টয়ট্রেনের হেরিটেজ শিরোপার এবার ২৫ বছর পূর্তি ৷ তারই উদযাপনে একাধিক নয়া চমক নিয়ে হাজির দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে ৷ ব্রিটিশ আমলের এই গৌরবের ইতিহাস আজও সযত্নে লালিত ৷
নানা রকম ঐতিহ্য ও পুরনো জিনিস দেখা যাবে এই বছর। পর্যটদের জন্য পোয়াবারো। চাক্ষুষ করা যাবে টয়ট্রেনের ১০০ বছরের পুরনো ইঞ্জিন ৷
দার্জিলিং ! এই নামটা মাথায় এলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সবুজে ঘেরা শৈলরানি, বাতাসিয়া লুপ আর পাহাড়ের পাকদণ্ডি দিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে ছুটে চলা টয়ট্রেন।
একের পর এক বলিউড-টলিউডের সিনেমার শ্যুটিং হয়েছে এই টয়ট্রেনকে ঘিরে। শাহরুখ-সঈফ থেকে রাজেশ খান্না-শর্মিলা, রাজেন্দ্র কুমার থেকে দিলীপ কুমার সহ বিখ্যাত তারকারা টয়ট্রেনের সঙ্গে শ্যুট করেছেন।
দার্জিলিংয়ের টয়ট্রেন বিশ্বের পর্যটনের দরবারে এক বহুল প্রচলিত নাম । যার টানে বারে বারে দেশ বিদেশ থেকে পর্যটকরা ছুটে আসেন । আজও এটি পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু দার্জিলিংয়ের টয়ট্রেন হেরিটেজ শিরোপা নিয়ে নিজের ইতিহাসকে গৌরবের সঙ্গে ধরে রেখেছে।
১৮৭৮ সালে কলকাতার সঙ্গে প্রথম শিলিগুড়ি মিটার গেজ রেললাইনের মাধ্যমে যুক্ত হয় । কিন্তু সেই সময় শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং যাওয়ার জন্য ঘোড়ায় টানা টাঙা গাড়ি ছাড়া আর কোনও অবলম্বন ছিল না । সেইসময় ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানির এক এজেন্ট রেলপথে দার্জিলিংকে যুক্ত করার প্রস্তাব দেন ।
তৎকালীন গভর্নর অ্যাশলে ইডেন সেই প্রস্তাবে ছাড়পত্র দেন । কিন্তু মিটারগেজের ট্রেন ভারী হওয়ার কারণে ন্যারো গেজের ট্রেন চালানোর উদ্যোগ নেওয়া হয় । গভর্নরের সবুজ সংকেতের পর গিলেন্ডারস আরবাথনট অ্যান্ড কোম্পানি এই রেলপথ নির্মাণ করার কাজ শুরু করে ।
১৮৮০ সালের ২৩ অগাস্ট শিলিগুড়ি-কার্শিয়াং অংশটি চালু হয় । তারপর দার্জিলিং পর্যন্ত লাইনের সম্প্রসারণ করে ১৮৮১ সালের ৪ জুলাই শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং লাইন চালু হয়। ৮৮ কিলোমিটার ন্যারো গেজ রেললাইনে চলে ট্রেনটি।
প্রায় ৭২০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত ঘুম বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেলস্টেশন। স্বাধীনতার পর টয়ট্রেনকে ভারতীয় রেল উত্তর পূর্ব সীমান্ত রেলের অধীন দার্জিলিং হিমালয়ান রেলের আওতায় নিয়ে আসে ।
১৯৩৪ সালে ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষতি হয় টয়ট্রেনের । কিন্তু তার পরেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সমস্ত ক্ষতি কাটিয়ে এই টয়ট্রেন সেনাবাহিনীকে খাবার ও সামগ্রী পৌঁছে দেওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । ১৯৯৯ সালের ৫ ডিসেম্বর ইউনেস্কো ডিএইচআরকে হেরিটেজ শিরোপা প্রদান করে ।
টয়ট্রেনের টানেই প্রতি বছর দেশ বিদেশের অগণিত পর্যটক ছুটে আসেন । গড়ে প্রতি বছর ন্যূনতম পাঁচ লক্ষ পর্যটক এই টয়ট্রেনে ভ্রমণ করেন । আর টয়ট্রেনের কারণেই পাহাড়ে পর্যটনে প্রসার ঘটেছে । আরও বেশি সংখ্যক পর্যটক এই টয়ট্রেনের কারণে শৈলরানি দার্জিলিং-সহ গোটা পাহাড় ঘুরতে আসেন ।
বিদেশি পর্যটকদের জন্য চার্টার্ড সার্ভিসের পাশাপাশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে রেড পান্ডা সাফারি, শিলিগুড়ি থেকে তিনধারিয়া পর্যন্ত জঙ্গল টি সাফারি, তিনধারিয়া থেকে দার্জিলিং ইভনিং জয়রাইড, দার্জিলিং থেকে ঘুম পর্যন্ত জয়রাইড এবং এনজেপি থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত টয়ট্রেনের পরিষেবা রয়েছে । এইসব পরিষেবার জন্য ১৩টি স্টিম ইঞ্জিন ও ছয়টি ডিজেল ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়।
এছাড়াও ভিস্তাডোম কামরা, চার্টার্ড কামরা রয়েছে । সিনেমার শ্যুটিংয়ের জন্যও টয়ট্রেন ভাড়া দেওয়া হয়ে থাকে । পরিণীতা ও বরফির মতো ফিল্মে এই টয়ট্রেনেই শুটিং হয়েছে । টয়ট্রেনের সমস্ত বুকিং বর্তমানে অনলাইনে হয় ।
টয়ট্রেনকে আরও বেশি প্রচারের আলোয় আনতে ২০২০ সাল থেকে ঘুম উৎসবের সূচনা করা হয়েছে । যেখানে দার্জিলিং হিমালয়ান রেল এবং টয়ট্রেনের ব্রিটিশ আমলের ইতিহাসকে পর্যটকদের সামনে তুলে ধরা হয় । চালানো হয় স্পেশাল জয়রাইড । সঙ্গে থাকে পাহাড়ের লোকসংস্কৃতির নাচ-গান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
চলতি বছরেও একইভাবে ৩০ নভেম্বর থেকে ওই ফেস্টিভ্যালের সূচনা করা হবে । সেখানে ১০০ বছরেরও বেশি সময় পুরনো ব্রিটিশ আমলের তিনটি স্টিম ইঞ্জিনের ইতিহাসকে তুলে ধরা হবে। যাতে অংশ নেবে দেশ-বিদেশের একাধিক পর্যটক।