মায়ানমরে অং সান সুকির নেতৃত্বাধীন আসমারিক সরকারকে হটিয়ে দিয়ে ক্ষমতার মসনদে এখন মিন অং হ্লাইং। ফলে তিনি কিভাবে দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যান, তা এখন আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। এককথায় দেশের সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং এখন আলোচনার কেন্দ্রে।
মায়ানমারের সেনাবাহিনী জনবিচ্ছিন্ন। সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সামান্যই জানতে পারে বাইরের মানুষ। মিয়ানমারের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা ও প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং-কে নিয়ে সোমবারের পর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আগ্রহ ক্রমেই বাড়ছে।
১৯৬২ সালে অভ্যুত্থানের পর থেকে প্রায় ৫০ বছর ধরে মায়ানমারে সরাসরি সেনা শাসন চলেছে। দেশটিতে অভিভাবকের ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে সেনাবাহিনীকে। ২০০৮ সালে মায়ানমারে যে সংবিধান রচিত হয়, তাতে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় স্থায়ীভাবে বড় অবস্থান পাকাপোক্ত করে নেয় সেনাবাহিনী। পার্লামেন্টের মোট আসনের শতকরা ২৫ ভাগ আসন সেনাবাহিনীকে ছেড়ে দিতে হয়। এসব আসনে সেনাবাহিনী যাকে খুশি তাকে নিয়োগ করতে পারে।
এখানেই ক্ষমতার শেষ নয়, প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র, সীমান্ত বিষয়ক মন্ত্রক ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পদে সরাসরি নিয়োগ করতে পারেন সেনাপ্রধান। সু চির দল ‘ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি’ সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে এমনই চুক্তি করেছিল সেনা। অং সান সুকি-সহ এনএলডি-র অনেক সদস্যকে এর আগে প্রাক্তন সামরিক জান্তার বিরোধিতা করার কারণে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছিল।
জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের উত্থান
মায়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের বয়স এখন ৬৪ বছর। তিনি ১৯৭২-১৯৭৪ সাল পর্যন্ত ইয়াঙ্গুন ইউনিভার্সিটিতে আইন নিয়ে পড়াশোনা করেন। তখনও তার মধ্যে রাজনৈতিক সক্রিয়তা তেমন দেখা যায়নি। তাঁর এক সহপাঠী ২০১৬ সালে রয়টার্সকে বলেছিলেন, মিন অং হ্লাং খুব কম কথার মানুষ। সাধারণত তিনি লো-প্রোফাইল রক্ষা করে চলেন। যখন সহপাঠীরা বিক্ষোভে যোগ দিলেন তখন মিন অং হ্লাইং প্রধান সামরিক বিশ্ববিদ্যালয় ডিফেন্স সার্ভিসেস একাডেমিতে (ডিএসএ) আবেদন করেন। ১৯৭৪ সালে তৃতীয় দফার পরীক্ষায় তিনি সফল হন। ডিএসএতে তার এক সহপাঠীর মতে, তিনি ছিলেন একজন গড়পরতার ক্যাডেট।
সেনা থেকে রাজনীতিক
মায়ানমারে গণতান্ত্রিক পালাবদল যখন শুরু হয় ২০১১ সালে তখন সেনাবাহিনীর দায়িত্ব নেন মিন অং হ্লাইং। ইয়াঙ্গুনের কূটনীতিকরা বলেন, সুকির প্রথম দফার মেয়াদে মিন অং হ্লাং নিজেকে একজন স্পষ্টভাষী সেনা থেকে একজন রাজনীতিক হিসেবে পাল্টে ফেলেন। বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাত, সরকারি কর্মকান্ড তিনি ফেসবুকে প্রচার করতে থাকেন। ২০১৭ সালে তার সেনাবাহিনী রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলিম সংখ্যালঘুদের ওপর নৃশংস নারকীয় অত্যাচার চালায়। এর আগে পর্যন্ত তার সরকারি প্রোফাইলে হাজার হাজার মানুষ ছিলেন ফলোয়ার।
কূটনীতিক ও পর্যবেক্ষকরা বলেছেন, অন্য দেশগুলোতে যেসব রাজনৈতিক পালাবদল ঘটেছে তা নিয়ে পড়াশোনা করেছেন মিন অং হ্লাইং। তিনি ২০১১ সালে ক্ষমতার পালাবদলের ফলে লিবিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যে বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তা ভালকরেই পর্যবেক্ষণ করেছেন হ্লাং। এর পর থেকে মায়ানমারের সেনাবাহিনীর প্রধান কখনোই ক্ষমতা ছাড়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তাই তিনি পার্লামেন্টে সেনাবাহিনীর জন্য শতকরা ২৫ ভাগ আসন সংরক্ষিত রাখতে সক্ষম হয়েছেন, যা সুকি সরকারকে অনেকটা বিপজ্জনক অবস্থায় ফেলে দেয়।
২০১৬ সালে আরো ৫ বছরের জন্য নিজের ক্ষমতার মেয়াদ বৃদ্ধি করিয়ে নেন সেনাপ্রধান। সেনাবাহিনীর নিয়মিত রদবদলের অংশ হিসেবে সে সময় তার পদত্যাগ করার কথা।
সেনার মতে, গত ৮ই নভেম্বর মিয়ানমারে যে ভোট হয়েছে, তাতে ভোটার তালিকায় ছিল ব্যাপক অনিয়ম। এ করণে সুকির দল বিজয়ী হয়। গত সোমবারই নির্বাচনের পর পার্লামেন্টের প্রথম অধিবেশন বসার কথা ছিল এবং তাতে নির্বাচনের ফল পূর্ণতা পেতো - কিন্তু সেনাঅভ্যুত্থানের কারণে আর তা সম্ভব নয়।
গত বছরের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সু চির দল এনএলডি ৮৩ শতাংশ আসনে জয়ী হয়। এই জয় মেনে নেয়নি সেনাবাহিনী। নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ তুলেছে সেনাবাহিনী। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে সেনাবাহিনী আবার ক্ষমতা দখল করবে—এমন গুঞ্জন চলছিল।
সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং কিছুদিন আগে এক বক্তব্যে মায়ানমারের সংবিধান বাতিল করার হুঁশিয়ারি দেন। এরপরই উত্তেজনা চরমে ওঠে। গত সপ্তাহে ইয়াঙ্গুনের বাণিজ্যিক এলাকার রাস্তায়, রাজধানী নেপিডো ও অন্যান্য এলাকায় সেনাবাহিনীর ট্যাংক মোতায়েন করা হয়। শেষ পর্যন্ত গুঞ্জনই সত্যি হয়েছে। স্থানীয় সময় সোমবার মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সুকি, প্রেসিডেন্ট প্রেসিডেন্ট উইন মিন্ত ও অন্য জ্যেষ্ঠ নেতাদের আটক করে সেনাবাহিনী।
এক বছরের জন্য দেশটিতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে সেনাবাহিনী। মায়ানমারের সেনাবাহিনী পরিচালিত মিয়াওয়ারদি টিভিতে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের আইনব্যবস্থা, প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থা মিন অং হ্লাইংয়ের কাছে হস্তান্তর করা হলো। এ ছাড়া দেশটির ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন সেনাবাহিনীর প্রাক্তন জেনারেল মিন্ত সুয়ে।
এদিকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে পশ্চিমা দেশগুলো মায়ানমারের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। দেশটির অনেক জেনারেলের ওপর নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে। এসব চাপের কারণে মায়ানমার আরো বেশি চিনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এ ছাড়া মায়ানমারের সামরিক বাহিনীর কর্মকাণ্ডে সমর্থন আছে রাশিয়ারও।
এই বছর বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়ার কথা ছিল জেনারেল মিন অং হ্লাংই-এর । রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা পরিচালনার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে ইতিমধঅযে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। কিন্তু চিন তাকে সম্মান জানিয়েছে। গত মাসে ৬৪ বছরের এই জেনারেলের সঙ্গে এক বৈঠকে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই উভয় দুই দেশকে ‘ভাই’ বলে উল্লেখ করেন এবং মায়ানমার সেনাবাহিনীর ‘পুনরুজ্জীবনের’ প্রশংসা করেন।
মায়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান নিয়ে চিন এখনও নীরব। বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন মিয়ানমারকে বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী হিসেবে উল্লেখ করে সব পক্ষকে যথাযথভাবে পার্থক্য ঘোচানোর আহ্বান জানিয়েছেন। গত বছরের শেষ পর্যন্ত চীন ছিল মিয়ানমারের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিনিয়োগকারী। ফলে মায়ানমারে বদলে যাওয়া পরিস্থিতির দিকে কড়া নজর রাখছে ভারতও।