শর্তবর্ষ উদযাপন করছে টালা পার্ক প্রত্যয়। মহালয়ার আগের দিন, শনিবারই এই পুজো প্যান্ডেলের উদ্বোধন করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রত্যেক বছরই অভিনব থিমে দর্শকদের জন্য চমক নিয়ে হাজির হয় এই পুজো কমিটি। এবারও তাদের থিম ভাবনায় রয়েছে অভিনবত্ব।
শতবর্ষে টালা পার্ক প্রত্যয়ের বিষয় ভাবনা 'বীজ অঙ্গন'। এই থিম ভাবনা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মস্তিষ্ক প্রসূত। থিমের নামকরণও রয়েছেন তিনিই। এমনকী লিখেছেন টালা প্রত্যয়ের এ বছরের থিম সংও। সুরও দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রীই।
মুখ্যমন্ত্রীর দেওয়া থিমই মণ্ডপ সজ্জায় ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী ভবতোষ সুতার। প্রতিমাও তৈরি করেছেন তিনিই। থিমের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রতিমার মধ্যে রয়েছে কৃষকের ছোঁয়া। মূলত কেন্দ্রীয় সরকারের কৃষি বিলের বিরোধিতাই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে টালা প্রত্যয়ের এবারের পুজো মণ্ডপে। এই কৃষি বিলকে 'দিশাহীন' বলে বর্ণনা করা হয়েছে থিম ভাবনার মাধ্যমে।
টালা প্রত্যয়ের মণ্ডপ জুড়ে রয়েছে গ্রামীণ বাংলার খড়ের ছাউনি দেওয়া ঘর। বাঁশের উপর জ্বলতে দেখা যাবে প্রদীপ। এছাড়াও মণ্ডপসজ্জায় রাখা হয়েছে খরের বস্তা, লাঙল। টালা প্রত্যয়ের প্যান্ডেলের একদম মাঝের অংশে তৈরি করা হয়েছে একটি মস্তিষ্ক। এটি প্রতীকী। বীজ থেকেই যেমন গাছ তৈরি হয় তেমনই মানুষের মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটলেই জীবন পরিণতি পায়। সেই বিষয়টিকেই মেলানোর চেষ্টা করেছেন শিল্পী ভবতোষ সুতার।
টালা প্রত্যয়ের মা দুর্গা অসুরদলনী দেবী নন। এখানে দুর্গা প্রতিমা গড়ে তোলা হয়েছে কৃষকের বেশে। তিনি যেন এক প্রান্তিক চাষী। দেবী দুর্গা এখানে গ্রাম্য মহিলার মতো ধান কাটেন, জমিরে সার ছড়ান।
কৃষকবেশী দুর্গা কোলের সন্তানকে সঙ্গে নিয়েই কাজ করেন। গণেশরূপী সন্তানও তাঁর কোলে চেপে মাঠে যায়। তাই মা দুর্গা এখানে ত্রিশূল হাতে নয়, রয়েছেন লাঙল হাতে নিয়ে।
চাষীর রূপে মা দুর্গা পা দিয়ে মাড়িয়ে দিচ্ছেন বিষ ইউরিয়ার বস্তা। যা চাষের জমিতে ক্ষতি করে। সেই বস্তা থেকেই বেরিয়ে আসছে কৃষি বিলের খসড়া। আর সেটিই হল এবারের টালা প্রত্যয় মণ্ডপের অসুর।
থিমের অন্তর্নিহিত অর্থ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে উদ্যোক্তারা বলেন, 'বীজ হল বাস্তুতন্ত্রের ক্ষুদ্র একক। মানুষের জীবনে সেই একক কিংবা শক্তির নাম চেতনা।'
যে বীজের মধ্যে সুপ্ত রয়েছে সভ্যতার স্মৃতি, সেটিই টালা প্রত্যয়ের প্যাণ্ডেলে দেখানো হয়েছে। এটাও দেখানো হয়েছে, বীজ আজ বিপন্ন। উদ্যোক্তারা বলছেন, এই থিমের মাধ্যমে বোঝানো হবে কৃষি প্রকৃতির আশীর্বাদ। কিন্তু সেই কৃষি ব্যবস্থাকেই কুক্ষিগত করা রাখা হচ্ছে সার, কীটনাশক ও বীজের কাটাছেঁড়ার মধ্যে।
খাদ্যশৃঙ্খলের চূড়ায় থাকা মানুষ হয়তো ভুলে গিয়েছে পৃথিবীর সব কিছু একমাত্র তার ভোগ্য নয়। মানুষ একমাত্র জীব যারা প্রতিমুহূর্তে বিষ ভোগ করছে। জেনে বা না জেনে যা প্রতিদিন খাচ্ছি, যে ভিন্ন কৃষি নীতি আমাদের প্রতিদিন খাওয়াতে বাধ্য করছে, টালা প্রত্যয়ের বীজ অঙ্গন এবার সেই কথাই তুলে ধরবে।'
পুজো উদ্বোধনে গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, 'অরূপের পুজোর থিমটা আমি লিখি প্রতিবার আর ববির পুজোয় প্রতিমার চোখ আঁকি। কিন্তু এবার টালা প্রত্যয়ের পক্ষ থেকে জগন্নাথ মন্দির উদ্বোধনের সময়ে আমার কাছে অনুরোধ নিয়ে ওরা এসেছিল। ফেরাতে পারিনি। এই প্যান্ডেলের থিম সংয়ের কথা ও সুর আমি করেছি।' মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা ও সুরে এই গানটি গেয়েছেন রাজ্যের মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন।
পুজোয় টালা প্রত্যয়ের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে নতুন এক পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির কথা জানিয়েছে কলকাতা পুরসভা। ‘ইকোজেনিক’ নামে এই নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার দেখা যাবে টালা প্রত্যয়ের পুজো মণ্ডপে। মণ্ডপ সংলগ্ন এলাকায় ইতস্তত ছিটিয়ে থাকা কঠিন বর্জ্যকে ব্যবহারযোগ্য জ্বালানি বা কাঠকয়লায় পরিণত করা হবে। পাঁচ টন বর্জ্য নিয়ে পরীক্ষামূলক ভাবে মণ্ডপ সংলগ্ন এলাকায় এই প্রযুক্তির ব্যবহার করা হবে।
এদিকে টালা প্রত্যয়ের এবছরের থিমের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তৈরি ট্যাগ লাইন ‘সবুজ রবে বাংলা’ নিয়ে প্রথম থেকেই চর্চা শুরু হয়েছিল। সামনেই বিধানসভা ভোট, তার আগে এই ট্যাগলাইন নিয়ে রাজনৈতিক চাপানউতরও শুরু হয়েছিল। এর অন্তর্নিহিত অর্থ জানতে উৎসুক ছিলেন সকলেই। নিজেদের পুজোর থিমের মধ্যে দিয়ে কি কোনও সুক্ষ বার্তা দিতে চায় টালা প্রত্যয় কি না? সেই নিয়েই উঠেছিল প্রশ্ন।
সব জল্পনা উড়িয়েছেন এই ক্লাবের সদস্যরা। পুজো উদ্যোক্তা শুভ বসু জানিয়েছেন, শস্য-শ্য়ামলা বাংলার কথাই তুলে ধরা হয়েছে এই পুজোয়। বাংলা সবুজই থাকবে অর্থাৎ তারা বলতে চেয়েছে কৃষিক্ষেত্রে সবুজ থাকার কথা।