দার্শনিক, অধ্যাপক, বারতের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি তথা ভারতরত্ন ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের জন্মদিবস শিক্ষক দিবস হিসাবে পালিত হয়ে আসছে আমাদের দেশে। ৫ সেপ্টেম্বর শিক্ষকদের প্রতি সম্মান জানানোর দিন। কিন্তু সত্যি কি আমরা আন্তরিক ভাবে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই? নদিয়ার শান্তিপুরের বিজ্ঞান শিক্ষকের অসহায় দশা সেই প্রশ্ন তুলে দিল।
মা-বাবার মৃত্যুর পর, দীর্ঘ ১০ বছর ধরে, খই মুড়ি খেয়ে মাটিতে শুয়ে কাটাচ্ছেন নদীয়ার শান্তিপুরের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সোমনাথ রায়।
নদিয়ার শান্তিপুর শহরের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের জলেশ্বর তিলিপাড়ার ফিজিক্স ,কেমিস্ট্রি , অঙ্ক এবং ইংরেজির শিক্ষক সোমনাথ রায় তার মার মৃত্যুর পর টানা ১০ বছর ধরে মুড়ি খই খেয়ে কাটাচ্ছেন।
ঘন বর্ষার মধ্যেও জঙ্গলের পাশে এক চিলতে বারান্দায় মাটিতেই শুয়ে থাকেন তিনি, অথচ তার মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক এবং বিএ প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের রেজাল্ট দেখলে চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যাবে! সেই আমলেও তিনি ৭০-৮০ শতাংশ নম্বর পেতেন।
সোমনাথবাবুর বাবা প্রদ্যূৎ রায়, রাজ্য সরকারের ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরির বেলগাছিয়া শাখার সিনিয়র সাইন্টিস্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিলেন। মা আশুতোষ কলেজের কৃতি ছাত্রী ছিলেন সেসময়ের। শান্তিপুর মিউনিসিপ্যাল উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র হিসাবে প্রতি বছর প্রথম হতেন সোমনাথ রায়। ১৯৮০ সালে মাধ্যমিকে ৭৫ শতাংশ এবং ৮৭ সালে উচ্চমাধ্যমিকে ৬৫ শতাংশ নম্বর নিয়ে পাশ করেন তিনি, মাঝে বেশ কয়েক বছর তার মূত্রাশয় সংক্রান্ত সমস্যার জন্য পড়াশোনা বিলম্বিত হয় । কেমিস্ট্রিতে অনার্স নিয়ে বিএসসি প্রথম এবং দ্বিতীয় বর্ষের কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করেন, বাবার অসুস্থতার কারণে স্নাতক স্তরে পরীক্ষা আর দেওয়া হয়নি।
পড়াশোনার প্রতি অত্যন্ত ঝোঁক অন্যদিকে বাবার প্রাণ সংশয় একমাত্র সন্তান হওয়ার কারণে এই দুইয়ের চাপান উতোরে সংসারের হাল ধরতে টিউশনের পথ বেছে নিতে হয় তাকে। ২০০৭ সালে বাবা মারা যাওয়ার তিন বছরের মাথায় মায়ের মৃত্যু। রসায়নের গবেষক হওয়ার স্বপ্ন সফল না হওয়ায় মানসিক ভাবে কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি।
বাপ ঠাকুরদার জমিজমা বর্ধমান ধাত্রীগ্রামে থাকলেও তা জবর দখল হয়ে যায় দেখভালের অভাবে , বর্তমানে ঠাকুরমার এক নিকট আত্মীয়ের অনুমতিতে শান্তিপুরে বাড়িতে থাকছেন তিনি। মা মারা যাওয়ার পর থেকে, সংসারের আসবাবপত্র সমস্ত গরিব-দুঃখীদের মাঝে দান করে, তিনি মাটিতে শুয়ে জীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত নেন। রান্নাবাড়ির পাট নেই সেই থেকে! কখনো মুড়ি,খই , পাউরুটি এ ধরনের শুকনো খাবার খেয়ে কাটাচ্ছেন তিনি। ছাত্রদের দেওয়া অর্থ হাতে যদি আসে বড়জোর কিছু আনাজ একসঙ্গে সেদ্ধ করে খেয়ে থাকেন
তবে খাওয়ার থেকেও তার কাছে ভীষণ প্রিয় বই । রাখার উপযুক্ত জায়গা না থাকার কারণে সেগুলো বস্তায় বেঁধে মাটিতে রেখেছেন তিনি। সারাদিন বই পড়েন ,তবে বিদ্যুৎ না থাকার কারণে সন্ধ্যায় শুয়ে পড়তে হয় তাকে। মা ছোটবেলায় বেশিরভাগ সময় বারান্দার এক কোণে তাকে নিয়ে শুয়ে থাকতেন তাই ঘরে নয়! জঙ্গল ঘেরা বারান্দার এক কোণে এখনো রাত্রি বাস করেন তিনি।
করোনা পরিস্থিতির আগে ৫০ জনের মতো জন ছাত্র পড়াতেন তিনি। সচেতন অভিভাবকরা, এ সময় বন্ধ রেখেছেন তাদের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, তাই বছর দুয়েক হলো অত্যন্ত দুরবস্থার মধ্যেই দিন কাটছে। তবে তার হাতে তৈরি বহু ছাত্র-ছাত্রী আজ প্রতিষ্ঠিত, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সামলানো ছাত্ররা মাঝেমধ্যে পাঠান গুরুদক্ষিণা।
আজ শিক্ষক দিবসে নানান অনুষ্ঠানে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষকদের সংবর্ধনা জানানো চলছে। তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী গৃহশিক্ষকের শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদিত হলেও সোমনাথ রায়ের মতো শিক্ষকরা সারাজীবন থাকবেন ব্রাত্য। শুধু পড়াশুনায় নয়, কবি ,দার্শনিক, নাচ-গান, ছবি আঁকা আবৃত্তি ,গায়ক, অভিনয় ক্রীড়া, বাদ্যযন্ত্র বাদক সবেতেই খুঁজলে পাওয়া যাবে এ ধরনের জ্ঞানপিপাসু শিক্ষকদের। আজ শিক্ষক দিবসে তাই তার প্রতি রইলো শ্রদ্ধা।