমদম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিতর্কিত ঘটনাটি ঘটেছিল। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী ব্যাঙ্কক থেকে ফেরার সময় তাঁর ব্যাগ পরীক্ষা করতে চেয়েছিল শুল্ক দফতর। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী রুজিরা বেআইনি ভাবে ব্যাঙ্কক থেকে সোনা নিয়ে এসেছেন এই অভিযোগ তুলে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিল শুল্ক দফতর।
প্রশ্ন উঠেছিল রুজিরার নাগরিকত্ব নিয়েও। রুজিরা একজন থাই নাগরিক। ১৫ মার্চের রাতে তিনি ব্যাঙ্কক থেকে থাই এয়ারওয়েজের বিমানে কলকাতায় ফেরেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন মানেকা। দু'জনের কাছে মোট ৭টি ব্যাগ ছিল বলে অভিযোগ উঠেছিল। গ্রিন চ্যানেল দিয়ে যাওয়ার সময় শুল্ক দফতরের কর্তারা তাঁদের দুটি ব্যাগ সন্দেহজনক মনে হওয়ায় স্ক্যান করতে চেয়েছিলেন।
এনিয়ে তোলপাড় হয়ে যায় রাজ্য রাজনীতি। বিরোধীদের অনেকে অভিযোগ তোলেন, ব্যাগে সোনা নিয়ে আসছিলেন অভিষেক-পত্নী। অভিষেক চ্যালেঞ্জ করে বলেছিলেন, সিসিটিভি ফুটেজ প্রকাশ করার। ভোটের শেষ পর্বের প্রচারে ডায়মন্ড হারবারের সভা থেকে এ নিয়ে মুখ খুলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং। বলেছিলেন, "অভিষেকের স্ত্রীর ব্যাগে ছিল দুটো বালা, তাই নিয়েও মোদীর এত জ্বালা। " তার আগে মেটিয়াবুরুজের সভা থেকে বলেছিলেন, "ওরা অভিষেককেও ছাড়ছে না। ওঁর ছোট্ট বউটাকেও ছাড়ছে না।"
মিথ্যা বক্তব্য দেওয়া ও প্রকৃত তথ্য লুকানোর অভিযোগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধায়ের ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী রুজিরা নরুলাকে ২০১৯ সালে শোকজ করেছিল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের বিদেশ নাগরিক বিভাগ। নিজের ওভারসিজ সিটিজেন অফ ইন্ডিয়া কার্ড এবং প্যান কার্ড পাওয়ার জন্য রুজিরা ওই তথ্য দিয়েছিলেন বলে জানিয়েছিল তারা। শোকজ নোটিস অনুযায়ী রুচিরা ওসিআই এবং প্যানকার্ডের জন্য দেওয়া বিবৃতিতে তিনি যে থাইল্যান্ডের বাসিন্দা, সেই তথ্য চেপে গিয়েছিলেন। ১৫ দিনের মধ্য জবাব না দিলে তাঁর পার্সন অফ ইন্ডিয়ান অরিজিন বা পিআই ও কার্ড (নং. পি২৩৪৯৭৯) বাতিল হয়ে যাবে এমনটা জানান হয়েছিল। কার্ডে নিফন নকুলাকে রুজিরার বাবা হিসেবে উল্লেখ করা আছে। কার্ডটি ২০১০ সালের ৮ জানুয়ারি ব্যাঙ্ককের ভারতীয় দূতাবাস থেকে দেওয়া হয়েছিল। পরে পিআইও কার্ডের আবেদনের সময় রুজিরা তাঁর বিয়ের সার্টিফিকেট দিয়ে জানিয়েছিলেন, তাঁর বাবার নাম গুরশরণ সিং আহুজা।
বিয়ের আগে রুজিরার পদবি ছিল নারুলা। ২০১০ সালে ব্যাঙ্ককের ভারতীয় দূতাবাস থেকে পার্সন অফ ইন্ডিয়ান অরিজিন বা PIO কার্ড পান রুজিরা নারুলা। সেই কার্ডে আবেদনকারীর বাবার নাম ছিল নিফন নারুলা। ২০১৭ সালে PIO কার্ডটিকে ওভারসিজ ইন্ডিয়ান সিটিজেন বা OCI কার্ডে রূপান্তরিত করার জন্য কলকাতার ফরেন রিজিওনাল রেজিস্ট্রেশন অফিসে আবেদন করেন সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী। OCI কার্ড পেয়েও যান তিনি। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের দাবি ছিল, নিয়মমাফিক OCI কার্ড পাওয়ার জন্য বিয়ের সার্টিফিকেট জমা দিয়েছিলেন রুজিরা। সেই সার্টিফিকেটে আবার দিল্লির বাসিন্দা গুরশরণ সিং আহুজা নামে এক ব্যক্তিকে বাবা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সেকারণেই শোকজের মুখে পড়তে হয়েছিল ডায়মন্ড হারবারের তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী রুজিরাকে। কেন তিনি এমন কাজ করেছেন, তা জানতে চেয়েছিল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।
উচ্চমাধ্যমিকের পর আইআইপিএম থেকে বিজনেস ম্যানেজমেন্ট পড়তে দিল্লি গিয়েছিলেন অভিষেক। জানা যায় সেখানেই তাঁর সহপাঠী ছিলেন রুজিরা। । বন্ধুত্ব থেকে তা গড়া ভালবাসায়। কলেজ থেকে সুইজারল্যান্ডে ট্রেনিংয়ে গিয়ে সম্পর্ক আরও দানা বাঁধে।
রুজিরা দিল্লির রাজৌরি গার্ডেনের বাসিন্দা। রাজধানীর গফ্ফর মার্কেটে তাঁর বাবার একটি মোবাইলের দোকান রয়েছে, যা বেশ জনপ্রিয়। রুজিরার বাবা ও কাকা দুই বোনকে বিয়ে করেছিলেন। পরে তাঁরা ব্যাঙ্ককে রিয়েল এস্টেটের ব্যাবসা শুরু করেন। রুজিরার জন্মও ব্যাঙ্ককে। পরবর্তীতে তিনি দিল্লি আসেন।
অভিষেকের সঙ্গে রুজিরার বিয়ে হয়েছিল ২০১২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। তার কয়েকমাস আগেই রাজ্যে পালাবদল ঘটেছে। মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিয়েছেন তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জানা যায় দিল্লিতে অভিষেক ও রুজিরার বিয়ের এলাহি আসর বসেছিল। সেই সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উপস্থিত থাকতে না পরালেও তাঁর দলের অনেক নেতাই হাজির হয়েছিলেন সেই রাজকীয় বিয়ের অনুষ্ঠানে। মেয়ের সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা করতে আসার জন্য রাসবিহারী এলাকায় বাড়িও কিনেছিলেন রুজিরার বাবা-মা। অভিষেকও পরিবারের সঙ্গে ব্যাঙ্ককে গিয়েছেন।
রুজিরা ও অভিষেকের সুখেই ঘরসংসার চলছে। কালের নিয়মে ঘরে এসেছে দুই ফুটফুটে সন্তানও। রুজিরা ও অভিষেকের প্রথম সন্তান কন্যা, নাম আজানিয়া। ২০১৯ সালে তাঁদের পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। ছেলের নাম আয়ানাশ।