দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অ্যাডল্ফ হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসি জার্মানি গড়ে তোলে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর গণহত্যার এক নির্মম অধ্যায়—হলোকাস্ট। এই গণহত্যায় প্রাণ যায় প্রায় ৬০ লক্ষ ইহুদি, যাঁদের বড় অংশকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছিল ‘গ্যাস চেম্বার’-এ। শুধুমাত্র ইহুদি নয়, রোমা (জিপসি), সমকামী, প্রতিবন্ধী ও রাজনৈতিক বন্দিদের উপরও চালানো হয়েছিল এই নিধনযজ্ঞ।
প্রথমদিকে হিটলার ও নাৎসি বাহিনী বন্দিদের গুলি করে হত্যা করত। কিন্তু তা ছিল সময়সাপেক্ষ এবং ‘মানসিকভাবে ক্লান্তিকর’—এমনটা মনে করত নাৎসিরা নিজেরাই। তাই হিটলার ও এসএস (SS) বাহিনী একটি ‘দক্ষ ও নির্বিকার’ হত্যাপদ্ধতি চাইছিল, যা একই সঙ্গে অনেক মানুষকে একসঙ্গে নিঃশব্দে মেরে ফেলতে পারবে। এই ‘সমস্যার’ সমাধান হিসেবে ১৯৪১ সালে শুরু হয় গ্যাস চেম্বার ব্যবস্থার পরিকল্পনা।
ট্রেব্লিঙ্কা (Treblinka), সোবিবার (Sobibor), বেলজেক (Belzec)—এই সব ‘মৃত্যুশিবিরে’ গড়ে তোলা হয়েছিল গ্যাস চেম্বার। এগুলি ছিল মূলত ‘নিধন শিবির’ (Extermination Camps)। অ্যুশভিট্জ ছিল সবচেয়ে বড় ও ভয়ংকর। এখানেই সর্বাধিক সংখ্যক মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল।
বাইরে থেকে দেখে গ্যাস চেম্বারকে অনেক সময় ‘শাওয়ার রুম’ বা স্নানঘর বলে প্রতিভাত করা হত। বন্দিদের বলা হত, তাঁদের স্নান করানো হবে। ফলে তাঁরা কোনওরকম সন্দেহ না করেই সেখানে ঢুকে পড়তেন। ভিতরে প্রবেশের পর দরজা আটকে দেওয়া হত। চারপাশে থাকত কংক্রিটের দেওয়াল। ছাদের ওপরে থাকত ছিদ্র, যার মাধ্যমে গ্যাস ঢুকত চেম্বারে।
যখন একসঙ্গে ২০০-৫০০ বা কখনও ১,০০০ বন্দিকে চেম্বারে ঢোকানো হত, তখন উপরে থেকে ফেলে দেওয়া হত বিষাক্ত গ্যাস। সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হত "Cyclone B" নামক গ্যাস—যা একধরনের হাইড্রোজেন সায়ানাইড। এটি মূলত পোকার ও প্যারাসাইট মারার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু নাৎসিরা সেটিকে গণহত্যার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। গ্যাস ঢোকার কয়েক মিনিটের মধ্যেই মানুষরা দমবন্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়তেন। কিন্তু মৃত্যু হতো ভয়াবহ যন্ত্রণায়।
ভবনের চারদিক ছিল সাউন্ডপ্রুফ, ফলে বাইরের লোক কিছু টের পেত না। মৃত্যুর পর মৃতদেহগুলোকে টেনে নিয়ে যাওয়া হত ‘ক্রেমেটোরিয়ামে’, যেখানে দেহ পোড়ানো হত, যেন কোনও প্রমাণ না থাকে।
শুধুমাত্র অ্যুশভিট্জেই প্রায় ১১ লক্ষ মানুষকে গ্যাস চেম্বারে মেরে ফেলা হয়েছিল। এর মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ ছিলেন ইহুদি। গোটা নাৎসি মৃত্যুশিবিরে গ্যাস চেম্বার ব্যবস্থার মাধ্যমে মারা হয়েছিল আনুমানিক ৩০ লক্ষ মানুষকে।
গ্যাস চেম্বারে বন্দিদের লাশ বের করে আনতেন ‘সন্ডারকম্যান্ডো’ (Sonderkommando)-রা। তাঁরা নিজেরাও ছিলেন বন্দি, যাঁদের জোর করে এই নিষ্ঠুর কাজ করানো হত। নির্দিষ্ট সময় পর তাঁদেরও হত্যা করে ফেলা হত, যাতে সত্যি কেউ জানতে না পারে।
গ্যাস চেম্বার কেবল শারীরিক মৃত্যুই আনেনি, তা ছিল মনুষ্যত্বকে ধ্বংস করার এক নির্মম যন্ত্র। প্রতিদিন হাজারে হাজারে পুরুষ, মহিলা ও শিশুকে ঢুকিয়ে দেওয়া হত মৃত্যু-কক্ষে। শিশুদের কাঁধে তুলে ধরত মা, বৃদ্ধদের হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকত তরুণেরা—কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যে সবাই একসঙ্গে নিথর হয়ে যেতেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে মিত্রশক্তি যখন নাৎসি শিবিরগুলিতে পৌঁছয়, তখনই সামনে আসে এই ভয়ঙ্কর ইতিহাস। নুরেমবার্গ ট্রায়ালে নাৎসি নেতাদের বিচার হয়। গ্যাস চেম্বারের নির্মাতা এবং ব্যবহারকারী অনেক এসএস অফিসারকে ফাঁসি দেওয়া হয়। তবে অনেক অপরাধী পার পেয়ে গিয়েছিল বলেও অভিযোগ রয়েছে। হিটলারের গ্যাস চেম্বার ছিল এক সাংঘাতিক পরিকল্পিত নির্মমতা, যার মধ্যে মানব সভ্যতার সবচেয়ে অন্ধকার সময় লুকিয়ে আছে। সেই গ্যাস চেম্বার আজ ইতিহাসের এক ভয়ঙ্কর শিক্ষা—যেখানে মনে করিয়ে দেয়, ঘৃণা ও বিভেদের কী নির্মম পরিণতি হতে পারে।