Fugu The Most Poisonous Fish Of The World: দেখতে খানিকটা উদ্ভট। পেট মোটা গোলমতো, দেখে অনেকেরই ভক্তি নাও আসতে পারে। কিন্তু যাঁরা খেয়েছেন তাঁরা বলেন এই মাছ নাকি খুবই সুস্বাদু। জাপানে সবচেয়ে বেশি চাহিদা হলেও ভারত-বাংলাদেশের উপকূল এলাকার মানুষও অনেকে খায় এই মাছ। বিশেষ করে বাংলাদেশে ভাল চল রয়েছে। কিন্তু ভয়ঙ্কর ব্যাপার হল এই মাছ খাওয়ার পদ্ধতি না জানলে মৃত্যু হতে পারে। কারণ এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত খাদ্যযোগ্য (Edible fish) মাছ। নাম পটকা বা ফুগু (Fugu)মাছ বা ব্লো ফিশ (Blow)।
জাপানের (Japan) সবথেকে ব্যয়বহুল শীতকালীন খাবারের একটি পদ এই ফুগু ফিশ। প্রায় সমস্ত ফুগু মাছের মধ্যে টেট্রোডটক্সিন (tetrodotoxin) নামে একধরনের বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ পাওয়া যায়, যা সায়ানাইডের থেকেও প্রায় ১২০০ গুণ বেশি ক্ষতিকারক। এই টক্সিন এতটাই শক্তিশালী যে, একটি ফুগু মাছের থেকে যে পরিমান টেট্রোডটক্সিন নিঃসৃত হয় তা প্রায় ৩০ জন মানুষকে মেরে ফেলতে সক্ষম।
জাপানে অভিজাত কিছু রেস্টুরেন্টে ফুগু মাছের এই অনবদ্য ও সুস্বাদু পদটি পাওয়া গেলেও, তা শুধুমাত্র বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং লাইসেন্সধারী রাঁধুনিরাই রান্না করতে পারেন। তা সত্ত্বেও সরকারি হিসাবে প্রতি বছর কমপক্ষে ৩০-৫০ জন মানুষ ফুগুর বিষক্রিয়ায় হাসপাতালে ভর্তি হন। কেউ কেউ মারাও যান।
প্রতি বছর জাপানিরা প্রায় ১০,০০০ টন ফুগু মাছ খায়। রেস্টুরেন্টে একজনের জন্য একটি ফুগু পদের দাম পড়বে ২,০০০ থেকে ৫,০০০ ইয়েন! অর্থাৎ প্রায় ২০ থেকে ৫০ ডলার। প্যাকেট করা ফুগু মাছের দাম পড়বে কেজি প্রতি ১৩০-২৫০ ডলার! আর যদি ফুগু দিয়ে ৩ কোর্সের একটি ডিনার সারতে চান তো খরচ পড়বে জন প্রতি ১০০০ ডলারেরও বেশি।
এই প্রাণঘাতী ফুগু মাছের চোখ, যকৃৎ, অন্ত্র, ডিম্বাশয় এবং ত্বকে টেট্রোডটক্সিনের মতো যে বিষ রয়েছে তা আগুনে পোড়ালে বা সিদ্ধ করলেও এতটুকু শক্তিক্ষয় হয় না। প্রাণঘাতী এই ক্ষমতার জন্য জাপানের কানসাই এলাকার মানুষেরা ফুগুকে বলে 'টেপ্পো', যার অর্থ পিস্তল।
বিশেষ এক পদ্ধতিতে এই বিষাক্ত মাছ ফুগুকে বিষমুক্ত করে এটিকে খাদ্যযোগ্য করে তোলে জাপানিরা। রেস্টুরেন্ট আর ফুগু প্রক্রিয়াজাত করা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ফুগুর বিষাক্ত অংশগুলো বিশেষ একটি পলিথিন ব্যাগে ভরে বেঁধে লকারে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়। সারদিনে জমা হওয়া বিষাক্ত বর্জ্যগুলো একত্র করে পাঠানো হয় চুল্লিতে। সেখানে বর্জ্যগুলোকে তেজষ্ক্রিয় বর্জের মত করে উচ্চ তাপমাত্রায় পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়ে থাকে।
২০১৮ সালে মধ্য জাপানের গামাগাড়ি নামে এক জায়গায় ৫ প্যাকেট ফুগু মাছ বিক্রি হয়েছিল যাদের যকৃৎ অপসারণ করা হয়নি। আর এর পর থেকেই ফুগু মাছ বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। জাপানে খোলা বাজারে আস্ত ফুগু বিক্রি নিষিদ্ধ। এমনকি, ফুগু মাছ বানানোর জন্য লাইসেন্স পেতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে দিতে হয় কঠিন সব পরীক্ষা। পরীক্ষা হয় দুই দিনব্যাপী। প্রথম দিনের লিখিত পরীক্ষায় যারা পাস করে তারা পরের দিন ব্যবহারিক পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ পায়। ব্যবহারিক পরীক্ষায় প্রত্যককে দেওয়া হয় একটি ফুগু মাছ, একটি ছুরি আর দুটি ট্রে। সময় থাকে ২০ মিনিট। এ সময়ের মধ্যে ফুগু কেটেকুটে বিষাক্ত আর বিষমুক্ত অংশ আলাদা আলাদা ট্রেতে রাখতে হবে। সামান্য ভুল হলেই নিশ্চিত ফেল। এ ব্যাপারে নূন্যতম ছাড় দেয়া হয় না। যারা টিকে যাবে তাদেরকে ফুগুর একটি পদ তৈরি করে সুন্দর করে পরিবেশন করতে হবে।
পরীক্ষার পরের অংশটা আরও ভয়ঙ্কর। পরীক্ষার্থী যা রান্না করেছে তাকে তা খেতে হবে। সার্টিফিকেট প্রাপ্ত প্রত্যেককে দুই থেকে তিন বছর আরেকজন অভিজ্ঞ শেফের অধীনে শিক্ষানবীশ হয়ে থাকতে হয়। তারপর তাদেরকে মূল কাটাকুটি আর রান্নার দায়িত্ব দেওয়া হয়। জাপানে ফুগু-শেফদের অনেক কদর। প্রতি বছর ৮০০-৯০০ জাপানি এ পরীক্ষায় অংশ নেয়। পাস করে মাত্র ৩৫% থেকে ৬০% পরীক্ষার্থী।
এই কঠোর ব্যবস্থা এবং নজরদারির ফলে ক্রেতারা আশ্বস্ত হওয়ায় ফুগু বিক্রি বেড়ে গিয়েছে আর দাম ও আকাশছোঁয়া। জাপানের প্রতিটি শহরে শুধু ফুগুর রেসেপি করে এমন একাধিক সরকার অনুমোদিত রেস্টুরেন্ট রয়েছে। শুধু টোকিও শহরেই এরকম রেস্টুরেন্ট রয়েছে ৮০০ টি। এসব রেস্টুরেন্ট এবং বাণিজ্যিকভাবে ফুগো প্রক্রিয়াজাত করা প্রতিষ্ঠানগুলোতে হাজার হাজার সার্টিফিকেটধারী ফুগু-শেফ কাজ করেন। শুধু ওসাকা শহরেই কাজ করেন ৮০,০০০ ফুগু-শেফ।
ফুগু সবচেয়ে বেশি খাওয়া হয় কাঁচা অবস্থায়। ফুগুর মাংস খুব পাতলা এবং ছোট ছোট পিস করে কাটা হয়। এমন পাতলা ভাবে কাটতে হবে যেন প্লেটের নকশা পর্যন্ত দেখা যায়। তারপর নানান রকম ফিশ সস, সয়াসস, চিলি সস, বিশেষ সবজির স্যালাড ও জাপানি ট্র্যাডিশনাল মদ সহযোগে কাঁচা খাওয়া হয়। এই পদের নাম sashimi। এটিই ফুগুর সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ। এছাড়াও কাঁটা তোলা চামড়া স্যালাড হিসেবে খাওয়া হয়। এই পদের নাম Yubiki। ফুগুর পাখনা ও লেজ ভালো করে শুকিয়ে ছাতু করে তৈরি করা হয় Hire-Zake নামের আরেক পদ। এছারাও স্যুপ করে, কাবাব বানিয়ে বা সবজির সাথে রান্না করেও ফুগু খাওয়া হয়ে থাকে।
তথ্য়- বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ওয়েবসাইট ও কোরা