পদে পদে মৃত্যুর ঝুঁকি। সাপ,জোঁক,বন্যপ্রাণীর হামলার আশঙ্কা প্রতি পদে। মৃত্যুর ঝুঁকিও রয়েছে ষোলআনা।
সেই ঝুঁকি মাথায় নিয়েই দুর্গম পাঁচটি পাহাড়কে জয় করেই ভারত-ভুটান সীমান্তের একেবারে শেষ প্রান্তে ডুকপা জনজাতির গ্রামে করোনার ভ্যাক্সিন নিয়ে পৌঁছে গেলেন আলিপুরদুয়ারের জেলাশাসক সুরেন্দ্র মিনা।
সমতল থেকে দুর্গম পাহাড়ের চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ১২ কিলোমিটার পথ। গভীর জঙ্গলে ঘেরা সেই পাহাড়ি পথ ধরে লাঠি হাতে চললেন জেলা শাসক।
পাহাড়ি সেই পথে প্রতি পদে মৃত্যুর ঝুঁকি। প্রাণের মায়া না করে পাহাড়ি সেই গ্রামে কীভাবে পৌঁছলেন জেলাশাসক সুরেন্দ্র কুমার মিনা!
শনিবার কার্যত অবাক হয়ে গেছেন ডুকপা সম্প্রদায়ভুক্ত গ্রামটির প্রায় ৩ শতাধিক মানুষ। আদমার মত গ্রামে স্বাস্থ্য দপ্তরের টিম পৌঁছবে এতটা ভাবেননি তাঁরা।
সেখানেই ভ্যাক্সিন দেবার কাজ চলবে, এমনটা ডুকপা গ্রামের অনেকেরই কল্পনায় ছিল না। আর এর আগে তো এমনভাবে কেউ করেননি। যাতে বিশ্বাস করা সম্ভব নয়।
কোনও তবে শনিবার সকাল থেকেই প্রবল উৎসাহ নিয়ে আদমার স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লাইন দিয়ে ভ্যাক্সিন নিয়েছেন শতাধিক ৪৫ বছরের বেশি বয়স্করা।
উল্লেখ্য, আলিপুরদুয়ার জেলা সদর থেকে মাত্র ৫০ কিমি দূরে বক্সা পাহাড়ের কোলে আদমা গ্রাম। রায়মাটাং থেকে পায়ে হেঁটে গ্রামে পৌঁছাতে হয়।
বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের এক্কেবারে কোর এলাকায় রয়েছে গ্রামটি। তবে প্রায় ১২ কিমি রাস্তা পার করা সাধারণ মানুষের পক্ষে যথেষ্টই কঠিন।
পুরোপুরি পাহাড়ি পথে ট্রেকিং করে পৌঁছতে হয়। বিপদজনক খাদ রয়েছে। পা পিছলে গেলে অন্তত ১০০ ফুট নিচে পরে যাবার সম্ভাবনা থাকে।
তবে জেলাশাসক বিডিও প্রশান্ত বর্মন, স্বাস্থ্য কর্মীদের নিয়ে পৌঁছে যান গ্রামে। উল্লেখ্য, আদমা গ্রামটি প্রায় ৩২০০ ফুট উচ্চতায় রয়েছে।
আদমার পাশাপাশি এলাকায় চারটি আর ছোট গ্রাম ফুলবাটি, শেওগাও, সামনা, তড়িবাড়ি রয়েছে। মোট ৩৮৭ টি পরিবার রয়েছে।
এদিকে, জেলাশাসক এদিন সকাল থেকেই আদমা গ্রামের বিভিন্ন পরিবারের কাছে চলে যান। শুধু ভ্যাক্সিন নিতে উৎসাহ দেওয়াই নয়,স্থানীয়দের কি কি চাহিদা রয়েছে বিস্তারিত ভাবে তা শুনেও নেন।
জেলাশাসক বলেন,ইতিমধ্যেই আদমা এলকায় প্রতিটি বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ হয়েছে। স্কুলের উন্নয়ন হয়েছে। কমিউনিটি শৌচাগার তৈরি হয়েছে।
এবার আর ৫০ লক্ষ টাকার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। আমরা একটি কমিউনিটি হলঘর, আইসিডিএস কেন্দ্র দ্রুত স্থাপন করবো আদমাতে।
রাস্তা নিয়ে বনদপ্তরের সাথে কথা বলব। কারণ এলাকাটি পুরোপুরি বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের কোর এলাকায় রয়েছে। তবে রাস্তার কিছুটা উন্নয়ন জেলা প্রশাসনের থেকে করা যায়। তাও বিবেচনায় রয়েছে।
উল্লেখ্য, বক্সা পাহারের পূর্ব দিকের গ্রামগুলিতে ইতিমধ্যেই ভ্যাক্সিন দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এবার আদমাতেও শুরু হল।
স্থানীয় বাসিন্দা ঠেলে ডুকপা বলেন,জেলাশাসককে ধন্যবাদ জানিয়ে ছোট করতে চাই না। তবে আমরা ডুকপারা আজ সবাই খুব খুশি।
কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অনেকটাই স্বস্থিতে আমরা। ইয়াংকি ডুকপা বলেন, আমরা ভারত বর্ষে রয়েছি। মাঝে মাঝে নিজেরাই ভুলে যাই।
তবে আমাদের গ্রাম এতটাই গভীরে যে মানুষের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে ছিলাম। সুযোগ সুবিধা কিছু পেলেও সরকারি আধিকারিকদের দেখা তেমন পাই না।
তবে জেলাশাসক নিজে গাড়ির বিলাসিতা ছেড়ে নিজে কষ্ট সহ্য করে এভাবে পাহাড়ি পাথুরে পথে উঠে আসবে বলে ভাবতে পারিনি। ভাবা কী সম্ভব!
এই জেলাশাসক অনেকটাই দূরত্ব ঘুচিয়ে দিলেন। সামনে জেলাশাসককে পেয়ে সমস্যার কথা বলবেন কী, আবেগ বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন সকলেই।
প্রাথমিকভাবে আলিপুরদুয়ার জেলা প্রশাসনের থেকে জানা গেছে, ভ্যাক্সিন কর্মসূচিকে সামনে রেখে কোন জেলাশাসক প্রথম আদমায় পা রেখেছেন।
প্রয়োজনে আবার যাবেন। বাকি সমস্যা যা আছে তা দুর্গমতার জন্য। সেটুকু মিটিয়ে ফেলাটা কিছুটা সমস্যার। তবে প্রশাসনের তরফে আদমা এবং ওই রকম দুর্গম এলাকার দিকে নজর রাখা হচ্ছে।