আম খেতে আমরা আমবাঙালি বড়ই ভালোবাসি। আমের রসে মজেনি এমন মানুষ পাওয়া ভার। শুধু দেশেই নয় বিদেশেও ভারতীয় আমের চাহিদা রয়েছে। আর বাংলা তো আমের আঁতুড়ঘর। তাছাড়া বাংলাদেশ, জাপান, থাইল্যান্ড, চিনেও আম হয়। তবে উৎপাদনে ভারতই সেরা। বছরে প্রায় ২৫ মিলিয়ন টন আম উৎপাদন হয়।
মালদা, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া দক্ষিণ দিনাজপুরে, উত্তর চব্বিশ পরগণার প্রচুর আমের বাগান রয়েছে যেখান থেকে রাজ্যের আমের একটা বড় অংশের চাহিদা মেটে। বাঙালির গরমের সময় কয়েক কুইন্টাল আম, এক সিজনে খাওয়া হয়ে যায় এক একটি পরিবারে। এটি হলফ করেই বলা যায়।
আর আমের কথা বললেই যে সমস্ত আমের নাম মাথায় আসে সেগুলি মধ্যে ফজলি, ল্যাংড়া, চৌষা, হিমসাগর, লক্ষণভোগ, সীতাভোগ, বেগম খাস হাজারও নাম মাথায় আসে। কিন্তু আমি এরকম নামগুলির অদ্ভুত হওয়ার কারণ কী? তা জানতে আমাদের ইচ্ছে করেনা! আসুন আজকে আমরা কয়েকটি আমের নামের পিছনে কারণ কি তা জেনে নিই।
বৈশাখী আম
এই আম দুই বাংলাতে ভারত ও বাংলাদেশে পাওয়া যায়। দেখতে সবুজ এই আমটি বছরে সবার আগে পাকে। এটি বৈশাখ মাসের শেষের দিকে বাজারে চলে আসে। খুব অল্প পরিমাণে আসায় সব বাজারে পাবেন না। খুব মিষ্টিও হয় না। বৈশাখ মাসে আসে বলে বৈশাখী আম নাম হয়েছে এর
ফজলি
কথিত আছে, ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দে মালদহের কালেক্টর র্যাভেন সাহেব ঘোড়ার গাড়ি চেপে গৌড় যাচ্ছিলেন। পথে তার জল তেষ্টা মেটানোর জন্য গ্রামের এক মহিলার কাছে জল খেতে চান। ফজলু বিবি নামে সেই মহিলার বাড়ির আঙিনায় বড় একটি আমগাছ ছিল। ফজলু বিবি সেই আম দিয়ে ফকির-সন্ন্যাসীদের আপ্যায়ন করাতেন (এজন্য এই আমের আর এক নাম ফকিরভোগ)। ফজলু বিবি তাকে জলের বদলে একটি আম খেতে দেন। আম খেয়ে কালেক্টর সাহেব ইংরেজিতে তাকে আমের নাম জিজ্ঞেস করেন। বুঝতে না পেরে ওই মহিলা তার নিজের নাম বলে বসেন। সেই থেকে ওই আমের নাম হয়ে যায় ফজলি।
ল্যাংড়া
মোঘল আমলে ভারতের বিহার রাজ্যের দ্বারভাঙায় এই আম চাষ শুরু হয়। আঠারো শতকে এক ফকির সুস্বাদু এই আমের চাষ করেন। এই খোড়া ফকিরের নামে আমটির নামকরণ হয়েছে। ফকিরের আস্তানা থেকে এই জাতটি প্রথম সংগৃহীত হয়েছিল। খোড়া ফকির যেখানে বাস করতেন তার আশেপাশে শত শত আমের গাছ ছিল। তারই একটি থেকে ল্যাংড়া নামের অতি উৎকৃষ্ট জাতটি বেরিয়ে এসেছে। সেই ফকিরের পায়ে একটু সমস্যা ছিল। সেই থেকে এই আমের নাম হয়ে যায় ‘ল্যাংড়া’।[৯]
চৌসা
উত্তর জানতে আপনাকে আমাদের সঙ্গে কয়েকশ বছর পিছনে চলে যেতে হবে। এটা ১৫৩৯ সালের কথা যখন শের শাহ সুরি বিহারের চৌসার যুদ্ধে হুমায়ুনকে পরাজিত করেন। এই উদযাপনে তিনি তার প্রিয় আমের নাম রাখেন চৌসা। তখন থেকেই এই জাতের আম একই নামে পরিচিত হয়।
লক্ষ্মণভোগ
ইংরেজবাজারের চণ্ডীপুরের বাসিন্দা লক্ষ্মণ একটি আম গাছ রোপণ করেন। স্বাদে-গন্ধে সেই আম ছিল তুলনারহিত। লক্ষ্মণ চাষির নাম থেকেই লক্ষ্মণভোগ আমের উৎপত্তি।
গোপালভোগ
ইংরেজবাজারে নরহাট্টার গোপাল চাষি এই আম প্রথম চাষ করেন। তাঁর হাতে তৈরি নামই প্রথম পরিচিতি পায়। তাঁর নামেই আমটির নাম হয় গোপালভোগের।
গোলাপখাস
এ আম বিখ্যাত তার গন্ধের জন্য। মিষ্টি গোলাপের গন্ধ বহন করে বলে এই আমকে এই নামে ডাকার চল শুরু হয়ে যায়। প্রাচীন বাংলার আমগুলির মধ্যে গোলাপখাস অন্যতম। এই আমের গায়ে গোলাপের রঙের লালচে আভা থাকে।
গুটি
চেহারায় ছো়ট এক প্রকারের আম খেয়ে সেই আঁটি নিজের বাগানে পুঁতেছিলেন মালদহের এক দরিদ্র কৃষক। সেই আঁটি থেকেই জন্ম নিয়েছিল আরেক আমগাছ। কাঁচা অবস্থায় টক। কিন্তু পাকলে খুব মিষ্টি। আঁটি বা গুটি থেকে গাছটি জন্মায় বলে আমের নামও হয়ে যায় ‘গুটি’।
আশ্বিনা
আশ্বিন মাসে পাকে যে আম তাকে ‘আশ্বিনা’ বলে চেনে বাংলা। এটি মরশুমের শেষ আম। এই আম এসে যাওয়া মানে এবছর আর নতুন আম আসবে না। আমের মরশুম এবারের মতো শেষ। যদিও হিমঘরের আম পরেও বাজারে মেলে।
আম্রপালি
এই আমটি সংকর প্রজাতির আম। এটি দশেরি এবং নিলাম এই দু জাতের আমকে হাইব্রিড করে তৈরি করা হয়েছে। তার নাম দেওয়া হয়েছে আম্রপালি।কথিত আছে, বৈশালীর এক রাজকন্যা বাগানে আম গাছের পাদদেশে জন্মগ্রহণের জন্যই তার এমন নামকরণ হয়েছিল। তিনি ছিলেন অসাধারণ সুন্দরী। তাঁকে পেতে চাইতেন সবাই। এই আমের মিষ্টতার জন্য়ই সেই রাজকন্যার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নামকরণ করা হয়েছিল বলে মন মনে করা হয়।
কোহিতুর
এই নামকরণের কারণ সঠিক বলা যায় না। তবে অনেকে মনে করেন যে উচ্চ স্বাদ ও উচ্চ মানের জন্য কোহিতুর নামে পাহাড়ের নামে এই নামকরণ করা হয়েছে। কোহিতুর সেই পাহাড় যেখানে হজরত মুসা দৈবী আলো দেখেছিলেন। বাংলায় এই আমের আগমন খুব সম্ভবত নবাব সুজাউদ্দিনের আমলে।