করোনা অতিমারিতে বদলে গিয়েছে জীবন। বহু লোকের কাজ থেকে পাকাপাকিভাবে ছুটি ঘটে গিয়েছে। অনেককেই আবার কাজের জায়গা বদলে ফেলতে হয়েছে। অনেকের আবার কাজ রয়েছে, তবে ধরণই বদলে ফেলেছেন। বেশিরভাগ কর্পোরেট এবং বেসরকারি অফিসগুলি করোনার প্রকোপ থেকে বাঁচাতে কর্মীদের work-from-home পদ্ধতি চালু করে দিয়েছেন।
গত এক-দেড় বছরের এটিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে আম বাঙালি। work-from-home শব্দটি আমাদের কাছে নতুন কিছু নয়। কারণ কমবেশি সকলেই এখন পরিচিত। কারণ অনেকেই এখন গত দেড় বছরে work-from-home এর সঙ্গে কমবেশি পরিচিত। সেভাবেই পেশাগত কাজে দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
তবে ওয়ার্ক ফ্রম জঙ্গল শব্দটি শুনেছেন কী ! শব্দটি না শুনে থাকাটাই স্বাভাবিক। কারণ হিমাচলপ্রদেশ বা দেশের উত্তরাঞ্চলে কোনও কোনও জায়গায় শব্দটির সঙ্গে পর্যটক থেকে সাধারণ মানুষ কেউ কেউ পরিচিত হলেও, এ রাজ্যে তেমন চল নেই বললেই চলে। তাই ভাবতেই পারেন, ওয়ার্ক ফ্রম জঙ্গল ব্যাপারটি আবার কি ?
জঙ্গল থেকে কাজ করা যায় নাকি? নেটওয়ার্ক নেই, ইন্টারনেট দুর্বল। সেই জায়গা থেকে কীভাবে ওয়ার্ক ফ্রম জঙ্গল সম্ভব ? এমন অভিনব ভাবনাকেই ধরে এ রাজ্যের ওয়ার্ক ফ্রম জঙ্গল চালু করে দিয়েছেন ডুয়ার্সের কিছু পর্যটন ব্যবসায়ীরা।
পর্যটক আকর্ষণের জন্য এই পদ্ধতিতে মিলছে সাফল্যও। দিনের পর দিন ঘরে বসে একঘেয়ে কর্মজীবনের চেয়ে একটু হাত পা ছড়িয়ে দশ, পনেরো, কুড়ি তার বেশি যতদিন খুশি থাকুন না কেন, দিব্যি কখনও বৃষ্টির শব্দ শুনে, কখনও হাতির বিনোদনের আওয়াজে বা চিতা বাঘের গর্জন শুনে দিব্যি কাজ করে দিতে চালিয়ে যেতে পারেন। এমন অভিজ্ঞতা হলে মন্দ কি?
গায়ে কাঁটা দেওয়া শিহরণ জাগানো রোমাঞ্চ এখন মিলছে চিলাপাতা এবং সিকিমের রাবাংলা এলাকায়। চিলাপাতা এমন একটি পর্যটন রিসর্ট এর কর্ণধার অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, আসলে একদিকে যেমন পর্যটনের খরা চলছে, তেমনই পাশাপাশি মানুষের জীবনের একঘেয়েমি এবং মানসিক সমস্যা তৈরি হচ্ছে।
একঘেয়ে জীবনের মধ্যে থেকে তাই বাড়িতে যে ভাবে কাজ করা সম্ভব, আমরা এখানেও পুরোপুরি প্রস্তুতি তৈরি করে রেখেছি। দুটি আলাদা সার্ভিস প্রোভাইডার দিয়ে নেটওয়ার্ক-এ যাতে কোনও রকম বিঘ্নিত না হয় তার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। ফলে ওয়াইফাই ব্যবহার করে যে কেউ দিনের সাত-আট ঘণ্টা কাজ চালিয়ে যেতে পারেন।
পাশাপাশি জঙ্গলের এই পরিবেশে বাড়তি পাওনা হবে পর্যটকদের কাছে। বিষয়টি নতুন হওয়ায় ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হচ্ছে। ইতিমধ্যেই অনেকে জানতে পেরে যোগাযোগ করছেন। বেশ কিছু পর্যটক ইতিমধ্যেই ওয়ার্ক ফ্রম জঙ্গল চালু করে দিয়েছেন। এই মুূহর্তে রাজর্ষি চট্টোপাধ্য়ায় নামে এক আইটি পর্যটক রয়েছেন ওয়ার্ক ফ্রম জঙ্গল মোডে। ফলে দিব্যি চলছে কাজকর্ম।
পাশাপাশি যতই লোডশেডিংয়ের সমস্যায় জেরবার হতে না হয় তাই বিকল্প পাওয়ার ব্যাকআপ রাখা রয়েছে তাতে তারা ল্যাপটপ মোবাইল চার্জ দেওয়ার জন্য কোন বন্দোবস্ত করে দিতে পারেন ফলে কাজের কোন রকম সমস্যা হবে না।
খরচ খুব সাধারণ রাখা হয়েছে। যত বেশি দিন থাকবেন, তত বেশি সুবিধা পাবেন। তবে একটা নির্দিষ্ট সময়ের বেশি থাকলে ন্যূনতম সাড়ে ৬০০ টাকা প্রতিদিন খরচ করতে হবে। ফলে খরচ অত্যন্ত হাতের নাগালের মধ্যেই। কেউ ১-২-৪ দিন থাকলে তাকে পনেরশো টাকা প্রতিদিন থাকার জন্য খরচ করতে হবে। পাশাপাশি সেটা যতখানি বাড়তে থাকবে, ক্রমশই ১ হাজার এবং ন্যূনতম সাড়ে ৬০০ টাকাতে তারা সেই বন্দোবস্ত করে দেবেন। খাবার জন্য সামান্য অতিরিক্ত খরচ নেওয়া হবে। চার বেলা খাবার, সঙ্গে নিশ্চিন্তে দিব্যি কাজ করে ফিরে আসতে পারবেন।
এলাকার ঠিকানাটি এই বেলা জেনে রাখুন। চিলাপাতা বনের ধারে, পর্যটন ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশনের মেন্দাবাড়ি জঙ্গল ক্যাম্পের কাছে অবস্থিত। হাসিমারা এবং আলিপুরদুয়ার দুটি রেলস্টেশন থেকেই গাড়ি করে এখানে পৌঁছতে সময় লাগে মাত্র ৪৫ মিনিট। হোমস্টে-টি উত্তর মেন্দাবাড়ি গ্রামে অবস্থিত, যেখানে আয়ের প্রধান উৎস হল পর্যটন এবং বৃক্ষরোপণ। এই গ্রামের একটি প্রধান উৎপাদন হচ্ছে লেবু। জঙ্গল বুক, চিলাপাতা ঘন জঙ্গলে ঘেরা এবং প্রকৃতির কোলে কয়েক দিন কাটানোর পক্ষে অতুলনীয়। এখানে সারাদিন পাখির কিচিরমিচির উপভোগ করা যায় এবং ভাগ্য বিশেষ সদয় হলে, সন্ধ্যাবেলায় হোমস্টের কাঁটাতারের বেড়ার ঠিক বাইরে, হাতি বা বাইসনের দেখাও মিলতে পারে।
ঘরগুলি স্থানীয় কাঠ এবং বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এবং ভারতবর্ষের বিভিন্ন অভয়ারণ্য আর জাতীয় উদ্যানগুলিতে তোলা বন্যপ্রাণীর ছবি ও পুরুলিয়ার বিখ্যাত চড়িদা গ্রামের মুখোশ দিয়ে সজ্জিত করা হয়েছে। রুডইয়ার্ড কিপলিংএর বিখ্যাত উপন্যাসের নামাঙ্কিত এই হোমস্টের ঘরগুলির নামকরণও, ওই উপন্যাসটির বিভিন্ন চরিত্রের ওপরে করা হয়েছে, যেমন মোগলি, বাঘিরা, বালু, শের খান ইত্যাদি। জঙ্গল বুকের কাছাকাছি অনেক জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে। যেমন জয়ন্তী, বক্সা টাইগার রিজার্ভ, জলদাপাড়া ন্যাশনাল পার্ক, রায়মাটাং পিকনিক স্পট, সাউথ খয়েরবাড়ি চিতা উদ্ধার কেন্দ্র, কোচবিহার রাজপ্রাসাদ, রসিকবিল ইত্যাদি।